রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

একটি সিদ্ধান্ত ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন


বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে সামনে রেখে তাই কয়লানীতি দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। মনে রাখতে হবে বিদ্যুৎ নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে। বিরোধী দল এটাকেও ইস্যু করতে পারে। তাই একটি সুষ্ঠু নীতিমালার আওতায় কয়লা উত্তোলনের প্রক্রিয়া যদি আমরা শুরু করি, আমার বিশ্বাস বিদ্যুতের অনেক চাহিদা আমরা পূরণ করতে পারব। ইতোমধ্যে কয়লানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মতামতও দিয়েছেন। ২০০৭ সালের ১১ জুন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুয়েটের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোমিন পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটি ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি সরকারের কাছে তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। তাতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন রপ্তানির সুযোগ না রাখা দেশের চাহিদা পূরণের জন্য ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তার নিশ্চয়তার বিধান রাখা হয়েছিল।ড. তারেক শামসুর রেহমান বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। তাদের মতে দেশে প্রচুর কয়লা মজুদ আছে। এ কয়লা উত্তোলন করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজে লাগাতে হবে। গ্যাসের ওপর চাপ কমাতে হবে। স্থায়ী কমিটির এই সিদ্ধান্তটি ছাপা হয়েছে দৈনিক যুগান্তরে গত ২২ মার্চ। বিদ্যুতের বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে করে স্থায়ী কমিটির ওই সিদ্ধান্তটি যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। গ্যাস সঙ্কটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে না। বর্তমানে সারাদেশে গ্যাসের চাহিদা প্রতিদিন আড়াইশ কোটি ঘনফুট। অথচ সরবরাহ করা হচ্ছে ২০৬ কোটি ঘনফুট। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই কয়লা নিয়ে ভাবনাটা জরুরি। বিদ্যুৎ আমাদের প্রয়োজন। সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় এখন বিদ্যুৎ শীর্ষে থাকা উচিত। গ্যাসের রিজার্ভ ফুরিয়ে আসছে এবং নতুন নতুন গ্যাস ক্ষেত্রও আবিষ্কৃত হচ্ছে না। সুতরাং গ্যাসনির্ভর যে বিদ্যুৎকেন্দ্র, তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাই ভরসা এখন কয়লা। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৫টি কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্বিলিত মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন, যা ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য (উত্তোলনযোগ্য ২০ টিসিএফ ১)। এতে ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি চাহিদা পূরণ সক্ষম। উত্তরাঞ্চলের বড়পুকুরিয়া ছাড়াও জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে কয়লা পাওয়া গেছে। কিন্তু সেই কয়লা উত্তোলনের ব্যবস্থা না করে সরকার ভারত থেকে কয়লা আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশনের সাথে পিডিপির একটি চুক্তি সাম্প্রতি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভারতীয় কয়লায় চট্টগ্রাম ও খুলনায় দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশের কয়লা দিয়েই আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি চালাতে পারতাম। আমাদের নিম্নমানের ভারতীয় কয়লার প্রয়োজন হতো না। বাংলাদেশ থেকে ৫টি কয়লাখনি আবিষ্কৃৃত হয়েছে। (মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়নটন), যা ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য (উত্তোলনযোগ্য ২০ টিসিএফ) বড় পুকুরিয়া ছাড়াও জামালগঞ্জে ৭টি কয়লাস্তর আবিষ্কৃত হয়েছে। কয়লা এলাকার বিস্তৃতি প্রায় ১২ বর্গ কিলোমিটার এবং মোট আনুমানিক মজুদের পরিমাণ ১০৫৩ মিলিয়ন টন এখানে কয়লা স্তরের গভীরতা বেশি হওয়ায় তা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভজনক হবে কিনা, সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। ফলে এ মজুদের উন্নয়নের কাজ আরম্ভ হয়নি। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর কয়লাখনি বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এখানে কয়লা মজুদের পরিমাণ ৫৭২ মিলিয়ন টন। এ প্রকল্পের উদ্যোক্তা এশিয়া এনার্জি করপোরেশন বাংলাদেশ। খনির মেয়াদকালে মোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে ২০০ কোটি মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। ফুলবাড়ী কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলার কথা, যা ইতোমধ্যে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এ খনিতে বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা হবে ১৫ মিলিয়ন টন। এই কয়লা খনির দৈর্ঘ ৮ কিলোমিটার (উত্তর-দক্ষিণে) এবং প্রস্থ ৩ কিলোমিটার (পূর্ব-পশ্চিমে)। এই খনিটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৬৫ থেকে ২৭০ মিটার গভীরে অবস্থিত। এইসব কয়লা খনি নিয়ে আমাদের দেশে একটি বড় বিতর্ক চলছে আর তা হচ্ছে কয়লা আমরা তুলব কীভাবে? ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে, নাকি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে? উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা যাবে। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড বা ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে তুললে তোলা যাবে মাত্র ১০ শতাংশ। এতে ঝুঁকিও বেশি। বাংলাদেশ অত্যন্ত ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা। অল্প জমিতে প্রচুর মানুষ বাস করে। সমস্যা হচ্ছে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তুলতে হলে অনেক জমি হারাবেন। ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের জন্য প্রায় ৫ হাজার ৯৩৩ হেক্টর জমি অধিগ্রহরের প্রয়োজন হবে, এর প্রায় ৮০ শতাংশই কৃষি জমি। প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে প্রকল্পকালে প্রায় ২ হাজার ৩০০ আদিবাসীসহ প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে স্থানান্তর ও পুনর্বাসিত করতে হবে। এই কাজটি ১০ বছরের মধ্যে সম্পাদন হবে। এখানে ১০০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ চালু হলে প্রতিবছর জিডিপিতে প্রায় ১ শতাংশ সংযোজন হতে পারে। প্রকল্প মেয়াদকালে জিডিপিতে অবদান রাখবে প্রায় ২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু ফুলবাড়ীর জনগণ উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিরোধিতা করে আসছে সেই প্রথম থেকেই। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ী কয়লাখনি উত্তোলনের বিরোধিতাকারী স্থানীয় জনগণের সাথে আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। তাতে মারা যান ৬ জন মানুষ। এশিয়া এনার্জির সাথে যে চুক্তি হয়েছিল, তারও বিরোধিতা করছে একটি জাতীয় কমিটি। ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলন নিয়ে যে জটিলতা, সেই জটিলতা এখনো দূর হয়নি। এমনি এক সময় স্থায়ী কমিটি দ্রুত কয়লা উত্তোলন করে তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পক্ষে মতামত দিলেন। কিন্তু তা না করে ভারত থেকে কয়লা আমদানি করে তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা ভবিষ্যতে একটি সঙ্কট তৈরি করতে পারে। আগামীতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যদি অবনতি ঘটে, তাহলে এই কয়লা আমদানির ওপর এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা নিয়েও কথা রয়েছে। প্রথমত, ভারত ওই দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যে পরিমাণ কয়লার প্রয়োজন হতো তা আমরা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করতে পারতাম কিনা? তৃতীয়ত, চুক্তিতে যেসব শর্ত রাখা হয়েছে, তা বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতিকূলে কিনা? চতুর্থত, ভারতীয় ঋণ করার প্রক্রিয়াটি কী? পঞ্চমত, যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে কোনো তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি রয়েছে কিনা? আমি জানি না সংসদের স্থায়ী কমিটি এসব বিষয় আদৌ বিবেচনায় নিয়েছিলেন কিনা? তবে স্বচ্ছতার স্বার্থেই সরকারের উচিত ছিল চুক্তিটি সংসদে উপস্থাপন করা। তাতে করে আমরাও বিস্তারিত জানতে পারতাম এবং সরকারও তার কাজের জন্য স্বচ্ছ থাকতে পারত। সংসদে চুক্তিটি উপস্থাপিত না হওয়ায়, বিতর্ক থেকেই গেল। আমরা অবশ্যই কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র চাই। সারা বিশ্বে যেখানে ৪০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় কয়লা থেকে (অস্ট্রেলিয়ায় ৭৯ শতাংশ, চীনে ৭৮ শতাংশ, ভারতে ৬৯ শতাংশ) সেখানে আমাদের অবশ্যই কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়া উচিত। বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে সামনে রেখে তাই কয়লানীতি দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। মনে রাখতে হবে বিদ্যুৎ নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে। বিরোধী দল এটাকেও ইস্যু করতে পারে। তাই একটি সুষ্ঠু নীতিমালার আওতায় কয়লা উত্তোলনের প্রক্রিয়া যদি আমরা শুরু করি, আমার বিশ্বাস বিদ্যুতের অনেক চাহিদা আমরা পূরণ করতে পারব। ইতোমধ্যে কয়লানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মতামতও দিয়েছেন। ২০০৭ সালের ১১ জুন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুয়েটের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোমিন পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটি ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি সরকারের কাছে তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। তাতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন রপ্তানির সুযোগ না রাখা দেশের চাহিদা পূরণের জন্য ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তার নিশ্চয়তার বিধান রাখা হয়েছিল। ওই রিপোর্টটিকে বিবেচনায় নিয়েই প্রয়োজনে কিছু সংযোজন ও বিয়োজন করে নতুন একটি কয়লানীতি আমাদের দরকার। মনে রাখতে হবে বিদ্যুতের প্রাপ্তি শুধু আমাদের ব্যক্তিগত জীবনই নয়, বরং আমাদের উন্নয়নের সাথেও সম্পর্কিত। Daily Jai Jai Din, 16.4.12

0 comments:

Post a Comment