রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পাকিস্তান : যে গল্পের শেষ নেই


পাকিস্তানকে নিয়ে গল্পের যেন শেষ নেই। সম্প্রতিক সময়গুলোতে পাকিস্তানকে নিয়ে একের পর এক নাটকীয় ঘটনা ঘটে চলেছে। মনে হচ্ছে, অদৃশ্য এক 'চিত্র নাট্যকার' যেভাবে 'নাটকের' দৃশ্যপট সাজিয়েছেন, সেভাবেই 'অভিনেতারা' অভিনয় করে যাচ্ছেন। অ্যাবোটাবাদে সামরিক গ্যারিসনের পাশে ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে পাওয়া ও তাকে হত্যা করা উগ্র 'তালেবানি' রাজনীতির উত্থান, বেনজির ভুট্টোর মৃত্যু, বরখাস্ত হওয়ার পরও প্রধান বিচারপতির পুনরায় ফিরে আসা, মেমোগেট কেলেঙ্কারী, প্রধানমন্ত্রী গিলানি আদালত কর্তৃক অযোগ্য ঘোষণা, মনোনীত প্রধানমন্ত্রী মকদুম শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি, কিংবা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়েও রাজা পারভেজ আশরাফের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তি সব কিছুই যেন একই বৃত্তে সাজানো। 'নাটকের' যে এখানেই শেষ তা বলা যাবে না। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী দৃশ্য দেখার জন্য। এ মুহূর্তে সেটি স্পষ্ট নয়। ধারণা করাও সম্ভব নয় কী হতে যাচ্ছে পাকিস্তানে। এতদিন পাকিস্তানে দ্বন্দ্ব ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে সেনাবাহিনীর। এবার দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়েছে বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতে এবারের পরিবর্তনগুলো সাধিত হল। কিন্তু যারা পাকিস্তানের রাজনীতির কিছুটা খোঁজ-খবর রাখেন তারা ধারণা করছেন পর্দার অন্তরালে থেকে সেনাবাহিনী কলকাঠি নাড়াচ্ছে।
একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, অন্যদিকে খোদ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে 'তালেবানি' তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পাকিস্তানের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। আগের চেয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যরা পাকিস্তানের ব্যাপারে সোচ্চার। তারা বলছেন গত দশক ধরে দেশটিকে দেওয়া ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার অর্থ সহায়তা কোনো কাজেই লাগেনি। মার্কিন কংগ্রেসে এমন কথাও উঠেছে যে পাকিস্তানে সব ধরনের সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া উচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান সম্পর্কে যখন এ ধরনের একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে, ঠিক তখনই গিলানিকে অযোগ্য ঘোষণা করল উচ্চ আদালত। এর মধ্যে দিয়ে পাকিস্তান স্পষ্টতই একটি গভীর সংকটে পতিত হল।
কি হতে যাচ্ছে এখন পাকিস্তানে? সেখানে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পিপলস পার্টির নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সিনিয়র নেতা রাজা পারভেজ আশরাফ নয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি মজলিসে সুরার (সংসদ) সমর্থন পেয়েছেন। কেননা সেখানে কোয়ালিশন সরকারের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তবে শেষ রক্ষা হবে কি-না, বলা মুশকিল। তবে রাজা পারভেজ আশরাফের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তি সব প্রশ্নের জবাব দেয় না। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, যে কারণে গিলানি অভিযুক্ত হয়েছিলেন, সে ব্যাপারে নয়া প্রধানমন্ত্রী আদৌ কোনো উদ্যোগ নেবেন কি-না? পাকিস্তানের বর্তমান যে সংকট, তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি। পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টো যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন জারদারি অবৈধভাবে ১ কোটি ২০ লাখ ডলার ঘুষ নিয়েছিলেন এবং ওই টাকা সুইজারল্যান্ড পাচার করেছিলেন। এ নিয়ে পরে সুইজারল্যান্ডে তদন্ত শুরু হয়। কিন্তু স্ত্রী বেনজির ভুট্টোর বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু (২০০৭) জারদারিকে ক্ষমতার পাদ-প্রদীপে নিয়ে আসে। তিনি ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুইজারল্যান্ডের