গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ৪১ বছর আমরা পার করেছি। কিন্তু এই ৪১ বছরে আমাদের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হয়েছে? সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বিরোধীদলের নেতাকে শ্রদ্ধা জানাতে বাধা দান, কিংবা শহীদ জিয়াউর রহমানের ওপর পাঁচটি গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচনে বাধাদান ইত্যাদি প্রমাণ করে যে আদর্শ নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলাম, সেই আদর্শ থেকে আমরা অনেক দূরে সরে গেছি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যে ন্যায়বিচারভিত্তিক গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল, ক্ষমতাসীন সরকারের আচরণ প্রমাণ করে তারা এই আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন। তারা ধীরে ধীরে একদলীয় শাসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। যে কারণে অধ্যাপক রওনক জাহানের মতো পণ্ডিত ব্যক্তিও বলতে বাধ্য হয়েছেন ‘এ দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ খুব একটা সুপ্রসন্ন নয়’। (একটি সেমিনারে দেয়া বক্তব্যে ২৭ মার্চ)। অধ্যাপক রওনক জাহানকে ধন্যবাদ দিতেই হয়।
গণতন্ত্র, সুশীল সমাজ নিয়ে এ দেশে যে ক’জন পণ্ডিত কাজ করেছেন, তিনি তার অন্যতম। তিনি বলেছেন, সরকারি প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের রাজনীতিকরণ ও বিভক্তিকরণ এখনও বিদ্যমান। বিচার বিভাগ দলীয় রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। সরকারের কিছু কিছু বক্তব্য থেকে বিচার বহির্ভূত হত্যাকে বৈধ করার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। উপরন্তু ছাত্রলীগের সহিংস কার্যকলাপের ধারাবাহিকতা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকারের গৃহীত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ প্রত্যক্ষ নয়। স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও একজন শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিতের মুখ থেকে যখন এ ধরনের কথা বের হয়, তখন আমাদের বুঝতে কারো বাকি থাকে না যে, দেশটি সঠিক পথে চলছে না। যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য মানুষ প্রাণ দিয়েছে বারে বারে সেই গণতন্ত্র থেকে আমরা এখনও অনেক দূরে।
গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করার জন্য আমরা দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলাম। গত একচল্লিশ বছরে ১৫ বার সংবিধান আমরা সংশোধন করেছি। সংবিধান সংশোধন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সংবিধান সংশোধন করা হয়। আমরাও করেছি। কিন্তু তাতে করে জনগণের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে কী? যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আমরা হরতাল পর্যন্ত করেছিলাম এবং যা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মাঝে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল, মাত্র ১৫ বছরের মধ্যে এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন তিনটি জাতীয় নির্বাচনের পরও আবার তা সংসদে বাতিল হলো। কিন্তু কার স্বার্থে? গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কোনো বিধান থাকতে পারে না এটা সত্য। সেইসাথে এটাও সত্য পৃথিবীর সব দেশে একই নিয়মে গণতন্ত্র বিকশিত হয় না।
গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করার জন্য আমরা দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলাম। গত একচল্লিশ বছরে ১৫ বার সংবিধান আমরা সংশোধন করেছি। সংবিধান সংশোধন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সংবিধান সংশোধন করা হয়। আমরাও করেছি। কিন্তু তাতে করে জনগণের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে কী? যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আমরা হরতাল পর্যন্ত করেছিলাম এবং যা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মাঝে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল, মাত্র ১৫ বছরের মধ্যে এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন তিনটি জাতীয় নির্বাচনের পরও আবার তা সংসদে বাতিল হলো। কিন্তু কার স্বার্থে? গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কোনো বিধান থাকতে পারে না এটা সত্য। সেইসাথে এটাও সত্য পৃথিবীর সব দেশে একই নিয়মে গণতন্ত্র বিকশিত হয় না।
