রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান কি আসন্ন?

পাকিস্তানে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা করেছেন সাবেক সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। নির্বাসিত এই প্রেসিডেন্টের বক্তব্য পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে গত ৩ জুলাই। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ মনে করেন দেশ রক্ষায় জনগণ আবার সেনাবাহিনীর দিকে ঝুঁকছে। জেনারেল পারভেজ মোশাররফের এই বক্তব্য এলো এমন এক সময় যখন পাকিস্তানে বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়েছে। উচ্চ আদালতের রায় না মানায় প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি অযোগ্য হিসেবে ঘোষিত হন। তারপর যাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পিপিপি নিয়োগ দিয়েছিল (মকদুম শাহাবুদ্দিন), তার বিরুদ্ধে একটি নিম্ন আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল। পরে রাজা পারভেজ আশরাফ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেও উচ্চ আদালত তাকে দুই সপ্তাহ সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে। ওই সময়সীমার মধ্যে রাজা পারভেজ আশরাফকে সুইজারল্যান্ড কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জারদারি অবৈধভাবে ১ কোটি ২০ লাখ ডলার সুইস ব্যাংকে ট্রান্সফার করেছিলেন। তার স্ত্রী বেনজির ভুট্টো যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন অবৈধভাবে অর্জিত এই টাকা তিনি সুইস ব্যাংকে ট্রান্সফার করেছিলেন। এ ব্যাপারে সুইস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তদন্ত শুরু করলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী গিলানি ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে এই তদন্ত বন্ধ করেছিলেন। কেননা তার যুক্তি ছিল প্রেসিডেন্ট দায়মুক্তি পেতে পারেন। কিন্তু উচ্চ আদালতের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। তখন নয়া প্রধানমন্ত্রী রাজা পারভেজ আশরাফ যদি আবারো একই যুক্তি তোলেন যে প্রেসিডেন্ট দায়মুক্তি পেয়েছেন এবং সুইস কর্তৃপক্ষকে চিঠি না লেখেন, তাহলে তাকেও একই ভাগ্য বরণ করতে হবে, তাকেও চলে যেতে হবে। শুধু তাই নয়, প্রেসিডেন্ট জারদারি নিজেও বিপদে আছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি এখনো পিপলস পার্টির কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। এ ব্যাপারেও আদালতের একটি রুলিং রয়েছে। তাই সব মিলিয়ে পাকিস্তানের পরিস্থিতি ভালো নয়। বর্তমান সরকারের মেয়াদ ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত থাকলেও ধারণা করা হচ্ছে বর্তমান সরকার তার টার্ম পূর্ণ করতে পারবে না। আগামী নভেম্বরে সেখানে নির্বাচন হতে পারে। পাকিস্তানে অতীতে কখনই কোনো রাজনৈতিক সরকার তার টার্ম (৫ বছরের) শেষ করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে পিপিপির নেতৃত্বাধীন সরকার যদি এই টার্ম শেষ করে, তাহলে এটা হবে একটা রেকর্ড। এমনকি পাকিস্তানের রাজনীতিতে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের উত্থানের মধ্য দিয়ে যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে উচ্চ আদালতের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্ব আগামীতে কি ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তির পথ প্রশস্ত করল? ইমরান খান রাজনীতিতে এসেছেন কিছুদিন হলো। তিনি একটি দলও করেছেন_ 'তেহরিকই ইনসাফ'। তার মূল সেস্নাগান হচ্ছে দুর্নীতমুক্ত পাকিস্তান। উচ্চ আদালত গিলানির বিরুদ্ধে যে রায় দিয়েছেন, তার পেছনেও কাজ করছে এই দুর্নীতির প্রশ্নটি। এক সময় জারদারির পরিচিতি ছিল 'মি. টেন পারসেন্ট' হিসেবে। স্ত্রী বেনজির ভুট্টো যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন বড় বড় কন্ট্রাক্ট তিনি পাইয়ে দিতেন অর্থের বিনিময়ে। ওই টাকায় তিনি দুবাইয়ে বিশাল