ওই মামলার তদন্ত কাজ স্থগিত করতে প্রভাব খাটান; কিন্তু পাকিস্তানের উচ্চ আদালত আবার মামলা শুরু করার ব্যাপারে সুইজারল্যান্ডকে অনুরোধ করতে গিলানির প্রতি নির্দেশ দেন। কিন্তু গিলানি উচ্চ আদালতের এ নির্দেশ অমান্য করেন। তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট দায়মুক্তি পেয়েছেন। তাই তার পক্ষে সুইজারল্যান্ড কর্তৃক্ষকে চিঠি লেখা সম্ভব নয়। এ যুক্তি উচ্চ আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এখন নয়া প্রধানমন্ত্রী আশরাফ কী করবেন? তিনি কী চিঠি লিখবেন সুইজ কর্তৃপক্ষের কাছে, নাকি গিলানির পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন? নয়া প্রধানমন্ত্রী যদি গিলানিকে অনুসরণ করেন, তাহলে তিনিও যে আদালত অবমাননার শিকার হবেন, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। উপরন্তু জারদারির ভূমিকা এখন কী হবে? তিনি কী রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যার সমাধান করতে পারবেন? গিলানি অযোগ্য হয়েছেন বটে, কিন্তু এর জন্য তিনি এতটুকুও দায়ী নন। ইফতেখার-জারদারির দ্বন্দ্বে বলি হলেন গিলানি। জারদারির একটা বড় ব্যর্থতা তিনি এ সংকটে পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতা নওয়াজ শরিফের সমর্থন পাননি। মূলত 'আদালত অবমাননার' পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন নওয়াজ শরিফ স্বয়ং এমনকি বিচার বিভাগের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে লাভবান হবে কোন ব্যক্তি? অত্যধিক ক্ষমতাবান সেনাবাহিনী তথা সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কেয়ানির ভূমিকাও বা কী এ সংকট? কিংবা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এ সংকট থেকে কোনো সুবিধা নেবে কি-না? এই সংকট থেকে বের হয়ে আসতে পাকিস্তান কী সাধারণ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? আগামী ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেখানে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। পাকিস্তানের ইতিহাস বলে অতীতে কখনই কোনো সরকার তার টার্ম (৫ বছর) শেষ করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে পিপিপির নেতৃত্বাধীন সরকার যদি এই টার্ম শেষ করে, তাহলে এটা হবে একটা রেকর্ড। এমন কি পাকিস্তানের রাজনীতিতে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের উত্থানের মধ্য দিয়ে যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে উচ্চ আদালতের এই রায়ের মধ্য দিয়ে আগামীতে ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তির পথ কী উন্মুক্ত হল? ইমরান খান রাজনীতিতে এসেছেন কিছুদিন হল। তিনি একটি দলও করেছেন-'তেহরিক ইনাসফ।' তার মূল সেস্নাগান হচ্ছে দুর্নীতিমুক্ত পাকিস্তান। উচ্চ আদালত গিলানির বিরুদ্ধে যে রায় দিয়েছেন, তার পেছনেও কাজ করছে এ দুর্নীতির প্রশ্নটি। এক সময় জারদারির পরিচিত ছিল 'মি. টেন পারসেন্ট' হিসেবে। স্ত্রী বেনজির ভুট্টো যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন বড় বড় কনটাক্ট তিনি পাইয়ে দিতেন অর্থের বিনিময়ে। ওই টাকায় তিনি দুবাইয়ে বিশাল বাড়ি কিনেছেন। সুইজারল্যান্ডে রয়েছে তার সম্পদ। তবে তার প্রতিপক্ষ নওয়াজ শরিফও 'ধোয়া তুলসি পাতা' নন। তার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আগামীতে উচ্চ আদালত যদি নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধেও কোনো রুল ইস্যু করে, আমি অবাক হব না। এর মধ্য দিয়ে তৃতীয় শক্তি হিসেবে ইমরান খান সামনে চলে আসছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ইমরান খানের মাঝে বিকল্প শক্তি দেখতে চাইবে। পরোক্ষভাবে ইসরায়েলের সঙ্গেও ইমরান খানের যোগাযোগ রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। ইসরায়েল অনেক দিন ধরেই চাইছে পাকিস্তান তাদের স্বীকৃতি দিক। এখন ইমরান খানকে যদি ক্ষমতায় আনা যায়, তাহলে ইসরায়েলের স্ট্র্যাটেজি তাতে স্বার্থক হবে। উচ্চ আদালতের রায় ইমরান খানের ইসলামাবাদে যাওয়ার যাত্রাপথকে আরো প্রশস্ত করছে কি-না, তা শুধু আগামী দিনগুলোই আমাদের বলতে পারবে। প্রশ্ন হচ্ছে এ রায় ইসলামী