একজন পেনশনভোগীর আত্মহত্যার ঘটনার মধ্য দিয়ে গ্রিস যে এখনো অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে কথাটাই প্রমাণিত হল। এতে করে একক মুদ্রা ইউরো নিয়ে যেমনি প্রশ্ন উঠেছে, ঠিক তেমনি প্রশ্ন উঠেছে ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এখন অভিন্ন ইউরোপের ধারণাটি কল্পনাতেই থেকে যেতে পারে। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিন্ন ইউরোপের ধারণাটি কোনো অমূলক ধারণা ছিল না। বরং ১৯৫৭ সালে ইউরোপিয়ান কমিউনিটি সৃষ্টির পর ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বাক্ষরিত ম্যাসট্রিচট চুক্তি ছিল অভিন্ন ইউরোপ গঠনের লক্ষ্যে একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ। ম্যাসট্রিচট চুক্তিতে একটি একক মুদ্রা ও একটি ইউরোপীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে সেভেন চুক্তি ও ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি ইউরোপের একক মুদ্রা ইউরো চালুর সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে অভিন্ন এক ইউরোপের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল ইউরোপ। বলা ভালো, ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর ইউরোপীয় কমিউনিটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নাম ধারণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতিমধ্যে সম্প্রসারণ ঘটেছে। পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের পর ২০০৪ ও ২০০৭ সালে বেশ কটি পূর্ব ইউরোপের দেশ ইইউতে যোগ দিয়েছে। ইইউর সদস্য সংখ্যা এখন ২৭। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন ইইউর ১৫টি দেশের মাঝে ১১টি দেশ ইউরো চালু করেছিল। এখন চালু রয়েছে ১৭টি দেশে। ইউরো চালু হওয়ার সময়ই ইউরো নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তখন বলা হয়েছিল ইউরোপের উত্তরের ধনী দেশগুলো ইউরো চালু হলে এ থেকে সুবিধা নিতে পারে। আজ এত বছর পর এই আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হল। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে ইউরো চালু হওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও, তিন বছর পর্যন্ত নিজ নিজ দেশের মুদ্রা চালু থাকে এবং ২০০২ সালের জুলাই মাসে ইউরোর কাগজি ও ধাতব মুদ্রা চালু হওয়ার পর পুরনো মুদ্রা বাতিল হয়ে যায়। গত নয় বছর ইউরো নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা না দিলেও, গেল বছরের প্রথম দিকে ইইউর কয়েকটি দেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। দেশগুলো ঋণ শোধ করতে না পেরে অনেকটা দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে পাপেন্দ্রুর নেতৃত্বাধীন গ্রিস সরকারের পতন হয়েছে এবং পাপাদেসস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। একইসঙ্গে ইতালির প্রধানমন্ত্রী বারলুসকোনিও পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
পাপেন্দ্রু ও বারলুসকোনির পরিণতি প্রমাণ করে ইউরোপ এখনো বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকারগুলো প্রচুর ঋণ গ্রহণ করেও সেই ঋণ শোধ করতে পারছে না। ধীরে ধীরে রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে পড়ছে। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন অর্থনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করলেও, সেই দেউলিয়াত্ব রোধ করতে পারছে না। গ্রিস কিংবা ইতালি কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের কথা ঘোষণা করলেও, সাধারণ জনগণ তার বিরোধিতা করছে। তারা দিনের পর দিন বিক্ষোভ মিছিল করছে। গ্রিসের পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি বিখ্যাত দৈনিক গার্ডিয়ানের অনলাইন ভার্সনে যে ছবিটি ছাপা হয়েছে, তা দেখে দেশটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, গ্রিসের একটি শহর থেসসালোনিকির গির্জার পাশে বসে এক মধ্যবয়সী রমণী ভিক্ষা করছেন। রাষ্ট্র এই রমণীর দায়িত্ব নিতে পারছে না। ফলে তাকে ভিক্ষা করে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের গপপষধঃপযু হবংি-এর অনলাইন ভার্সন যারা দেখেছেন সেখানেও রয়েছে গ্রিসের ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর একটি প্রতিবেদন। প্রতিবেদনটি শুরু হয়েছে পেরামা জাহাজ নির্মাণ বন্দরের একটি বিবরণ দিয়ে। পেরামা বন্দর এখন জনমানবশূন্য, কোনো কর্মচাঞ্চল্য নেই, একরকম পরিত্যক্ত। গ্রিসে বেকারত্বের হার এখন শতকরা ৬০ ভাগ। সেখানে এখন কৃচ্ছ্রসাধন চলছে। আইএমএফের ঋণের শর্ত হিসেবে সরকারি কর্মচারীদের বেতন কমানো হয়েছে। পেনশন হ্রাস করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা এখন বন্ধ। সরকারি গড় বেতন কমিয়ে আনা হয়েছে মাসিক ৮৬০ ডলারে, আর বেসরকারি সেক্টরে গড় বেতন মাসে ৭৫০ থেকে ১০০০ ডলার। আর বিশ্বব্যাংক বলছে বেতন কমাতে হবে ৬০০ ডলারে। এক সময় হাসপাতালগুলোতে বিনে পয়সায় ওষুধ পাওয়া যেত। এখন তা পুরোপুরি বন্ধ। প্রবাসী গ্রিকদের আর্থিক সহযোগিতায় উড়পঃড়ৎং ড়ভ ঃযব ডড়ৎষফ নামে একটি এনজিও এখন বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করছে। আগে এরা মাত্র ৩ দিন (সপ্তাহে) ওষুধ সরবরাহ করত। এখন তাদের ৭ দিনই ওষুধ দিতে হয়। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে যারা ওষুধ নেন, তাদের অনেকেই কিছুদিন আগে পর্যন্ত সচ্ছলভাবে দিন যাপন করতেন। এখন আয় কমে যাওয়ায় তারা স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না। গপপষধঃপযু্থর প্রতিবেদনে একজন প্রত্নতাত্তি্বক মিসেস ডেলপিনা কউটিসউম্বার ছবি ও বক্তব্য ছাপা হয়েছে। ডেলপিনা আগে মাসে বেতন পেতেন ১১৯০ ডলারের সমতুল্য। এখন তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৬৬০ ডলারে। অথচ তাকে বাসা ভাড়া দিতে হয় ৭৩০ ডলার। অধ্যাপক স্বামী ও এক সন্তান নিয়ে তার দিন আর চলছে না। ঋণের শর্ত হিসেবে দেশটির সরকারি লোকবল ১ লাখ ৫০ হাজার কমিয়ে মোট ৪ লাখ ৫০ হাজার নামিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। অর্থনীতি ঠিকমতো চলছে না। এখন দেশটিকে ঋণ নিয়েই ঋণের সুদের টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। গ্রিসকে তার বাজেটের শতকরা ২০ ভাগ ব্যয় করতে হয় ঋণ পরিশোধে। গ্রিসের এই অর্থনৈতিক সংকট খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্বকে একটি ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাঠামো ভেঙে যেতে পারে, এমন আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি শক্তি। অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ইইউ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ইউরো জোনের অর্থনৈতিক সংকট ইইউর ভূমিকাকে সংকুচিত করে দিয়েছে। এখানে বলা ভালো, ১৯৫৭ সালে মাত্র ৬টি দেশ নিয়ে (বেলজিয়াম, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, হল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ) ইউরোপীয় ঐক্যের যে যাত্রা শুরু হরেছিল, তা আজ পরিণত হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ)। ২৭টি দেশ এখন ইইউর সদস্য। এর মাঝে আবার ২৪টি দেশ ন্যাটোর সদস্য।
ইউরোপে এরই মাঝে বেশ কয়েকটি সংস্থার জন্ম হয়েছে, যে সংস্থাগুলো ইউরোপীয় ঐক্যকে ধরে রেখেছে। যেমন বলা যেতে পারে_ ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ইউরোপীয় কাউন্সিল, ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় আদালত, নিরীক্ষক দফতর, অর্থনেতিক ও সামাজিক কমিটি, আঞ্চলিক কমিটি, ইউরোপীয় ব্যাংক ও ইউরোপীয় মুদ্রা ইনস্টিটিউট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা। এই সংস্থাগুলো অভিন্ন ইউরোপের ধারণাকে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা পুরো দৃশ্যপটকে এখন বদলে দিল। এখন শুধু ইউরোপই নয়, বরং সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে। যে যুক্তি তুলে এক সময় ব্রিটেন ও ডেনমার্ক ইউরো জোন (এক মুদ্রা নিজ দেশে চালু) যোগ দিতে চায়নি, সেই যুক্তিটি এখন সত্য বলে প্রমাণিত হল। অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধারের কাজটি অত সহজ নয়। একটি দেশের সমস্যায় অন্য দেশ আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ইউরোর ভবিষ্যৎ নিয়ে। এখানে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড় তা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান কাঠামো আদৌ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কিনা?
