সৌদি আরবের আরব নিউজ-এ একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে অতি সম্প্রতি। উক্ত সংবাদে সৌদি উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলাউদ্দিন আল আসকারির একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ঢাকায় নিযুক্ত সৌদি কূটনীতিক খালাফ আল আলির হত্যাকাণ্ডের মোটিভ ও হত্যাকারীদের গ্রেফতার করতে বাংলাদেশ সরকার ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু ওই পত্রিকাটিতে অন্য যে মন্তব্যটি করা হয়েছে, তা আমাদের জন্য উত্কণ্ঠার ও উদ্বেগের। পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়েছে, খালাফ আল আলির হত্যাকারীদের গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হলে সৌদি আরবে বসবাস ও কর্মরত ২০ লাখ বাংলাদেশি নাগরিক নিয়ে সঙ্কট তৈরি হতে পারে। ‘আরব নিউজ’-এ প্রকাশিত সংবাদটি অনলাইন বার্তা সংস্থা বার্তা২৪.নেট-এ গত ১৩ এপ্রিল প্রকাশ পেয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সৌদি কূটনীতিক খালাফ আততায়ীর হাতে মারা যান গত ৬ মার্চ। এর প্রতিক্রিয়ায় আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি সৌদি আরব সফর করেন ২১ মার্চ। এরপর সৌদি গোয়েন্দাদের একটি প্রতিনিধি দলও বাংলাদেশ সফর করে যায়। কিন্তু তারপরও খালাফ হত্যাকাণ্ডের কোনো সুরাহা হয়নি। এমনি এক পরিস্থিতিতে আরব নিউজ যখন এ ধরনের একটি মন্তব্য করে, তখন তা গুরুত্ব পায় বৈকি! সৌদি কূটনীতিকের হত্যাকাণ্ডের খবরটি মধ্যপ্রাচ্যসহ বহির্বিশ্বে ব্যাপক প্রচার পায়। এতে করে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশে সন্ত্রাসীরা তত্পর এবং বাংলাদেশ সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, এমন মন্তব্যও করেছিলেন মার্কিন উপসহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস শিয়ার। সুতরাং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলির দিকে যে আমাদের বহু রাষ্ট্র নজর রাখছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা এ ধরনের ‘হাই প্রোফাইল’ হত্যাকাণ্ডকে কতটুকু বিবেচনায় নিয়েছেন, বলতে পারব না। কিন্তু আরব নিউজ যখন সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় কিংবা যখন উল্লেখ করা হয় ঢাকা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া থেকে ইউরোপে যে মাদক পাচার করা হয়, তার অন্যতম কেন্দ্র, তখন পরোক্ষভাবে আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এ ধরনের প্রতিবেদন সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে উন্নত করতে আদৌ সাহায্য করবে না। বরং সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারে। প্রতিবেদনটিতে সৌদি উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্ধৃতি থাকায় প্রতিবেদনটির গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে। খালাফ হত্যাকাণ্ডের পর সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে বিবৃতি প্রচার করা হয়েছিল, তাতে স্পষ্টতই একটি মেসেজ ছিল। এটা স্পষ্ট খুনিদের গ্রেফতার ও সুষ্ঠু তদন্ত চায় সৌদি আরব। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীও জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছিলেন। এই ‘দাবি’ একটি মেসেজ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি যে কীভাবে নেবে, আমি জানি না। কিন্তু সত্যি সত্যিই যদি প্রকৃত দুষ্কৃতকারীদের গ্রেফতার করা সম্ভব না হয় কিংবা প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করা সম্ভব না হয়, তাহলে তা মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের জন্য বড় ধরনের কূটনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এই বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবেচনায় নিলে ভালো করবে। এমনিতেই পুলিশের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আমি রীতিমতো হতাশ। