রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অনিশ্চয়তার আবর্তে পদ্মা সেতু




পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন বন্ধ ঘোষণা করলে, সরকার নিজ উদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এত বড় একটি সেতু আদৌ স্ব উদ্যোগে নির্মাণ করা যায় কিনা, আমাদের সেই টেকনিক্যাল জ্ঞান আছে কিনা, এসব বিষয়গুলো কতটুকু বিবেচনায় নেয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। খোদ অর্থমন্ত্রী যখন নিজেই সন্দিহান, সেখানে সরকার সমর্থক কিছু অর্থনীতিবিদ প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্য ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন 'নিজস্ব টাকায় চারটি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব' (আমার দেশ, ২০ জুলাই)। ড. আবুল বারকাতের বক্তব্য এভাবেই ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। তিনি তত্ত্ব দিয়েছেন ১২টি উৎস থেকে চার বছরে ৯৮ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব। একটি সেমিনারে যে ১২টি উৎসের কথা তিনি বলেছেন, এগুলো সবই তত্ত্বের কথা। প্রবাসীদের পাঠানো টাকা, পেনশন ফান্ড, দেশজ ব্যাংক ব্যবস্থা, দেশীয় বীমা কোম্পানির যে উৎসের কথা তিনি বলেছেন, তা অঙ্কের হিসেবে হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু বাস্তব নিরিখে ঠিক নেই। এগুলো সবই প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করা। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু নিয়ে চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। একজন ছাত্র চাঁদার টাকা ভাগাভাগিতে খুনও হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য মহোদয়রা এখন প্রতিযোগিতায় নেমেছেন কে কত বেশি টাকা প্রধানমন্ত্রীর ফান্ডে জমা দেবেন। উদ্দেশ্য কিন্তু পদ্মা সেতু নয়, উদ্দেশ্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এভাবে চাঁদা আদায় করে বিশাল বাজেটের পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যায়, এটা বোধকরি বাংলাদেশেই সম্ভব। এমনিতেই নানা কারণে বহির্বিশ্বের বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে র‌্যাবকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এখন পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির প্রসঙ্গটি যোগ হলো। এর ফলে আমাদের ভাবমূর্তি যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াল, তা আমাদের নীতিনির্ধারকরা আদৌ চিন্তা করছেন না। অভিযুক্ত মন্ত্রী অবশ্য পদত্যাগ করেছেন। দুদক থেকে তিনি ইতোমধ্যে একখানা সার্টিফিকেটও জোগাড় করে ফেলেছেন। পত্রিকায় বিশাল একখানা বিজ্ঞাপনও দিয়েছেন। বিশ্বব্যাংক ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর ও ২০১২ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ সরকারের কাছে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পেশ করে। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে অভিযোগের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপক আলোচিত দুটি অভিযোগের ব্যাপারে সরকার ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। একটি বাইরের প্যানেলের কাছে তথ্য দেয়ার এবং প্যানেলকে তদন্ত প্রক্রিয়ায় পর্যাপ্ততা মূল্যায়নের সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হলেও তা দুর্নীতি দমন কমিশন মেনে নেয়নি। এছাড়া তদন্ত চলাকালে সরকারি দায়িত্ব পালন থেকে সরকারি ব্যক্তিবর্গকে (আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব) ছুটি দিতেও সরকার রাজি হয়নি। এ দুটো বিষয়ে ঐকমত্য না হওয়ায় বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। এখন সরকার সামনের নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজস্ব অর্থায়নে এ সেতুটি নির্মাণ করতে যাচ্ছে। কেননা সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণের। কিন্তু সেতুর দীর্ঘস্থায়িত্বতা, টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি, বৈদেশিক মুদ্রার জোগান নিয়ে যে বড় প্রশ্ন ইতোমধ্যেই উঠেছে, তা সরকার একবারো ভেবে দেখেনি। এটা নিয়ে সরকার প্রধানের খামখেয়ালি, বারেবারে ড. ইউনুসকে জড়িত করার প্রক্রিয়া (একাধিকবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও বিশ্বব্যাংক থেকে অস্বীকার করা সত্ত্বেও), বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে এ ভাবমূর্তি উদ্ধারে এতটুকু উদ্যোগও নষ্ট করা যাচ্ছে না। সরকারের ভাবমূর্তি আজ কোন পর্যায়ে উত্থিত হয়েছে, তা কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলেই বোঝা যাবে। ২০ জুলাই প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় একটি খবর ছাপা হয়েছে, মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট বেস্নককে উদ্ধৃতি করে। বেস্নক বলেছেন বাংলাদেশে হত্যা ও গুমের সঙ্গে র‌্যাব জড়িত। এ বক্তব্য তিনি দিয়েছেন মার্কিন কংগ্রেসে। