সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হলেও, তাতে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। হিলারি কিনটনের বাংলাদেশ সফরের পর বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন চিন্তা-চেতনার জন্ম হয়েছিল মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে। কিনটনের সফরের সময় একটি ‘অংশীদারী সংলাপ’ চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিল, যার বিস্তারিত আমরা কিছুই জানি না। অভিযোগ আছে যুক্তরাষ্ট্র ‘চীনকে ঘিরে ফেলার’ যে স্ট্রাটেজি রচনা করছে, তাতে এই চুক্তি একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ‘আকসা’ চুক্তি নিয়েও কথা আছে। ‘আকসা’ চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর বাংলাদেশে উপস্থিতির সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রস্তাবিত এই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর জ্বালানি সংগ্রহ, যাত্রা বিরতি, সাময়িক অবস্থানসহ বিভিন্ন সুবিধার জন্য ‘পোর্ট অব কল’ সুবিধা পাবে। এই চুক্তি নিয়েও কথা আছে। প্রস্তাবিত এই চুক্তি বাংলাদেশে মার্কিন ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যদিও বাংলাদেশ এখনও চুক্তি সাক্ষরে রাজি হয়নি।
এমনি এক সময় আসলো দুর্নীতির প্রশ্নটি। বিশ্বব্যাংক মূলত ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর ও ২০১২ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ সরকারের কাছে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পেশ করে। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে অভিযোগের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপক আলোচিত দুটি অভিযোগের ব্যাপারে সরকার ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। একটি বাইরের প্যানেলের কাছে তথ্য দেয়ার এবং প্যানেলকে তদন্ত প্রক্রিয়ায় পর্যাপ্ততা মূল্যায়নের সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হলেও তা দুর্নীতি দমন কমিশন মেনে নেয়নি। এছাড়া তদন্ত চলকালে সরকারি দায়িত্ব পালন থেকে সরকারি ব্যক্তিবর্গকে (আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব) ছুটি দিতেও সরকার রাজি হয়নি। মূলত এ দুটো বিষয়ে ঐক্যমত না হওয়ায় বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। এখন সরকার সামনের নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতুটি নির্মাণ করতে যাচ্ছে। কেননা সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রতি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণের। কিন্তু সেতুর দীর্ঘস্থায়িত্বতা, টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি, বৈদেশিক মুদ্রার যোগান নিয়ে যে বড় প্রশ্ন ইতোমধ্যেই উঠেছে, তা সরকার একবারও ভেবে দেখেনি। এটা নিয়ে সরকার প্রধানের খামখেয়ালি, বারেবারে ড. ইউনূসকে জড়িত করার প্রক্রিয়া (একাধিকবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও বিশ্বব্যাংক থেকে অস্বীকার করা হয়েছে) বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে এই ভাবমূর্তি উদ্ধারে এতোটুকু উদ্যোগও লক্ষ করা যাচ্ছে না। সরকারের ভাবমূর্তি আজ কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, তা কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলেই বোঝা যাবে। গত ২০ জুলাই প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় একটি খবর ছাপা হয়েছে, মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেককে উদ্ধৃতি করে। লেখক বলেছেন, বাংলাদেশে হত্যা ও গুমের সাথে র্যাব জড়িত। এই বক্তব্য তিনি দিয়েছেন মার্কিন কংগ্রেসে। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মার্কিন সরকারের নীতি প্রতিফলিত হলো। এই বক্তব্য কোনো আশার কথা বলে না। এখন কংগ্রেসের কোনো সদস্য যদি বাংলাদেশ বিরোধী কোনো আইন কংগ্রেসে উপস্থাপন করে, আমি অবাক হবো না। সম্ভবত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা এ দিকটার দিকেই তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন বলিÑ সম্প্রতি বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় জার্মানিও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে এসেছিলেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওইডো ভেস্টারভেল। তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির উপস্থিতিতেই যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে এই কথাগুলো বলেছিলেন, যা সংবাদপত্রে ছাপাও হয়েছিল। একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতও। সবচেয়ে যা দুঃখজনক তা হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাপারে দাতা দেশগুলোর নেতিবাচক মনোভাবের কারণে বৈদেশিক সাহায্য প্রবাহেও এক ধরনের মন্থরতা সৃষ্টি হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায় গেল জুন পর্যন্ত (২০১২)। আমাদের বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি ছিল ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু মে পর্যন্ত গেল ১১ মাসে প্রতিশ্রুতি আদায় করা সম্ভব হয়েছে মাত্র ৪২৮ কোটি ৪২ লাখ ৪ হাজার ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের মতো কম প্রতিশ্রুতি। এখন পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির প্রশ্ন ওঠায় বিশ্বব্যাংকসহ অন্য দাতারাও যে অর্থ ছাড়করণের ব্যাপারে কিছুটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করবে, এটা স্বাভাবিক। বিশ্বব্যাংক ছাড়াও, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান বাংলাদেশকে বড় অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। এখন এই অর্থ প্রবাহে মন্থরতা আসবে। বিশ্বব্যাঙ্ক প্রায় ৩০টি প্রকল্পে অর্থ যুগিয়ে থাকে। ঐসব প্রকল্পগুলো নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠতে পারে। দাতাদের সাথে সম্পর্ক আরো নষ্ট হবে যদি সত্যি সত্যিই ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজ সরকার শুরু করে দেয়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিশ্রুতি দেয়া ১২০ কোটি ডলারের পাশাপাশি এডিবি ৬১ কোটি ডলার ও জাপান ১৪ কোটি ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছিল। এখন আর এদের থেকে ঋণ পাওয়া যাবে না। পদ্মা সেতুতে মোট খরচ ধরা হয়েছে ২৯০ কোটি ডলার, বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ ২৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা।
সরকার এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা দেশকে আগামী দিনে একটি বড় ধরনের ঝুঁকির মাঝে ফেলে দেবে। বাংলাদেশ বন্ধুহীন হয়ে যেতে পারে। শুধুমাত্র একজন মন্ত্রীকে বাঁচাতে (যায়যায়দিন) সরকারের এই সিদ্ধান্ত জাতিকে কড়া মূল্য দিতে হবে। এতে করে নির্মাণ খরচ বাড়বে। দক্ষতার প্রশ্ন উঠবে। সেতুর দীর্ঘস্থায়িত্ব একটি প্রশ্নের মুখে থাকবে। মালয়েশিয়ার প্রস্তাবও টেকসই নয়। বিশ্বব্যাংকের ঋণের সুদের চাইতে মালয়েশিয়াকে সূদ দিতে হবে অনেক বেশি। এটা কোন গোয়ার্তুমির বিষয় নয়। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তে শুধুমাত্র এক ধরনের গোয়ার্তুমিই প্রতিফলিত হয়নি, বরং বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকেও একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিল। কোন খাত থেকেই এই ২৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। চাঁদা তুলে, একদিনের বেতন দিয়ে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা কী সম্ভব? সরকার মূলত একটি ভাওতাবাজির আশ্রয় নিয়েছে। এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। এটা মূলত আওয়ামী লীগের একটি নির্বাচনী স্ট্রাটেজিÑ জনগণকে আশ্বাস দেয়া যে, পদ্মা সেতু হবে। আসলে এ সরকারের পক্ষে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব নয়
0 comments:
Post a Comment