রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রেলগেট' কেলেঙ্কারির তদন্তের এখন কী হবে

পদত্যাগের মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পুনরায় মন্ত্রিসভায় ফিরে আসা যে প্রশ্নটির জন্ম দিয়েছে, তা হচ্ছে ৭০ লাখ টাকা দুর্নীতি উদ্ঘাটনের জন্য যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল, তার ভবিষ্যৎ কী? তদন্ত কমিটি কি 'মন্ত্রী' সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে 'জেরা' করতে সাহস পাবে? 'মন্ত্রী' সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কি দুর্নীতি তদন্তে 'নিরপেক্ষ' থাকতে পারবেন? আর যে ৭০ লাখ টাকা ওমর ফারুক নিজ অ্যাকাউন্টে জমা দিয়েছেন, তার কী হবে? ওই টাকার মালিক কি আসলেই ওমর ফারুক? নাকি অন্য কেউ? যুক্তরাষ্ট্রের 'ওয়াটারগেট' কেলেঙ্কারির আদলে (যেখানে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল) সাংবাদিকরা ৭০ লাখ টাকার কেলেঙ্কারিকে 'রেলগেট' কেলেঙ্কারি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পুনরায় মন্ত্রিসভায় ফিরে আসার নাটকীয়তায় ভরা থাকলেও, অনেক প্রশ্ন এখন এই 'রেলগেট' কেলেঙ্কারিকে নিয়ে আবর্তিত হতে থাকবে। বিজিবির ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হলো। এত গভীর রাতে কোনো ব্যক্তি ৭০ লাখ টাকা নিয়ে গাড়িতে ঘোরেন না। গভীর রাতে অনেক রাস্তাতেই 'চেকপোস্ট' বসানো থাকে। এটা এপিএস, মৃধা আর এনামুল হকের অজানা নয়। তারপরও এপিএস ফারুক যখন দাবি করেন, এ টাকা তার, তখন সঙ্গত কারণেই ওই টাকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ওই টাকার উৎস, বিদেশ থেকে আনা পাউ-ের ডকুমেন্ট ও ব্যাংকে ভাঙানোর রশিদ নিশ্চই তার কাছে থাকার কথা। আমরা জানি না 'মন্ত্রী' হিসেবে সুরঞ্জিত বাবুর ফিরে আসার পর, তদন্ত কমিটি আদৌ ফারুকের কাছে এসব বিষয় জানতে চাইবে কি না? প্রধানমন্ত্রী খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে পুনরায় মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে। এই কাজটি তিনি পরে করলেও পারতেন। তার এই সিদ্ধান্ত বরং বিরোধী দলকে উসকে দিল। বিরোধী দল নতুন আরেকটি অস্ত্র পেল। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে সুরঞ্জিত সেন তদন্তের স্বার্থে নিজ পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। এটা যেমন একটি ভলো দিক। ঠিক এর একটি মন্দ দিকও আছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রত্যাবর্তন অনেক প্রশ্নের জবাব আমাদের দেবে না। সংবাদ সম্মেলনে ওই ৭০ লাখ টাকার ব্যাপারে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই জানালেও, সাসপেন্ড হওয়া রেলওয়ের জিএম আবু ইউসুফ মৃধা জানিয়েছিলেন তারা গাড়িতে করে মন্ত্রী সাহেবের বাসাতেই যাচ্ছিলেন। এত টাকা নিয়ে কোনো ব্যক্তি এত গভীর রাতে সাধারণত চলাচল করেন না। সুতরাং ওই টাকার সঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সম্পৃক্ততা কতটুকু ছিল, তা আর জানা যাবে না কোনোদিন। ঘুষ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগ এ দেশের সব রাজনীতিবিদের, বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় আছেন এবং আগামিতে ক্ষমতায় যেতে চান, তাদের ভূমিকাকে একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিয়েছিললা রাজনীতিবিদরা জনগণের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছিলেন। অথচ বারবার এ দেশের জনগণ রাজনীতিবিদদের কাছেই ফিরে গেছে। ব্যক্তি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে খুব সৎ ছিলেন না, তা সংবাদপত্রগুলো থেকে আমরা জানতে পারি তার ছেলে সৌমেন গুপ্তের ৫ কোটি টাকা দিয়ে ইন্টার কানেকশন এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স প্রাপ্তি, দিরাইয়ে আলিশান সেন মার্কেট, নামে বেনামে শত কোটি টাকার 'শত্রু সম্পত্তি' দখল ইত্যাদি প্রমাণ করে সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা ছিল না। কেননা তার আয়ের যে হিসাব তিনি নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছিলেন, তাতে তার স্বীকারোক্তি ছিল তার বার্ষিক আয় মাত্র ৭ লাখ টাকা। ৭ লাখ টাকার আয় দিয়ে কোটি টাকার মার্কেট করেন কীভাবে? আর তার সন্তান নিশ্চয়ই কোনো 'আলাদীনের চেরাগ' পাননি যে ৫ কোটি টাকা দিয়ে 'ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স তিনি পেতে পারেন। এটা তো শুধু ৫ কোটি টাকার ব্যবসা নয়। এটা প্রায় ৩০ কোটি টাকার একটা বিনিয়োগ। 