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড নিয়ে আজও কূল-কিনারা হল না। আমরা ধীরে ধীরে ভুলতে বসেছি এই হত্যাকাণ্ডের খবর। মিডিয়ায় লেখালেখির কারণে সম্ভবত এখানে একটি ‘জজমিয়া নাটক’ মঞ্চস্থ হয়নি। কিন্তু মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন ‘প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড মনিটর করছেন, তখন আমি একটা ধন্দে পড়ে যাই। যদি সত্যি সত্যিই প্রধানমন্ত্রী মনিটর করে থাকেন (?), তাহলে এতদিন কেন লাগবে হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের ভূমিকা ও দক্ষতা তাই সঙ্গত কারণেই উঠবে। পুলিশ যদি মূল কাজ ফেলে ‘অন্য কাজে’ বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে হত্যাকারীরা তো এ সুযোগ নেবেই! পুলিশের উচিত মূল কাজে মনোনিবেশ করা ও তাদের দক্ষতা বাড়ানো। একজন ‘থ্রি স্টার জেনারেলের’ পদ সৃষ্টি করে কিংবা পুলিশ বাহিনীর জন্য পাঁচজন সিনিয়র সচিব পদ সৃষ্টি করে যে পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা বাড়ানো যায় না, সেটা আবারও প্রমাণিত হল খালাফ আল আলির হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই মন্ত্রণালয়ের দিকে দৃষ্টি দিলে ভালো করবেন।
মার্কিন কর্মকর্তা জেমস শিয়ার যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যখন বলেন, ‘বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ ও বাইরের সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকিমুক্ত নয়’, তখন সরকারের পক্ষ থেকে এর একটা ব্যাখ্যা দাবি করা উচিত ছিল। কেননা প্রধানমন্ত্রী তো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নেই। এটাই হচ্ছে বাস্তব কথা। বর্তমান সরকারের শাসনামলে গেল তিন বছরে আমরা কোনো বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড লক্ষ করিনি। সন্ত্রাসীরা তেমনভাবে সংগঠিত হতে পারছে না। বিচ্ছিন্ন দুয়েকটি সংবাদ ছাপা হলেও তাদের তত্পরতা, সমাবেশ, লিফলেট বিতরণ কিংবা জমায়েতের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থেকেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে পুলিশ অবিশ্যি তত্পর হয়েছে। কিন্তু ওইসব নিষিদ্ধ ঘোষিত গ্রুপ কর্তৃক কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে আমরা দেখিনি। তাই ‘অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশ একটি ঝুঁকিমুক্ত দেশ’, তা নিঃসন্দেহে বলা যাবে না। বাইরের সন্ত্রাসী হামলা? এটাও তো আমাদের চোখে ধরা পড়েনি। কিছু ‘ভারতীয় সন্ত্রাসী’ বাংলাদেশে পালিয়ে ছিল। কিন্তু তাদের কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছিল না এ দেশে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের হস্তান্তরের ফলে ওই অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটেছে। এর বাইরে আল কায়দা কিংবা লস্কর-ই তৈয়বার মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের কোনো নেটওয়ার্ক বাংলাদেশে কাজ করছে বলেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আমাদের কখনও অবহিত করেনি। ফলে মার্কিন কর্মকর্তার বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। তার ওই বক্তব্যের উদ্দেশ্য কী-এ প্রশ্ন এখন উঠতেই পারে।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ সফর করতে ভালোবাসেন। তিনি জানিয়েছিলেন, খালাফ আল আলির মৃত্যুর ঘটনার প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে। কিন্তু এত দিন পার হওয়ার পরও সত্য বেরিয়ে আসেনি। তাতে কি আমাদের ভাবমূর্তি আদৌ উজ্জ্বল হয়েছে? বাংলাদেশি প্রায় ২০ লাখ (প্রকারান্তরে ৩০ লাখ) নাগরিক এখন সৌদিতে কর্মরত। তাদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। গত ৭ মার্চ রাতে একটি চ্যানেলে অংশ নিতে গিয়ে সৌদি আরব থেকে প্রবাসীরা ফোন করে তাদের আতঙ্কের কথা আমাদের জানিয়েছেন। এই আতঙ্কের খবরটি অত্যন্ত স্বাভাবিক। এমনিতেই বাংলাদেশ-সৌদি আরব সম্পর্ক খুব ভালো পর্যায়ে রয়েছে, এটা বলা সাজে না। গত ২০০৮ সাল থেকেই সৌদিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের নিয়োগ পরিপূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে। এটা আমাদের একটা কূটনৈতিক ব্যর্থতা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়নি কখনও। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের জনশক্তি বাজার যে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, আমাদের নীতিনির্ধারকরা তা আদৌ বিবেচনায় নেননি। