রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আতংক যেখানে নিত্যসঙ্গী

ভদ্রলোক নামটি বললেন না। ল্যান্ডফোনে জানালেন, সাবধানে থাকবেন। বেশি লেখালেখির দরকার নেই। এমন সব বিষয় নিয়ে লিখবেন, যেখানে রাজনীতির কোন গন্ধ না থাকে। আমার ল্যান্ডফোনে ‘কলার আইডি’ নেই। তাই জানার উপায় নেই কোন এক্সচেঞ্জ থেকে ফোনটি এসেছিল। গুরুত্ব দিলাম না ফোনের। ২১ জুলাই ক্যাম্পাসে গেছি। ভিসির পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষকরা ভিসির অফিস ঘেরাও করে রেখেছেন। সঙ্গত কারণেই সেখানে আমার যাওয়া ও সহকর্মীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করা। সেখানেও একইরকম সমস্যা স্যার, একটু সাবধানে লিখবেন। বলা তো যায় না, আপনিও ‘গুম’ হয়ে যেতে পারেন(?)। এবারও গুরুত্ব দিলাম না। আমি শিক্ষক। আমার শত্র“ কে? আমার তো কোন শত্র“ নেই। তৃতীয় ঘটনা একটি ফোন আমার মোবাইলে আসে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের অস্ট্রিন থেকে। ভদ্রলোক আমার পরিচিত। ঢাকায় এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন। আমার লেখার খুব ভালো ও বোদ্ধা পাঠক। সব ক্ষেত্রে আমার সঙ্গে একমত হন না। সালোচনাও করেন। তার অনুরোধ, আমি যেন ‘গুম’ নিয়ে কিছু না লিখি। তার একটা ভয়, একজন রাজনীতিবিদ যদি ‘গুম’ হয়ে যেতে পারেন, একজন শিক্ষকও ‘গুম’-এর শিকার হতে পারেন। সুতরাং সাবধান।

আমি একটা ধন্দে পড়ে গেলাম। রাজনীতি নিয়ে লিখি। রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা আমার কাজ। এটা আমার পেশা নয়। বরং বলা যেতে পারে অনেকটা ‘নেশা’। শিক্ষকরা সাধারণত সংবাদপত্রে লেখেন না। তারা গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করতেই উৎসাহী বেশি। কেউ কেউ কনসালটেন্সিও করেন, যা আমি ঘৃণা করি। কিন্তু মনে করি সাধারণ মানুষের কাছে খুব সহজ ভাষায় ‘সত্য’ প্রকাশ করার মাধ্যম হচ্ছে সংবাদপত্র। সেই আশির দশক থেকেই লিখছি। আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি অনেক অধ্যাপকের দ্বারা, যারা গবেষণা প্রবন্ধের পাশাপাশি নিয়মিত কলাম লিখে গেছেন অধ্যাপক ভবানী সেনগুপ্ত, অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি, অধ্যাপক রউবিনি, ফুকিয়ামা কত নামই তো উল্লেখ করা যায়। চেষ্টা করলাম বুঝতে অতীতে এ রকমটি কি হয়েছে কখনও? না, হয়নি। এভাবে ফোনে ঠিক হুমকি নয়, পরামর্শ। সহকর্মীদের অনুরোধ, একটু সাবধানে থাকবেন। আর শুভাকাক্সক্ষীদের ধারণা আমি রাজনীতির বিষয় নিয়ে না লিখলে ভালো করব। কোনটি করব আমি? আমি কি লিখব না?

ইলিয়াস আলী ‘হঠাৎ’ করেই ‘গুম’ হয়ে গেলেন। কে করল, কারা তাকে গুম করল? এ নিয়ে রাজনীতি এখন উত্তপ্ত। ২১ এপ্রিল রাতে ঢাকা শহরে সহিংস ঘটনা ঘটল। বাসে আগুন দেয়া হল। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেলেন একজন। হরতাল হল ২২-২৪ এপ্রিল। কিন্তু হরতাল দিয়ে কি ইলিয়াস আলীকে ‘উদ্ধার’ করা যাবে? অন্যদের কথায় নাইবা গেলাম। আবদুল জলিল সাহেবের একটা কথা উল্লেখ না করে পারছি না। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এই সদস্য বললেন, ‘ইলিয়াসকে খুঁজে বের করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব’। মিথ্যা বলেননি জলিল সাহেব। ইলিয়াস আলী সাধারণ একজন নাগরিক নন। সাবেক এমপি, সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। এমন কী ঘটেছিল, যাতে করে তিনি ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাবেন এবং আমরা কেউ তা জানব না? এ ক্ষেত্রে আমরা যারা লেখালেখি করি, আমরা কি লিখব না? অনেকেই জানেন, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বলে একটা কথা আছে। রাজনীতি বিজ্ঞানে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব¡ বহুল ব্যবহৃত। ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ রহস্যে কি আমরা এখন এই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ ব্যবহার করব? সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগ ও পুনরায় মন্ত্রিসভায় ফিরে আসার মধ্যে নাটকীয়তা এবং ৭০ লাখ টাকা উদ্ধারের ‘ঘটনার’ পেছনের কাহিনীর রহস্য উদঘাটনে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলেও এই ঘটনার সঙ্গে ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার কোন যোগসূত্র আছে কিনা, ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে’ যারা বিশ্বাস করেন, তারা এটা নিয়ে ‘গবেষণা’ করতে পারেন। সংবিধান সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।