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মার্কিন সরকারের নীতি প্রতিফলিত হন। এ বক্তব্য কোনো আশার কথা বলে না। এখন কংগ্রেসের কোনো সদস্য যদি বাংলাদেশ বিরোধী কোনো আইন কংগ্রেসে উপস্থাপন করে, আমি অবাক হবো না, সম্ভবত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনো এ দিকটার দিকেই তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন জানি- সম্প্রতি বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি বিশেষ করে বিচার বহির্ভূত হত্যার ঘটনায় জার্মানিও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে এসেছিলেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওইডো ভেস্টারভেল। তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির উপস্থিতিতেই যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে এ কথাগুলো বলেছিলেন, যা সংবাদপত্রে ছাপাও হয়েছিল। একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতও। সবচেয়ে যা দুঃখজনক তা হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাপারে দাতা দেশগুলোর নেতিবাচক মনোভাবের কারণে বৈদেশিক সাহায্য প্রবাহেও এক ধরনের মন্থরতা সৃষ্টি হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা গেল জুন পর্যন্ত (২০১২) আমাদের বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি ছিল ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু মে পর্যন্ত গেল ১১ মাসে প্রতিশ্রুতি আদায় করা সম্ভব হয়েছে মাত্র ৪২৮ কোটি ৪২ লাখ ৪ হাজার ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১৭১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের মতো কম প্রতিশ্রুতি। এখন পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির প্রশ্ন ওঠায় বিশ্ব ব্যাংকসহ অন্য দাতারাও যে অর্থ ছাড় করণের ব্যাপারে কিছুটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে, এটা স্বাভাবিক। বিশ্বব্যাংক ছাড়াও, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান বাংলাদেশকে বড় অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। এখন এই অর্থ প্রবাহে মন্থরতা আসবে। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে প্রায় ৩০টি প্রকল্পে অর্থ জুগিয়ে থাকে। ওইসব প্রকল্পগুলো নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠতে পারে। দাতাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরো নষ্ট হবে যদি সত্যি সত্যিই ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ সরকার শুরু করে দেয়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিশ্রুতি দেয়া ১২০ কোটি ডলারের পাশাপাশি এডিবি ৬১ কোটি ডলার ও জাপান ১৪ কোটি ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছিল। এখন আর এদের থেকে ঋণ পাওয়া যাবে না। পদ্মা সেতুতে মোট খরচ ধরা হয়েছে ২৯০ কোটি ডলার, বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ২৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। সরকার এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা দেশকে আগামীদিনে একটি বড় ধরনের ঝুঁকির মাঝে ফেলে দেবে। বাংলাদেশ বন্ধুহীন হয়ে যেতে পারে। শুধু একজন মন্ত্রীকে বাঁচাতে (যায়যায়দিন) সরকারের এ সিদ্ধান্ত জাতিকে কড়া মূল্য দিতে হবে। এতে করে নির্মাণ খরচ বাড়বে। দক্ষতার প্রশ্ন উঠবে। সেতুর দীর্ঘস্থায়িত্ব একটি প্রশ্নের মুখে থাকছে। মালয়েশিয়ার প্রস্তাবও টেকসই নয়। বিশ্বব্যাংকের ঋণের সুদের চেয়ে মালয়েশিয়াকে সুদ দিতে হবে অনেক বেশি। এটা কোনো গোঁয়ার্তুমির বিষয় নয়। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তে শুধু এক ধরনের গোঁয়ার্তুমিই প্রতিফলিত হয়নি বরং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকেও একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিল। কোনো খাত থেকেই ২৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। চাঁদা তুলে, একদিনের বেতন দিয়ে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা কী সম্ভব? সরকার একটি ভাঁওতাবাজির আশ্রয় নিয়েছে। এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। এটা আওয়ামী লীগের একটি নির্বাচনী স্ট্রাটেজি জনগণকে আশ্বাস দেয়া যে পদ্মা সেতু হবে। আসলে এ সরকারের পক্ষে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব নয় বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। ইতোমধ্যে দুটো বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করছে। বিএনপি বলছে পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যাপারে দুর্নীতিবাজদের বিচার করতে হবে। আর সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন বিএনপি পদ্মা সেতু চায় না। অথচ মূল বিষয় নিয়ে কেউ কথা বলছে না। পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ যদি বেড়ে যায়, তাহলে চূড়ান্ত বিচারে তা ব্যবহারকারীদের উপর গিয়ে বর্তাবে। গাড়ি পারাপারের টোল বৃদ্ধি পাবে, ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে। সাধারণ মানুষের সুবিধা এই সেতু থেকে পাওয়া যাবে না। ২৪ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে একটা সেতু যদি নির্মিত হয়, আর সাধারণ মানুষ যদি তা ব্যবহার না করে, তাহলে এই সেতু নির্মাণ করে লাভ কী? আমার ধারণা নীতিনির্ধারকরা এটাকে একটা 'প্রেসটিজ ইস্যু' হিসেবে নিয়েছেন। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়ায় নিজেরা উদ্যোগী হয়েছেন। কিন্তু তাতে খরচ কতটুকু বাড়ল তা তারা চিন্তা করেননি। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ পদ্মা সেতু চায়, এতে দ্বিধাও নেই। কিন্তু আর্থিক বোঝা যদি তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে তাতে সরকারের উদ্দেশ্য সফল হবে না। অভিযুক্ত মন্ত্রীর পদত্যাগের ফলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে। এতে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কিছুটা উজ্জ্বল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং অর্থায়নের একটা সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। দেখা যাক অবশেষে কী হয়।Daily JAI JAI DIN25.7.12

0 comments:

Post a Comment