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিদেশ সচিব পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই দিকটি বারবার এড়িয়ে গেছেন। অথচ সৌদি আরব বাংলাদেশকে বাইরে রেখে নেপালের মতো হিন্দুপ্রধান দেশ থেকে কর্মী সংগ্রহ করে আসছিল। শুধু তাই নয়, সংবিধানে ২৫ (২) ধারাটি সংযোজন করে আমরা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলাম। এটি ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি মূল নির্দেশনা। কিন্তু সংবিধান সংশোধনের ফলে সংবিধানের ওই ধারাটি এখন আর নেই। এতে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’তে যে প্রভাব পড়ছে তা অস্বীকার করা যাবে না। সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ককে এ প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা যেতে পারে। মোটা দাগে যেটা বলা যায়, তা হচ্ছে বাংলাদেশের নিজের স্বার্থেই উচিত ওই হত্যাকাণ্ডের মোটিভ খুঁজে বের করা এবং হত্যাকারীদের গ্রেফতার করা। প্রয়োজনে স্কটল্যান্ডইয়ার্ডের মতো বিশ্বসেরা আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহযোগিতাও নেওয়া যেতে পারে। দেশে এই মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। বিরোধী দল ১২ মার্চের কর্মসূচি পালন করে সরকার পতনের আন্দোলন ধীরে ধীরে শক্তিশালী করছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে অতিদ্রুত হত্যাকাণ্ডের মোটিভটি সুস্পষ্ট করা। এটি একটি স্পর্শকাতর হত্যাকাণ্ড। এর সঙ্গে আমাদের অনেক স্বার্থ জড়িত। একটি বিদেশি রাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে একটি সংবাদও কোনো কোনো সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। এরই প্রতিধ্বনি আমরা দেখতে পাই ষেড়নধষ ঞযত্বধঃ নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে গত ৯ মার্চ। সেখানেও মধ্যপ্রাচ্যের ওই রাষ্ট্রটির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এটা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে একটা চিন্তার কারণ। খুব দ্রুত আমরা যদি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে না পারি, তাহলে তা শুধু সৌদি আরবের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে না, বরং মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতেও এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। তাতে করে জনশক্তি রফতানিতে আরও ধস নামবে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমবে। আর মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত লাখ লাখ বাংলাদেশি কর্মী থাকবেন একধরনের নিরাপত্তাহীনতায়। আমাদের জন্য সত্যিকার অর্থেই তা কোনো ভালো সংবাদ নয়। এখন আরব নিউজ-এ প্রকাশিত সংবাদটির পর সরকার যদি দ্রুত খালাফ হত্যাকাণ্ডের মোটিভ উদঘাটন করতে পারে, তা আমাদের জন্য মঙ্গল।
দৈনিক সকালের খবর, ১৭ এপ্রিল ২০১২,
ড. তারেক শামসুর রেহমান।
মার্কিন কর্মকর্তা জেমস শিয়ার যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যখন বলেন, ‘বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ ও বাইরের সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকিমুক্ত নয়’, তখন সরকারের পক্ষ থেকে এর একটা ব্যাখ্যা দাবি করা উচিত ছিল। কেননা প্রধানমন্ত্রী তো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নেই। এটাই হচ্ছে বাস্তব কথা। বর্তমান সরকারের শাসনামলে গেল তিন বছরে আমরা কোনো বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড লক্ষ করিনি। সন্ত্রাসীরা তেমনভাবে সংগঠিত হতে পারছে না। বিচ্ছিন্ন দুয়েকটি সংবাদ ছাপা হলেও তাদের তত্পরতা, সমাবেশ, লিফলেট বিতরণ কিংবা জমায়েতের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থেকেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে পুলিশ অবিশ্যি তত্পর হয়েছে। কিন্তু ওইসব নিষিদ্ধ ঘোষিত গ্রুপ কর্তৃক কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে আমরা দেখিনি। তাই ‘অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশ একটি ঝুঁকিমুক্ত দেশ’, তা নিঃসন্দেহে বলা যাবে না। বাইরের সন্ত্রাসী হামলা? এটাও তো আমাদের চোখে ধরা পড়েনি। কিছু ‘ভারতীয় সন্ত্রাসী’ বাংলাদেশে পালিয়ে ছিল। কিন্তু তাদের কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছিল না এ দেশে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের হস্তান্তরের ফলে ওই অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটেছে। এর বাইরে আল কায়দা কিংবা লস্কর-ই তৈয়বার মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের কোনো নেটওয়ার্ক বাংলাদেশে কাজ করছে বলেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আমাদের কখনও অবহিত করেনি। ফলে মার্কিন কর্মকর্তার বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। তার ওই বক্তব্যের উদ্দেশ্য কী-এ প্রশ্ন এখন উঠতেই পারে।