২০০৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন তার পশ্চাশতম পূর্তি উৎসব পালন করে তখনই বার্লিন ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে ইইউর মাঝে বিভক্তি আছে। লুক্সেমবার্গ ইউরোপের অন্যতম প্রধান অর্জন হিসেবে ইউরোর মুদ্রার কথা উল্লেখ করেছিল। অথচ মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হল ইউরো সব দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। ব্রিটেন ও ডেনমার্ক প্রথম থেকেই ইউরোকে প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। পোল্যান্ড ও ইতালি চেয়েছিল ইউরোপের ক্রিশ্চিয়ান মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে। কিন্তু ফ্রান্স এর বিরোধিতা করেছিল। দেশটি ধর্মকে আলাদা রাখতে চেয়েছিল। চেক রিপাবলিক ও পোল্যান্ড নিরাপত্তার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিলেও, ফ্রান্স ও জার্মানি এটা নিয়ে চিন্তিত ছিল এ কারণে যে, নিরাপত্তার বিষয়টিতে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাশিয়াকে খেপিয়ে তুলতে পারে। জার্মানি ও স্পেন ইইউর জন্য নতুন একটি সাংবিধানিক চুক্তি করতে চাইলেও, ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডস ছিল এর বিরোধী। পূর্ব ইউরোপের সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৮৯ সালের 'ভেলভেট রেভ্যুলেশন' এই দেশগুলোকে সোভিয়েত নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে। সেখানে সমাজতন্ত্রের পতন হয় এবং দেশগুলো গণতন্ত্রের পথে ধাবিত হয়। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে পারেনি। এই দেশগুলোর ওপর কোপেনহেগেন ফর্মুলা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কোপেনহেগেন ফর্মুলায় কতগুলো শর্ত দেওয়া হয়েছিল, যা পূরণ করলেই ইইউর সদস্যপদ পাওয়া যাবে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল_ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু, মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তন, মানবাধিকার রক্ষা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাদান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এসব শর্ত পূরণ হওয়ার পরই কয়েকটি পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ২০০৪ ও ২০০৭ সালে ইইউতে যোগ দেয়। বসনিয়া-হারজেগোভিনা কিংবা ক্রয়েশিয়া এখনো ইইউতে যোগ দিতে পারেনি। এখন অর্থনৈতিক সংকট সব সংকটকে ছাপিয়ে গেছে। ঋণ সংকটে জর্জরিত ইউরোপে আবারো মন্দার আশঙ্কা বাড়ছে। এখন ইইউর ঐক্য নিয়ে যে সন্দেহ, তা আরো বাড়বে। ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে দুই স্তরে বিভক্ত করার প্রস্তাব উঠেছে। জার্মানি ও ফ্রান্স একটি দুই স্তরবিশিষ্ট ইউরোপীয় ইউনিয়ন চাচ্ছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সারকোজি খোলামেলাভাবেই এ বিভক্তির কথা বলছেন। জার্মানির চ্যান্সেলর মরকেলও চাচ্ছেন একটা পরিবর্তন। তিনি বলছেন এক নয়া ইউরোপ গড়ার কথা। যদিও এই বিভক্তির বিরোধিতা করছেন ইউরোপীয় কমিশনের চেয়ারম্যান জোসে ম্যানুয়েল হারোসো। এখন সত্যি সত্যিই ইউরোপ ভাগ হয়ে যাবে কি না কিংবা 'নতুন ইউরোপ'-এর স্বরূপ কী হবে, তা এ মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। তবে একটি পরিবর্তন যে আসন্ন, তা গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। এটাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় ব্যর্থতা।
দৈনিক ডেসটিনি ২৫ এপ্রিল ২০১২।
0 comments:
Post a Comment