ডিজিটাল বাংলাদেশ আমরা চাইছি বটে, কিন্তু এককভাবে তো এই বাংলাদেশ
গড়া যাবে না? ২০২১ সালে বাংলাদেশের বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৫০ বছর। ৪২ বছরে পা
দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? যৌথভাবেই তো পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।
এরই নাম গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র অনুপস্থিত বাংলাদেশে। অর্থনীতি একটি সংকটের
মধ্য দিয়ে যাচ্ছে
আমরা স্বাধীনতার এই একচলি্লশ বছরে এগোতে পেরেছি কত দূর? ১৯৭২ সালের ৪
নভেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল গণতান্ত্রিক
পদ্ধতিতে একটি শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা। কিন্তু আমাদের
সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। কত ধরনের সরকারই তো এসে গেল গত ৪১ বছরে_
গণতান্ত্রিক, একদলীয়, সামরিক একনায়কতান্ত্রিক, রাষ্ট্রপতিশাসিত,
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা কিংবা দলীয় কর্তৃত্ববাহী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
কিন্তু সঠিক অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রতিষ্ঠিত হয়নি
ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা। বরং ধনী ও গরিবের মধ্যে ব্যবধান বেড়েছে।
ধনী আরও ধনী হয়েছে। হাজার হাজার কোটিপতির সৃষ্টি হয়েছে এই বাংলাদেশে।
অন্যদিকে দারিদ্র্য বেড়েছে। ২০০৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিগত ২৮ বছরে
বাংলাদেশের উন্নয়নে ২৪ হাজার ১০১ কোটি টাকা সাহায্য এসেছিল আন্তর্জাতিক
দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে। কিন্তু তাতে উপকৃত হয়েছে কারা? বিশ্বব্যাংক ও
আইএমএফের পরামর্শে আমরা তৈরি করেছিলাম দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র। প্রথম
কৌশলপত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় আরেকটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা
হয়েছিল ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন করে। কিন্তু দারিদ্র্য
কমেনি। দারিদ্র্যকে ব্যবহার করে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণীর জন্ম হয়েছে
বাংলাদেশে। ১৯৭২ সালে মাথাপিছু ঋণের বোঝা যেখানে ছিল মাত্র ৬৭ টাকা, ২০০৪
সালে তা এসে দাঁড়ায় ৭ হাজার ২০০ টাকায়। ২০০৮ সালে সরকারি হিসাবে এর পরিমাণ
১৭ হাজার টাকা। ২০১১ সালে এই অর্থের পরিমাণ ২৪ হাজার টাকাকে অতিক্রম করেছে।
আমরা এগোতে পেরেছি! নিশ্চয়ই পেরেছি। হাজার হাজার গাড়ি প্রতিদিন ঢাকা শহরে
নামছে। শত শত ফ্ল্যাট তৈরি হয়েছে, বিক্রিও হচ্ছে। সাধারণ একটি ফ্ল্যাটের
দাম যেখানে এক কোটি টাকা, তা তো বিক্রি হচ্ছে এই ঢাকা শহরেই। আমরা এগোতে তো
পেরেছিই!
গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করার জন্য আমরা দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা
প্রবর্তন করেছিলাম। গত একচলি্লশ বছরে ১৫ বার সংবিধান সংশোধন করেছি।
সংবিধান সংশোধন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংবিধান
সংশোধন করা হয়। আমরাও করেছি। কিন্তু তাতে করে জনগণের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে
কি? যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আমরা হরতাল পর্যন্ত
করেছিলাম এবং যা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল, মাত্র ১৫
বছরের মধ্যে এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন তিনটি জাতীয় নির্বাচনের পরও আবার তা
সংসদে বাতিল হলো। কিন্তু কার স্বার্থে? গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কোনো বিধান থাকতে পারে না_ এটি সত্য। সে
সঙ্গে এটিও সত্য, পৃথিবীর সব দেশে একই নিয়মে গণতন্ত্র বিকশিত হয় না। মিল
খোঁজাটা অর্থহীন। আজকে রাশিয়ার বিকাশমান গণতন্ত্রের সঙ্গে ইউরোপের জার্মানি
বা ফ্রান্সের গণতন্ত্রকে মেলানো যাবে না। অথচ রাশিয়া ইউরোপীয় সংস্কৃতিরই
ধারক। আজকে ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যখন
অখিলেশ যাদব শপথ নেন, তিনি পরিবারতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করেন বটে, কিন্তু
এটিই ভারতীয় গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। উচ্চশিক্ষিত অখিলেশ ভারতীয় রাজনীতির
তরুণ প্রজন্ম। এই তরুণ প্রজন্ম উচ্চশিক্ষিত, আধুনিকমনস্ক, এরাই ভারতকে নতুন
এক যুগে টেনে নিয়ে যাবেন। বাংলাদেশে যদি এই পরিবারতন্ত্রের ছায়া পড়ে, তাতে
ক্ষতি কী? আমাদের দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। উচ্চশিক্ষিত একটি
মধ্যবিত্তশ্রেণী তৈরি হয়েছে, যারা আধুনিকমনস্ক। তারা রাজনীতিতে পরিবর্তন
আনতে পারেন।