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ সফর করতে ভালোবাসেন। তিনি জানিয়েছিলেন, খালাফ আল আলির মৃত্যুর ঘটনার প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে। কিন্তু এত দিন পার হওয়ার পরও সত্য বেরিয়ে আসেনি। তাতে কি আমাদের ভাবমূর্তি আদৌ উজ্জ্বল হয়েছে? বাংলাদেশি প্রায় ২০ লাখ (প্রকারান্তরে ৩০ লাখ) নাগরিক এখন সৌদিতে কর্মরত। তাদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। গত ৭ মার্চ রাতে একটি চ্যানেলে অংশ নিতে গিয়ে সৌদি আরব থেকে প্রবাসীরা ফোন করে তাদের আতঙ্কের কথা আমাদের জানিয়েছেন। এই আতঙ্কের খবরটি অত্যন্ত স্বাভাবিক। এমনিতেই বাংলাদেশ-সৌদি আরব সম্পর্ক খুব ভালো পর্যায়ে রয়েছে, এটা বলা সাজে না। গত ২০০৮ সাল থেকেই সৌদিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের নিয়োগ পরিপূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে। এটা আমাদের একটা কূটনৈতিক ব্যর্থতা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়নি কখনও। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের জনশক্তি বাজার যে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, আমাদের নীতিনির্ধারকরা তা আদৌ বিবেচনায় নেননি। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিদেশ সচিব পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই দিকটি বারবার এড়িয়ে গেছেন। অথচ সৌদি আরব বাংলাদেশকে বাইরে রেখে নেপালের মতো হিন্দুপ্রধান দেশ থেকে কর্মী সংগ্রহ করে আসছিল। শুধু তাই নয়, সংবিধানে ২৫ (২) ধারাটি সংযোজন করে আমরা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলাম। এটি ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি মূল নির্দেশনা। কিন্তু সংবিধান সংশোধনের ফলে সংবিধানের ওই ধারাটি এখন আর নেই। এতে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’তে যে প্রভাব পড়ছে তা অস্বীকার করা যাবে না। সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ককে এ প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা যেতে পারে। মোটা দাগে যেটা বলা যায়, তা হচ্ছে বাংলাদেশের নিজের স্বার্থেই উচিত ওই হত্যাকাণ্ডের মোটিভ খুঁজে বের করা এবং হত্যাকারীদের গ্রেফতার করা। প্রয়োজনে স্কটল্যান্ডইয়ার্ডের মতো বিশ্বসেরা আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহযোগিতাও নেওয়া যেতে পারে। দেশে এই মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। বিরোধী দল ১২ মার্চের কর্মসূচি পালন করে সরকার পতনের আন্দোলন ধীরে ধীরে শক্তিশালী করছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে অতিদ্রুত হত্যাকাণ্ডের মোটিভটি সুস্পষ্ট করা। এটি একটি স্পর্শকাতর হত্যাকাণ্ড। এর সঙ্গে আমাদের অনেক স্বার্থ জড়িত। একটি বিদেশি রাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে একটি সংবাদও কোনো কোনো সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। এরই প্রতিধ্বনি আমরা দেখতে পাই ষেড়নধষ ঞযত্বধঃ নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে গত ৯ মার্চ। সেখানেও মধ্যপ্রাচ্যের ওই রাষ্ট্রটির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এটা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে একটা চিন্তার কারণ। খুব দ্রুত আমরা যদি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে না পারি, তাহলে তা শুধু সৌদি আরবের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে না, বরং মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতেও এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। তাতে করে জনশক্তি রফতানিতে আরও ধস নামবে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমবে। আর মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত লাখ লাখ বাংলাদেশি কর্মী থাকবেন একধরনের নিরাপত্তাহীনতায়। আমাদের জন্য সত্যিকার অর্থেই তা কোনো ভালো সংবাদ নয়। এখন আরব নিউজ-এ প্রকাশিত সংবাদটির পর সরকার যদি দ্রুত খালাফ হত্যাকাণ্ডের মোটিভ উদঘাটন করতে পারে, তা আমাদের জন্য মঙ্গল।
দৈনিক সকালের খবর, ১৭ এপ্রিল ২০১২,
ড. তারেক শামসুর রেহমান।
0 comments:
Post a Comment