মিল খোঁজাটা অর্থহীন। আজকে রাশিয়ার বিকাশমান গণতন্ত্রের সাথে ইউরোপের, জার্মানির বা ফ্রান্সের গণতন্ত্রকে মেলানো যাবে না। অথচ রাশিয়া, ইউরোপীয় সংস্কৃতিরই ধারক। আজকে ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যখন অখিলেস যাদব শপথ নেন, তিনি পরিবারতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করেন বটে, কিন্তু এটাই ভারতীয় গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। উচ্চ শিক্ষিত অখিলেস ভারতীয় রাজনীতির তরুণ প্রজন্ম। এই তরুণ প্রজন্ম উচ্চ শিক্ষিত, আধুনিক মনস্ক, এরাই ভারতকে নতুন এক যুগে টেনে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশে যদি এই পরিবারতন্ত্রের ছায়া পড়ে, তাতে ক্ষতি কী? আমাদের দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। উচ্চ শিক্ষিত একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরি হয়েছে, যারা আধুনিক মনস্ক। এরা রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে পারেন।
গত চল্লিশ বছরে আমরা অনেক এগিয়েছি। এ যাবতকাল নয়টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যদিও তার তিনটির (১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯৬) কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। আমরা সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী (১৯৯১) এনে সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে গিয়েছিলাম। সেই সংশোধনীর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ছিল, আজো আছে। কিন্তু যা হয়নি, তা হচ্ছে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। আমরা সংসদীয় রাজনীতি চেয়েছি বটে, কিন্তু চেয়েছি নিজের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে ও দলীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখার স্বার্থে। বিরোধী দলও যে সরকারের একটি অংশ, এ কথাটা আমরা ভুলে গেছি। সংসদীয় রাজনীতিতে ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ বা পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখার যে কথা বলা হয়, তা আমরা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নিইনি। সর্বশেষ ঘটনায় ২৬ মার্চের বেগম জিয়ার সাভারে যাওয়াকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছিল, তা ছিল অনাকাক্সিক্ষত। এর আগে ঢাকা শহরকে অবরুদ্ধ করে, সাধারণ মানুষের জন্য জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে, বিরোধীদলের সমাবেশে সীমাবদ্ধতা আরোপ করে যে ‘গণতন্ত্র’ আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছি, তাতে আর যাইহোক প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। গত ১২ মার্চকে ঘিরে যে অস্থিরতা ও অবিশ্বাসের জন্ম হয়েছিল তা ছিল দ্বাদশ সংশোধনীর স্পিরিটের পরিপন্থি, গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পথে তা অন্তরায়। এখানে প্রয়োজন ছিল সমঝোতার। প্রয়োজন ছিল আন্তরিকতা। সেটি দেখা যায়নি। বরং পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে এক চরম অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছিল। আগামী ১০ জুনের ডেডলাইন আদৌ কোনো সমাধান বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। পরস্পর বিরোধী এই অবস্থান আমাদের আবারো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ‘ওয়ান-ইলেভেন’ এর কথা।
আমরা গণতন্ত্র চেয়েছি। কিন্তু শুধু একটি নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এ জন্য দরকার মানসিকতা পরিবর্তনের, যা আওয়ামী লীগের রাজনীতি দুঃখজনকভাবে অনুপস্থিত। গণতন্ত্রের মূল জায়গাটা হচ্ছে সংসদ, যেখানে আলোচনা হবে, সমালোচনা হবে এবং জাতীয় স্বার্থে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। কিন্তু সেই সংসদকে আমরা অকার্যকর করছি। সংসদ বয়কট একটা ‘কালচারে’ পরিণত হয়েছে। এই ধারা শুরু হয়েছিল পঞ্চম সংসদ থেকে, যেখান থেকে আমরা গণতন্ত্রের পথে চলতে শুরু করেছিলাম। জনগণের কথা বলার জন্যই সংসদ। হাজার হাজার টাকা প্রতি মিনিটে খরচ হয় সংসদ পরিচালনা করতে। এখন সংসদ চলছে একদলীয়ভাবে, সিদ্ধান্ত হচ্ছে একদলীয়ভাবে, জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত কোনো সিদ্ধান্তই সংসদে আলোচিত হচ্ছে না। কোনো কোনো ইস্যুতে জাতি থাকছে এক মহাঅন্ধকারে। সংসদে একটা ডিবেট চাই, কিন্তু যেভাবে সংসদে অসংলগ্ন কথা বলা হয়, জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করা হয়, কিংবা কালো পতাকা প্রদর্শন করা হয়, তার নাম আর যাই হোক সংসদীয় রাজনীতি হতে পারে না।