গত একচলি্লশ বছরে আমরা অনেক এগিয়েছি। এ পর্যন্ত নয়টি সংসদ নির্বাচন
অনুষ্ঠিত হয়েছে, যদিও তার তিনটির (১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯৬) কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল
না। আমরা সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী (১৯৯১) এনে সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে
গিয়েছিলাম। সেই সংশোধনীর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ছিল, আজও আছে। কিন্তু যা
হয়নি, তা হচ্ছে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। আমরা সংসদীয় রাজনীতি চেয়েছি
বটে, কিন্তু চেয়েছি নিজের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ও দলীয় কর্তৃত্ব বজায়
রাখার স্বার্থে। বিরোধী দলও যে সরকারের একটি অংশ_ এ কথাটি আমরা ভুলে গেছি।
সংসদীয় রাজনীতিতে 'কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস' বা পরস্পরের প্রতি আস্থা ও
বিশ্বাস রাখার যে কথা বলা হয়, তা আমরা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেইনি।
আমরা গণতন্ত্র চেয়েছি। কিন্তু শুধু একটি নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা
করা যায় না। এ জন্য দরকার মানসিকতা পরিবর্তনের, যা আমাদের রাজনীতিতে
দুঃখজনকভাবে অনুপস্থিত। গণতন্ত্রের মূল জায়গাটা হচ্ছে সংসদ, যেখানে আলোচনা
হবে, সমালোচনা হবে এবং জাতীয় স্বার্থে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। কিন্তু
সেই সংসদকে আমরা অকার্যকর করছি। সংসদ বয়কট একটা \'কালচারে\' পরিণত হয়েছে।
এই ধারা শুরু হয়েছিল পঞ্চম সংসদ থেকে, যেখান থেকে আমরা গণতন্ত্রের পথে চলতে
শুরু করেছিলাম। জনগণের কথা বলার জন্যই সংসদ। হাজার হাজার টাকা প্রতি
মিনিটে খরচ হয় সংসদ পরিচালনা করতে। এখন সংসদ চলছে একদলীয়ভাবে, সিদ্ধান্ত
হচ্ছে একদলীয়ভাবে, জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত কোনো সিদ্ধান্তই সংসদে আলোচিত হচ্ছে
না। কোনো কোনো ইস্যুতে জাতি থাকছে এক মহাঅন্ধকারে। সংসদে একটা ডিবেট চাই,
কিন্তু যেভাবে সংসদে অসংলগ্ন কথা বলা হয়, জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে
অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করা হয়, কিংবা কালো পতাকা প্রদর্শন করা হয়, তার নাম
আর যা-ই হোক সংসদীয় রাজনীতি হতে পারে না।
'ডিজিটাল বাংলাদেশ' আমরা চাইছি বটে, কিন্তু এককভাবে তো এই বাংলাদেশ গড়া
যাবে না? ২০২১ সালে বাংলাদেশের বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৫০ বছর। ৪২ বছরে পা দিয়ে
আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? যৌথভাবেই তো পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। এরই নাম
গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র অনুপস্থিত বাংলাদেশে। অর্থনীতি একটি সংকটের মধ্য
দিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। বিশ্বমন্দায় আমরা
আক্রান্ত। প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ ভাগ হবে কি-না তার নিশ্চয়তা নেই। যেখানে ইউরোপে
কৃচ্ছ্রসাধন চলছে (গ্রিস আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত), সেখানে আমাদের রাজস্ব
ব্যয় বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে
মধ্যবিত্ত ও গরিব শ্রেণী। অথচ তারাই গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক। তারাই ভোট দিয়ে 'প্রিয় দল'কে ক্ষমতায় বসায়। বিদ্যুৎ সংকট অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে এরই
মধ্যে জটিল করেছে। শিল্প ও কৃষি খাতে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল তা স্তিমিত হয়ে
পড়েছে। এ থেকে উত্তরণের যে পথ (সবাই মিলে সমাধানের পথ খোঁজা), সে পথে আমরা
হাঁটছি না। আমরা তো এগোতে চাই। কিন্তু এগোব কীভাবে? জাতীয় ইস্যুতে আমরা
এখনও বিভক্ত। এই বিভক্তি জাতি গঠনে প্রধান অন্তরায়। সংসদীয় রাজনীতি
প্রাধান্য পেয়েছে, কিন্তু দলীয় কর্তৃত্ব এখানে সর্বগ্রাসী। পরস্পরের প্রতি
আস্থাহীনতা আমাদের 'বড় অর্জন'কে ম্লান করে দিয়েছে। বাস্তবতাই হচ্ছে
বিরোধী দল জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩৭ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে (নবম সংসদ)। বিরোধী
দলকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্র বিনির্মাণ অর্থহীন। বাংলাদেশের গত ৪১ বছরের
রাজনীতিতে রাজনীতিবিদরা পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রেখে একটি
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আমাদের উপহার দিতে পারেননি। এটি আমাদের ব্যর্থতা। এই
ব্যর্থতার সুযোগ নিতে পারে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
0 comments:
Post a Comment