'সেনগুপ্ত কমিউনিকেশন' এই টাকা পেল কোত্থেকে? দুর্মুখরা বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কলকাতাতেও নাকি বাড়ি আছে! সুরঞ্জিত বাবুর কী টিআইএন নাম্বার আছে? সেখানে তিনি কত টাকা ট্যাক্স দিয়েছিলেন? অভিযোগ আছে জিগাতলার বাড়ি নিয়েও। বেশ কিছুদিন আগে এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল। দুদক এখন এসব বিষয় নিয়ে তদন্ত করবে বলে আমার মনে হয় না। যে ৭০ লাখ টাকার কথা বলা হয়েছে এবং যা ওমর ফারুক পরদিন নিজ অ্যাকাউন্টে জমা দেন, এর মূল মালিক যে ওমর ফারুক নন, এটা জানা যাবে না কোনোদিন। এপিএস হিসেবে, তিনি বেতন পান, ওই বেতন দিয়ে কি এত বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করা সম্ভব? তার এবং তার স্ত্রীর অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। কিন্তু তাতে করে কি 'অবৈধ লেনদেনের' বিষয়টির সমাধান হবে? অবৈধ লেনদেনের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হওয়াই শ্রেয়। শুধু অ্যাকাউন্ট জব্দই নয়, প্রকৃত 'সত্য' জানতে অবিলম্বে তিন অভিযুক্ত ব্যক্তি ওমর ফারুক, এনামুল হক ও ইউসুফ আলী মৃধাকে গ্রেপ্তার করা উচিত। না হলে 'সত্য' চাপা পড়ে যাবে চিরদিনের জন্য। দুদকের জন্য একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে 'ইমেজ' বৃদ্ধির। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুদক কার্যত একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের আস্থা ধরে রাখতে পারছে না। সর্বশেষ ঘটনায় দুদক যখন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের দুর্নীতির ব্যাপারে একটি 'সার্টিফিকেট' দেয়, তখন দুদক সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। তখন দুদকের জন্য একটি সুযোগ সষ্টি হলো মন্ত্রীসহ অভিযুক্ত ওই তিন ব্যক্তির আর্থিক লেনদেন, ব্যাংক ব্যালেন্সের তদন্ত করা। এটি যদি দুদক করতে না পারে, তাহলে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদকের কার্যক্রম প্রশ্নের মুখে থাকবেই। দুদক যদি নিরপেক্ষভাবে এবং প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বের স্বার্থেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি তদন্ত করে, আমার বিশ্বাস দুদক তার গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পাবে। সরকারেরও উচিত দুদককে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দেয়া। কিন্তু এই সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ। দুর্নীতির কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ বড় ধরনের ইমেজ সঙ্কটের মুখে পড়েছে। মন্ত্রীর এপিএসের গাড়িতে টাকা পাওয়ার ঘটনায় খোদ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মার্কিন কংগ্রেসম্যান যোসেফ ক্রাউলি। এর আগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছিল। এটা সরকারের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিয়ে সরকার প্রধান ভালো কাজটিই করেছিল। কিন্তু তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার সিদ্ধান্তটি ভালো হলো না। রাজনীতিবিদ এবং সুশীল সমাজের প্রায় সবাই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগের সিদ্ধান্তটি সমর্থন করেছিলেন। এটা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য ছিল একটি দৃষ্টান্ত। তবে এটা সবাই জানেন যে সুরঞ্জিত বাবু প্রথমে পদত্যাগ করতে চাননি। প্রধানমন্ত্রী চেয়ে ছিলেন বিধায়, তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু কেন এত দ্রুত তাকে আবার ফিরিয়ে আনা হলো? বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবেলা করার জন্য তার হাতকে শক্তিশালী করার জন্য প্রধানমন্ত্রী যদি এই সিদ্ধান্তটি নিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি ভুল করেছেন। এতে করে বিরোধী দলের এজেন্ডায় যুক্ত হলো নতুন একটি বিষয়। সরকারের ভাবমূর্তি এতে করে উজ্জ্বল হবে না। 'রেলগেট' কেলেঙ্কারি এখন কঠিন বরফের নিচে চাপা পড়ে যেতে পারে। হাজারটা 'সমস্যার' ভিড়ে মানুষের মন থেকে হারিয়ে যেতে পারে মন্ত্রীর এপিসের গাড়িতে পাওয়া ৭০ লাখ টাকার ঘটনাটি। কিন্তু রাজনীতিতে এই ঘটনাটি হারিয়ে যাবে না। ব্যক্তি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জন্যও এই ঘটনা 'কাল' হয়ে থাকবে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে এই ৭০ লাখ টাকার ঘটনা 'তাকে তাড়া' করে ফিরবে। এর জবাব তার কাছে একটা আছে। কবিতার ভাষায় আর গানের কলি দিয়ে এর জবাব তিনি দেন সুধী সমাজে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি তার জন্য খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগ, আবার প্রত্যাবর্তন অনেক নাটকীয়তার জন্ম দিলেও অনেক প্রশ্নের জবাব আমরা পাব না কোনোদিন। 
 দৈনিক যায় যায় দিন ২৪ এপ্রিল ২০২

0 comments:

Post a Comment