বাড়ি কিনেছেন। সুইজারল্যান্ড তথা লন্ডনেও রয়েছে তার সম্পদ। তবে তার প্রতিপক্ষ নওয়াজ শরীফও 'ধোয়া তুলসিপাতা' নন। তার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আগামীতে উচ্চ আদালত যদি নওয়াজ শরীফের বিরুদ্ধে কোনো রুল ইস্যু করে আমি অবাক হবো না। এর মধ্য দিয়ে তৃতীয় শক্তি হিসেবে ইমরান খান সামনে চলে আসছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ত ইমরান খানের মধ্যে বিকল্প শক্তি দেখতে চাইবে। পারোক্ষভাবে ইসরাইলের সঙ্গেও ইমরান খানের যোগাযোগ রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। ইসরাইল অনেকদিন ধরেই চাইছে পাকিস্তান তাদের স্বীকৃতি দিক। এখন ইমরান খানকে যদি ক্ষমতায় আনা যায় তাহলে ইসরাইলের স্ট্র্যাটেজি তাতে সার্থক হবে। পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি ইমরান খানের ইসলামাবাদে যাওয়ার যাত্রাপথকে আরো প্রশস্ত করছে কি না, তা শুধু আগামী দিনগুলোই আমাদের বলতে পারবে। প্রশ্ন হচ্ছে এই রায় ইসলামী কট্টরপন্থীদের স্ট্র্যাটেজিতে আদৌ কি কোনো পরিবর্তন ডেকে আনবে? আমার তা মনে হয় না। পাকিস্তান বাহ্যত ধীরে ধীরে আরেকটি 'তালেবানি রাষ্ট্র'র দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সীমান্তবর্তী পাখতুন খোয়া প্রদেশে সনাতন রাজনীতির কোনো প্রভাব নেই। এ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে পাকিস্তানপন্থী তালেবানরা। উত্তর ও দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানসহ সমগ্র উত্তর-পূর্ব সীমান্ত প্রদেশ এখন ইসলামিক কট্টরপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে। এদের সঙ্গে আফগানিস্তানের তালেবানদের রয়েছে যোগাযোগ। এই অঞ্চলে একটি ইসলামপন্থী দল স্থানীয় ক্ষমতা পরিচালনা করে বটে, কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে কট্টরপন্থীরা। তাই এখানে দীর্ঘদিন যাবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানববিহীন ড্রোন বিমান হামলা পরিচালনা করে আসছে। কট্টরপন্থীদের প্রভাব দিনে দিনে বাড়ছেই। পাঁচ-ছয় বছর আগে পাকিস্তান সফরে গিয়ে কট্টরপন্থীদের যে 'শক্তি' আমি দেখেছিলাম আজ সেই 'শক্তি' কমেনি, বরং বেড়েছে। ইসলামবাদে গিলানি সরকারের পতন ঘটলেও পাকিস্তানি তালেবানদের তাতে কিছু যায় আসে না। তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়ছেই। পাকিস্তানে একটি পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান একজন নয়া প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে। মনে রাখতে হবে আগামী ২০১৩-১৪ সাল পাকিস্তানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নেব। এর ফলে কারজাই সরকার আদৌ কাবুলে থাকতে পারবে কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। মডারেট তালেবানদের সঙ্গে (যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে) কারজাই সরকারের যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছিল, তা খুব বেশিদূর যেতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরিভাবে এ অঞ্চলে তার স্বার্থ পরিত্যাগ করবে, আমার তা মনে হয় না। ভারত মহাসাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে নতুন করে এক স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হতে যাচ্ছে। চীনকে 'ঘিরে ফেলার' এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করে যাচ্ছে। ভারত হচ্ছে তার সঙ্গী। এ ক্ষেত্রে স্ট্র্যাটেজিক্যালি পাকিস্তানের গুরুত্ব অনেক বেশি। একদিকে আফগানিস্তানে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর জন্য রসদ সরবরাহের পথ পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে। পাকিস্তান এই পথ সম্প্রতি (খাইবার উপত্যকা) খুলে দিতে রাজি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চিন্তার অন্যতম কারণ। ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য বেলুচিস্তানের শামসী বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অতি জরুরি। পাকিস্তানের প্রদেশ বেলুচিস্তান থেকে ইরান সীমান্ত মাত্র ৭২ কি.মি. দূরে। তৃতীয়ত, গাওদারের গভীর সমুদ্রে রয়েছে চীনা নৌবাহিনীর উপস্থিতি। ভারত মহাসাগরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে বেলুচিস্তানের গাওদার ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রয়োজন রয়েছে। সব মিলিয়ে তাই দরকার ইসলামাবাদে একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার। প্রশ্ন হচ্ছে কার নেতৃত্বে এই সরকার পরিচালিত হবে? একটি রাজনৈতিক সরকার, যে সরকার ইন্দো-আমেরিকান স্ট্র্যাটেজিকে সমর্থন করবে এবং এ অঞ্চলজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিশাল স্ট্র্যাটেজি, সেই স্ট্র্যাটেজির অংশ হবে? নাকি একটি সামরিক সরকার? জেনারেল কিয়ানি, যিনি এখনো সেনা প্রধান, তিনি আলোচনায় আছেন দীর্ঘদিন ধরে। তাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র কোনো স্ট্র্যাটেজে তৈরি করছে কিনা, তা বলা মুশকিল। এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্র এখন আর সেনা অভ্যুত্থানের সমর্থন করে না এবং পাকিস্তানে সেনা নেতৃত্বের ব্যাপারেও তাদের রিজার্ভেশন রয়েছে, তাই খুব সম্ভবত সেনাবাহিনী সমর্থিত একটি সিভিলিয়ান সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন জানাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ২৩ জন পাকিস্তান সেনার হত্যাকা-ে ক্ষমা চাওয়ায়, দুদেশের মাঝে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে জটিলতা ছিল, তা কেটে গেছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পাকিস্তানে একটি 'বন্ধুপ্রতিম' সরকার দরকার। বহিঃবিশ্বে এমন একটি ধারণার জন্ম হয়েছে যে ইমরান খান হতে যাচ্ছেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। তিনি ইতোমধ্যে পাকিস্তানে ও বহিঃবিশ্বে একটি 'ক্লিন ইমেজ' গড়ে তুলেছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম তাকে জনপ্রিয় করেছে। তবে অভ্যন্তরীণভাবে তিনি কতটুকু জনপ্রিয় তা এখন পরীক্ষিত নয়। অতীতে নির্বাচনে তার দল বয়কট করেছিল। সুতরাং প্রশ্ন থেকেই গেল। এ ক্ষেত্রে জেনারেল কিয়ানির একটি 'ইমেজ' রয়েছে। এর আগে সেনা অভ্যুত্থানের একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও, তার দৃঢ়চেতা মনোভাবের কারণে, তা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। প্রথমত, রাজনীতিবিদরা, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনরা দুর্নীতিগ্রস্ত। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানপন্থী তালেবানরা দিনে দিন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক সরকার এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। জ্বালানি সঙ্কট, পানির অভাব ও অর্থনীতির নিম্নগতি পাকিস্তানের পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে। মানুষের মাঝে হতাশা বাড়ছে। এসব কারণ মানুষের মাঝে হতাশ যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই উচ্চ আদালতের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়েছে। এর পেছনে সেনাবাহিনী যে আদৌ কলকাঠি নাড়াচ্ছে না, তা দিব্যি দিয়ে বলা যাবে না। সুতরাং একটি সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা শতকরা একশ ভাগ উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ পাকিস্তানে সেনাবাহিনী অত্যন্ত শক্তিশালী একটি 'রাজনৈতিক পক্ষ'। এখন জেনারেল পারভেজ মোশাররফের এ ধরনের বক্তব্য সেনা নেতৃত্বকে ইন্ধন জোগালেও আমি অবাক হবো না। তবে একটি নির্বাচনের সম্ভাবনা সেখানে বেশি। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেনা সমর্থিত একটি সরকার (খুব সম্ভবত ইমরান খানের নেতৃত্বে) শুধু সেনাবাহিনীর স্বার্থই রক্ষা করবে না, বরং মার্কিন স্বার্থও রক্ষা করবে।
Daily JAI JAI DIN
09.07.2012

0 comments:

Post a Comment