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ আমরা চাচ্ছি বটে, কিন্তু এককভাবে তো এই বাংলাদেশ গড়া যাবে না? ২০২১ সালে বাংলাদেশের বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৫০ বছর। ৪১ বছরে পা দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? যৌথভাবেই তো পরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন। এরই নাম গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র অনুপস্থিত বাংলাদেশে। অর্থনীতি একটি সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। বিশ্ব মন্দায় আমরা আক্রান্ত। প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ ভাগ হবে কী না, তার নিশ্চয়তা নেই। যেখানে ইউরোপে কৃচ্ছ্রসাধন চলছে (গ্রিস আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত), সেখানে আমাদের রাজস্ব ব্যয় বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মধ্যবিত্ত ও গরিব শ্রেণী। অথচ এরাই গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক। এরাই ভোট দিয়ে ‘প্রিয় দলকে’ ক্ষমতায় বসায়। বিদ্যুৎ সংকট অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে এরই মাঝে জটিল করেছে। শিল্প ও কৃষিখাতে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল, তা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এ থেকে উত্তরণের যে পথ (সকলে মিলে সমাধানের পথ খোঁজা), সে পথে আমরা হাঁটছি না। আমরা তো এগুতে চাই। কিন্তু এগুবো কীভাবে? জাতীয় ইস্যুতে আমরা এখনও বিভক্ত। এই বিভক্তি জাতি গঠনে প্রধান অন্তরায়। সংসদীয় রাজনীতি প্রধান্য পেয়েছে, কিন্তু দলীয় কর্তৃত্ব এখানে সর্বগ্রাসী। পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতা আমাদের ‘বড় অর্জনকে’ ম্লান করে দিয়েছে। বাস্তবতাই হচ্ছে বিরোধীদল জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩৭ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে (৯ম সংসদ)। বিরোধীদলকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্র বিনির্মাণ অর্থহীন। বাংলাদেশের গত ৪১ বছরের রাজনীতিতে রাজনীতিবিদরা পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রেখে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আমাদের উপহার দিতে পারেননি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার সুযোগ নিতে পারে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো।
গত চল্লিশ বছরে আমরা অনেক এগিয়েছি। এ যাবতকাল নয়টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যদিও তার তিনটির (১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯৬) কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। আমরা সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী (১৯৯১) এনে সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে গিয়েছিলাম। সেই সংশোধনীর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ছিল, আজো আছে। কিন্তু যা হয়নি, তা হচ্ছে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। আমরা সংসদীয় রাজনীতি চেয়েছি বটে, কিন্তু চেয়েছি নিজের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে ও দলীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখার স্বার্থে। বিরোধী দলও যে সরকারের একটি অংশ, এ কথাটা আমরা ভুলে গেছি। সংসদীয় রাজনীতিতে ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ বা পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখার যে কথা বলা হয়, তা আমরা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নিইনি। সর্বশেষ ঘটনায় ২৬ মার্চের বেগম জিয়ার সাভারে যাওয়াকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছিল, তা ছিল অনাকাক্সিক্ষত। এর আগে ঢাকা শহরকে অবরুদ্ধ করে, সাধারণ মানুষের জন্য জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে, বিরোধীদলের সমাবেশে সীমাবদ্ধতা আরোপ করে যে ‘গণতন্ত্র’ আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছি, তাতে আর যাইহোক প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। গত ১২ মার্চকে ঘিরে যে অস্থিরতা ও অবিশ্বাসের জন্ম হয়েছিল তা ছিল দ্বাদশ সংশোধনীর স্পিরিটের পরিপন্থি, গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পথে তা অন্তরায়। এখানে প্রয়োজন ছিল সমঝোতার। প্রয়োজন ছিল আন্তরিকতা। সেটি দেখা যায়নি। বরং পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে এক চরম অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছিল। আগামী ১০ জুনের ডেডলাইন আদৌ কোনো সমাধান বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। পরস্পর বিরোধী এই অবস্থান আমাদের আবারো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ‘ওয়ান-ইলেভেন’ এর কথা।
আমরা গণতন্ত্র চেয়েছি। কিন্তু শুধু একটি নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এ জন্য দরকার মানসিকতা পরিবর্তনের, যা আওয়ামী লীগের রাজনীতি দুঃখজনকভাবে অনুপস্থিত। গণতন্ত্রের মূল জায়গাটা হচ্ছে সংসদ, যেখানে আলোচনা হবে, সমালোচনা হবে এবং জাতীয় স্বার্থে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। কিন্তু সেই সংসদকে আমরা অকার্যকর করছি। সংসদ বয়কট একটা ‘কালচারে’ পরিণত হয়েছে। এই ধারা শুরু হয়েছিল পঞ্চম সংসদ থেকে, যেখান থেকে আমরা গণতন্ত্রের পথে চলতে শুরু করেছিলাম। জনগণের কথা বলার জন্যই সংসদ। হাজার হাজার টাকা প্রতি মিনিটে খরচ হয় সংসদ পরিচালনা করতে। এখন সংসদ চলছে একদলীয়ভাবে, সিদ্ধান্ত হচ্ছে একদলীয়ভাবে, জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত কোনো সিদ্ধান্তই সংসদে আলোচিত হচ্ছে না। কোনো কোনো ইস্যুতে জাতি থাকছে এক মহাঅন্ধকারে। সংসদে একটা ডিবেট চাই, কিন্তু যেভাবে সংসদে অসংলগ্ন কথা বলা হয়, জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করা হয়, কিংবা কালো পতাকা প্রদর্শন করা হয়, তার নাম আর যাই হোক সংসদীয় রাজনীতি হতে পারে না।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ আমরা চাচ্ছি বটে, কিন্তু এককভাবে তো এই বাংলাদেশ গড়া যাবে না? ২০২১ সালে বাংলাদেশের বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৫০ বছর। ৪১ বছরে পা দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? যৌথভাবেই তো পরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন। এরই নাম গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র অনুপস্থিত বাংলাদেশে। অর্থনীতি একটি সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। বিশ্ব মন্দায় আমরা আক্রান্ত। প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ ভাগ হবে কী না, তার নিশ্চয়তা নেই। যেখানে ইউরোপে কৃচ্ছ্রসাধন চলছে (গ্রিস আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত), সেখানে আমাদের রাজস্ব ব্যয় বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মধ্যবিত্ত ও গরিব শ্রেণী। অথচ এরাই গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক। এরাই ভোট দিয়ে ‘প্রিয় দলকে’ ক্ষমতায় বসায়। বিদ্যুৎ সংকট অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে এরই মাঝে জটিল করেছে। শিল্প ও কৃষিখাতে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল, তা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এ থেকে উত্তরণের যে পথ (সকলে মিলে সমাধানের পথ খোঁজা), সে পথে আমরা হাঁটছি না। আমরা তো এগুতে চাই। কিন্তু এগুবো কীভাবে? জাতীয় ইস্যুতে আমরা এখনও বিভক্ত। এই বিভক্তি জাতি গঠনে প্রধান অন্তরায়। সংসদীয় রাজনীতি প্রধান্য পেয়েছে, কিন্তু দলীয় কর্তৃত্ব এখানে সর্বগ্রাসী। পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতা আমাদের ‘বড় অর্জনকে’ ম্লান করে দিয়েছে। বাস্তবতাই হচ্ছে বিরোধীদল জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩৭ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে (৯ম সংসদ)। বিরোধীদলকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্র বিনির্মাণ অর্থহীন। বাংলাদেশের গত ৪১ বছরের রাজনীতিতে রাজনীতিবিদরা পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রেখে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আমাদের উপহার দিতে পারেননি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার সুযোগ নিতে পারে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো।
0 comments:
Post a Comment