কট্টরপন্থিদের স্ট্র্যাটেজিতে আদৌ কি কোনো পরিবর্তন ডেকে আনবে? আমার তা মনে হয় না। পাকিস্তান বাহ্যত ধীরে ধীরে আরেকটি 'তালেবানি রাষ্ট্র'-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সীমান্তবর্তী পাখতুন খোয়া প্রদেশে সনাতন রাজনীতির কোনো প্রভাব নেই। এসব নিয়ন্ত্রণ করে পাকিস্তানপন্থি তালিবানরা। উত্তর ও দক্ষিণ ওয়াজিরস্থানসহ সমগ্র উত্তর পূর্ব সীমান্ত প্রদেশ এখন ইসলামিক কট্টরপন্থিদের নিয়ন্ত্রণে। এদের সঙ্গে আফগানিস্তানের তালিবানদের রয়েছে যোগাযোগ। পাকিস্তানের এ অঞ্চলে একটি ইসলামপন্থি দল স্থানীয় ক্ষমতা পরিচালনা করে বটে, কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে কট্টরপন্থিরা। তাই এখানে দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানববিহিন ড্রোন বিমান হামলা পরিচালনা করে আসছে। কট্টরপন্থিদের প্রভাব দিনে দিনে বাড়ছেই। পাঁচ ছয় বছর আগে পাকিস্তান সফরে গিয়ে কট্টরপন্থিদের যে 'শক্তি' আমি দেখেছিলাম আজও সেই 'শক্তি' কমেনি, বরং বেড়েছে। ইসলামবাদে গিলানি সরকারের পতন ঘটলেও, পাকিস্তানি তালেবানদের তাতে কিছু যায় আসে না। তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়ছেই।
পাকিস্তানে একটি পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তান একজন নয়া প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে। মনে রাখতে হবে আগামী ২০১৩-১৪ সাল পাকিস্তানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। এর ফলে কারজাই সরকার আদৌ কাবুলে থাকতে পারবে কি-না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। মডারেট তালিবানদের সঙ্গে (যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে) কারজাই সরকারের যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছিল, তা খুব বেশি দূর যেতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরিভাবে এ অঞ্চলে তার স্বার্থ পরিত্যাগ করবে, আমার তা মনে হয় না। ভারত মহাসাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে নতুন করে এক স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হতে যাচ্ছে। চীনকে 'ঘিরে ফেলার' এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করে যাচ্ছে। ভারত হচ্ছে তার সঙ্গী। এ ক্ষেত্রে স্ট্র্যাটেজিক্যালি পাকিস্তানের গুরুত্ব অনেক বেশি। একদিকে আফগানিস্তানে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর জন্য রসদ সরবরাহের পথ পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে। পাকিস্তান এ পথ (খাইবার উপত্যকা) বন্ধ করে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চিন্তার অন্যতম কারণ। ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য বেলুচিস্তানের বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে জরুরি। পাকিস্তানের প্রদেশ বেলুচিস্তান থেকে ইরান সীমান্ত মাত্র ৭২ কিলোমিটার দূরে। তৃতীয়ত, গাওদারের গভীর সমুদ্রে রয়েছে চীনা নৌবাহিনীর উপস্থিতি। ভারত মহাসাগরকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হলে বেলুচিস্তানের গাওদার পার্টির নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রয়োজন রয়েছে। সব মিলিয়ে তাই দরকার ইসলামাবাদে একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার। গিলানি সরকার মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করতে পারছিল না। তাই তাকে চলে যেতে হল। আগামীতে যিনিই আসবেন, তাকে মার্কিনি স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই স্বার্থ যদি রক্ষা করতে না পারে, তাহলে সেনাবাহিনীই হবে মার্কিনিদের বন্ধু। তথাকথিত 'গণতন্ত্র' পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেনি। ২ জন পূর্ণ জেনারেল, ২১ লেফটেন্যান্ট জেনারেল, আর ১৫০ মেজর জেনারেলকে নিয়ে পাকিস্তানের যে সেনাবাহিনী, সেই সেনাবাহিনীর দিকেই শেষ পর্যন্ত তাকাতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর 'নাটকের' এই দৃশ্যটি দেখার জন্য আমাদের আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে মাত্র।
Daily DESTINY
04.07.12

0 comments:

Post a Comment