যেখানে সংবিধানের ১১ নং অনুচ্ছেদে ‘মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা’ দেয়া হয়েছে, তৃতীয় ভাগের একাধিক অনুচ্ছেদে, বিশেষ করে ২৭, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৬, ৩৯ নং অনুচ্ছেদে সাধারণ একজন নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, সেখানে ‘একজন সাধারণ নাগরিক’ ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা সরকার উদঘাটন করতে পারবে, এ বিশ্বাস করতেই পারি। ইতিমধ্যে র‌্যাবের এক অভিযানে অংশ নিয়েছেন মিসেস ইলিয়াস গত ২১ এপ্রিল। আমার ধারণা, ইলিয়াসের উদ্ধার এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমরা আশাবাদী। আশা আমরা করতেই পারি।
আমি আগেই উল্লেখ করেছি, ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে’ আমি যাব না। আমরা অনেকেই বলি, বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনার দেশ। গত ফেব্র“য়ারির শেষের দিকে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলাম তুরস্কে। ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ২৬টি দেশের প্রতিনিধিরা, যারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। একাধিক শিক্ষক আমাকে বলেছেন, বাংলাদেশের সম্ভাবনা আছে। প্রয়োজন সঠিক ও যোগ্য নেতৃত্বের। এখানেই এসে যায় প্রশ্নটিÑ আমরা কি সঠিক নীতিটি গ্রহণ করতে পেরেছি? ২০২১ সালে বাংলাদেশের বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৫০ বছর। ৪১ বছরে পা দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? যৌথভাবেই পরিকল্পনা নেয়া দরকার। এরই নাম গণতন্ত্র। অর্থনীতি একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে একটি এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বিশ্বমন্দায় আমরা আক্রান্ত নই, এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তৈরি পোশাকের রফতানি কমেছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহও কম। যেখানে ইউরোপজুড়ে কৃচ্ছ সাধন চলছে (গ্রিস এর বড় উদাহরণ), সেখানে আমাদের রাজস্ব ব্যয় বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে আর তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ, যারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিনির্মাণে পালন করছেন গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা। এরাই ভোট দিয়ে ‘প্রিয় দলকে’ ক্ষমতায় পাঠায়। বিদ্যুৎ সংকট অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। এই যখন দেশের পরিস্থিতি, তখন সরকার ও বিরোধী দল পরস্পর বিরোধী একটি অবস্থান গ্রহণ করেছে। প্রায় প্রতিটি ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলের অবস্থান পরস্পর বিরোধী।

ইলিয়াস আলীর ‘নিখোঁজ’ হওয়ার ব্যাপারেও এই পরস্পর বিরোধী অবস্থান আমরা লক্ষ্য করি। যেখানে সরকার বলছে ‘এটা সাজানো নাটক’, সেখানে বিরোধী দল বিএনপি বলছে ‘এটা সরকারের কাজ’। আর মাঝখানে আমরা আমজনতা থাকি এক অনিশ্চয়তায়। যে কোন বিবেচনায় এটা কোন ভালো খবর নয়। বিএনপির হাইকমাণ্ড যখন তাদের নেতাদের সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরার নির্দেশ দেন, তখন আতংকের বিষয়টিকে আরও উস্কে দেয়া হয়। সংবাদপত্র থেকে জানলাম, ব্রিটেনের রক্ষণশীল দলের এমপি রিচার্ড ফুলার ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ইলিয়াস আলীর ‘গুম’ হওয়ার ঘটনাটি উত্থাপন করেছেন। এটা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য কোন ভালো খবর নয়। এতে করে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়াল? রাষ্ট্র যদি একজন সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, আন্তর্জাতিক আসরে সেই রাষ্ট্রের মর্যাদা নষ্ট হয় বৈকি। এমনিতেই দুর্নীতিতে আমাদের সব অর্জন ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। গত ৪০ বছরে আমাদের অর্জন একেবারে কম নয়। কিন্তু সেই অর্জনগুলো একে একে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি আমরা নির্মূল করতে পারছি না। আর এখন যদি এই ‘গুম’-এর প্রবণতা আমরা রোধ করতে না পারি, তাহলে আগামী দিনগুলোতে আমাদের জন্য কোন ভালো খবর অপেক্ষা করছে না। প্রায় ১৬ কোটি লোকের দেশ এই বাংলাদেশ।

এ দেশে রয়েছে একটি শক্তিশালী তরুণ প্রজš§। এরাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। এরাই বাংলাদেশকে বদলে দিতে পারে। এদের দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই তরুণ প্রজš§কে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। রাজনীতির ‘নোংরা গলিতে’ আমাদের রাজনীতিবিদরা হাতড়ে ফিরছেন। কোন পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। এ যেন এক ‘কৃষ্ণ গহ্বর’, যার কোন শেষ নেই।

আমি তো সাধারণ মানুষেরই একজন। আতংক যে আমার মনে বাসা বাঁধেনি, তা দিব্যি বলতে পারব না। একজন রাজনীতিবিদ ইলিয়াস আলী যদি নিখোঁজ হয়ে যান, তখন আমার মতো একজন শিক্ষক যে নিখোঁজ হয়ে যাবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে? ‘গুমকারীদের’ হাত কি এতটা লম্বা যে তা ছুঁতে পারে না আমাদের প্রশাসনের যন্ত্র! আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা দেয়ালের লিখন থেকে কেউ কিছু শিখিনি, এখনও শিখছি না। ‘গুম’ নিয়ে যে আতংক, সেই আতংকের অবসান হওয়াই মঙ্গল।

ড. তারেক শামসুর রেহমান 
প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
(সূত্র: যুগান্তর,২৬/০৪/১২)

2 comments:

  1. স্যার, সবাই যদি মুখ বুজে থাকে তাহলে এ দেশটার কি হবে। তাই কথা অবশ্যই বলতে হবে, লিখে জানাতে হবে, বোঝাতে হবে সাধারণ মানুষকে। তবেই তো অন্যায় কমবে।

    ReplyDelete
  2. Thank you Shapla. But it is very difficult, very very difficult.
    TSR

    ReplyDelete