রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি

স্বাধীন ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন প্রণব মুখার্জি। এটা অনেকটা প্রত্যাশিতই ছিল। স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন রাজেন্দ্র প্রসাদ (২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ থেকে ১৩ মে ১৯৬২) আর তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৩তম প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিলেন ৭৬ বছর বয়সী প্রণব মুখার্জি। ১৯৬৯ সালে প্রথমবারের মতো কংগ্রেস দলের সদস্য হয়ে রাজ্যসভায় তিনি প্রবেশ করেছিলেন। সেই থেকে শুরু। দীর্ঘ ৩৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটিয়েছিলেন তিনি শুধু রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রার্থী হওয়ার জন্য। রাষ্ট্রপতির কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে না। তিনি নিরপেক্ষ। জাতির প্রতীক। একসময়ে কাজপাগল এ মানুষটির রাইসিনা প্যালেসে এখন দিন কাটবে বই পড়ে আর বাগান করে। ভারতের রাজনীতিতে রাষ্ট্রপতির সেই অর্থে কোনো ভূমিকা নেই। সংবিধান তার ক্ষমতাকে সীমিত করে দিয়েছে। তিনি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রণব মুখার্জির এ বিজয় আমাদের জন্য একাধিক কারণে গর্বের। প্রথমত, তিনি বাঙালি হওয়ায় আমরা গর্বিত। দ্বিতীয়ত, তিনি আমাদের নড়াইলের জামাই। সে কারণে তিনি আমাদেরও আত্মীয়। স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জির পৈতৃক বাড়ি নড়াইলে। তৃতীয়ত, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রয়েছে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক। তাই আমরা আশা করতেই পারি যে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নে তিনি কিছুটা হলেও অবদান রাখবেন। এ সম্পর্ক তো এখন নানা জটিলতায় আটকে আছে। বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে যার সমাধান হচ্ছে না। অতি সম্প্রতি নয়াদিলি্লতে জেসিসির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও, বন্দি বিনিময়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যাতে ভারতের প্রাপ্তি বেশি।
এটা অনেকেই জানেন, এ চুক্তিটি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ভারত মূলত একটি জিনিসই চায়_ আর তা হচ্ছে উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ফেরত। অনুপ চেটিয়া এখন বাংলাদেশের জেলে আটক। বন্দি বিনিময়ের যে চুক্তিটি চূড়ান্ত করা হয়েছে তাতে সাজাপ্রাপ্ত বন্দি নিজ দেশে সাজা খাটার সুযোগ পাবেন। এ ক্ষেত্রে অনুপ চেটিয়া ভারতে সাজা খাটতে পারেন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য এ মুহূর্তে অনুপ চেটিয়াকে খুবই দরকার। উলফার নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার একটা আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন। উলফার চেয়ারম্যান এখন তাদের কব্জায়। এ জন্যই তাদের অনুপ চেটিয়াকে দরকার। কিন্তু বিষয়টি কী অত সহজ হবে? অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে একটি আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। কেননা সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, অনুপ চেটিয়া বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। তার সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী কোনো ব্যক্তিকে ফেরত পাঠানো যায় কি না, তা এক প্রশ্ন বটে। যে কোনো আন্তর্জাতিক আইনের এটা পরিপন্থী। এতে করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে বাধ্য। এই চুক্তিতে আমাদের কোনো লাভ হয়নি।
তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারটি নিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। চুক্তি হচ্ছে না। এ সংক্রান্ত কোনো দিকনির্দেশনা না থাকলেও, বিবিসির বাংলা বিভাগ (৯ মে) আমাদের জানাচ্ছে, তিস্তার পানি বণ্টনের বাপারে আদৌ কোনো চুক্তি হচ্ছে না। এ কথাটা নাকি দীপু মনিকে জানিয়েও দেয়া হয়েছে। যদিও দীপু মনি তা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন অব্দি কোনো চুক্তি হয়নি। এখানে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্যা। আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই। কিন্তু ভারত আমাদের সেই অধিকার নিশ্চিত করছে না। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও ভারত আমাদের বারবার মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং একাধিকবার বলেছেন ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? নয়াদিলি্লতে ইতিমধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সেখানে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার। প্রায় ৯ হাজার কোটি রুপিও ব্যয় করা হয়ে গেছে। বাঁধটি যদি নির্মিত হয়, তাতে বাংলাদেশের কী ক্ষতি হবে, তা একাধিক সেমিনারে আলোচিত হয়েছে। এখানে আমাদের ব্যর্থতা, আমরা শক্ত অবস্থানে যেতে পারছি না। জেসিসির যৌথ ইশতেহারে এ সংক্রান্ত কোনো কথা বলা হয়নি। গঙ্গা চুক্তি আমরা করেছিলাম ১৯৯৬ সালে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। এর আগেই পদ্মায় পানি নেই। চুক্তি অনুযায়ী আমরা পানি পাচ্ছি না। ২০২৭ সালে লোকসংখ্যা বাড়বে ৩ গুণ। যে বিপুল পানির চাহিদা থাকবে, তার কী হবে? চুক্তি অনুযায়ী পর্যালোচনার সুযোগ আছে। কিন্তু সেই সুযোগটি আমরা নিচ্ছি কৈ? অতীতে কখনো আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করিনি। সীমান্ত হত্যা আজো বন্ধ হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও একের পর এক সীমান্ত হত্যা হচ্ছে। এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই যেখানে বিজেবির গুলিতে কোনো ভারতীয় নাগরিক মারা গেছে। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে নিরাপরাধ বাংলাদেশি নাগরিকরা। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ৪০ মাসে কতজন বাংলাদেশি মারা গেছে, তার পরিসংখ্যান 'অধিকার' এর কাছে আছে। এ নিয়ে কত শীর্ষ বৈঠক হল। কিন্তু হত্যা বন্ধ হয়নি। প্রণব বাবু যখন ঢাকায়, তখনো এটা নিয়ে কিছু বলা হল না। সীমান্ত চিহ্নিত ও অপদখলীয় ভূমির ব্যাপারেও প্রণব বাবু মুখ খোলেননি ঢাকায়। গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১টি সিটমহল ও ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১টি সিটমহলের ব্যাপারে আমরা কিছুই শুনলাম না। ভারতের ভেতরে যারা রয়েছেন, তারা ভারতেই থাকতে চান। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের ভেতরে যারা রয়েছেন, তারা বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবেই থাকতে চান। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেই ১৯৭৪ সালে। তারপর কখনই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার উদ্যোগ নেয়নি সংবিধান সংশোধন করার। সমস্যাটা তো আমাদের নয়। সমস্যাটা ভারতের। আজ প্রায় ৩৮ বছর পরও এ কথাগুলো আমাদের বলতে হয়। এতে করে কী ভারতের সদিচ্ছা প্রমাণ করে? ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল ভারত। প্রণব বাবু ঢাকায় এসে ২০ কোটি ডলার অনুদানের কথা বলে গেলেন। কিন্তু ঋণের টাকা দিয়ে তো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না? ১৩ প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার অভাবে প্রকল্পগুলো আটকে আছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের রয়েছে বিশাল এক বাণিজ্য ঘাটতি। ২০০৯-১০ সালে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১০-১১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে। ২০১১-১২ সালের পরিসংখ্যান যখন আমাদের হাতে আসবে, ধারণা করছি তা ৪ বিলিয়ন ডলারের অংককে ছাড়িয়ে যাবে। ভারত মাঝেমধ্যে কিছু পণ্যের শুল্কমূল্য প্রবেশাধিকারের কথা বলে বটে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশ এসব পণ্যের অনেকগুলোই রফতানি করে না। ভারতের অশুল্ক বাধা দূর করা নিয়েও 'নানা কাহিনী' আছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নানা ধরনের শুল্ক দূর করা যাচ্ছে না। ফলে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি সেই তুলনায় বাড়ছে না। শুধু ঘাটতি বাড়ছেই। এটা আমাদের জন্য শঙ্কার কারণ। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি নিয়ে আদৌ কোনো অগ্রগতি নেই। কিন্তু আদৌ ২০১৩ সালে আমরা বিদ্যুৎ পাব_ এ ব্যাপারটি আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। বাংলাদেশ বড় ধরনের বিদ্যুৎ সংকটের মুখে। বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন বন্ধ অনেক কারখানায়। অথচ ভারত যদি আন্তরিক হয়, তাহলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান সম্ভব। ভুটানে সারপ্লাস বিদ্যুৎ রয়েছে। এই বিদ্যুৎ ভুটান বাংলাদেশে রফতানি করতে পারে। সম্মতি প্রয়োজন ভারতের। কিন্তু ভারতের সম্মতি পাওয়া যায়নি। আশুগঞ্জে যে কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপনের ব্যাপারে দুই দেশের মাঝে চুক্তি হয়েছে, তাতে লাভবান হবে ভারত। আমরা লাভবান হব না। ভারত তার পণ্যের পরিবহন সুবিধার জন্যই এই টার্মিনাল ব্যবহার করছে। তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে আমরা ভারতীয় কনটেইনারগুলো পরিবহনের সুযোগ করে দিয়েছি। ভারত প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আমাদের স্বার্থ হয়ে পড়েছে গৌণ। আজ জেসিসির বৈঠকের পর যৌথ ইশতেহারে যেসব বক্তব্য স্থান পেয়েছিল, তাতে ওই ভারতীয় স্বার্থকেই বেশি করে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। প্রণব বাবু ঢাকায় এসে আমাদের স্বার্থে কোনো কথা বলে যাননি। তিনি ভারতীয় স্বার্থ দেখবেন, এটই স্বাভাবিক। তবুও বাঙালি হিসেবে তার কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবেই। তিনি কতটুকু কী করতে পারবেন, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। সংবিধান অনুযায়ী তার ক্ষমতাও সীমিত। তিনি কিছু করতে চাইলেও, করতে পারবেন না। তিস্তার পানি বণ্টনে মমতার আপত্তি আমাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত করছে। প্রণব মুখার্জি একটা সমাধান চাইলেও, তাতে তিনি সফল হবেন না। তবুও লাখ লাখ বাংলাদেশির একটা প্রত্যাশা থেকে যাবেই। আমরা প্রণব মুখার্জিকে স্বাগত জানাই এবং প্রত্যাশা করি আগামীতে কোনো একসময় ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলাদেশেও আসবেন তিনি।
Daily DESTINY
25.7.12

0 comments:

Post a Comment