ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন প্রণব মুখার্জি, প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে ‘চানৈক্য’ হিসেবে পরিচিত প্রণব মুখার্জির জন্য আমাদের সবার গর্ব হওয়ারই কথা। আমাদের নড়াইলের তিনি ‘জামাই বাবু’। আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার রয়েছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের অনেক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে তিনি ব্যক্তিগতভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। সেই সম্পর্ক আজও বজায় আছে। সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছিল, অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার ঢাকা সফরের সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে তাকে পায়েস রান্না করে খাইয়েছিলেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকেও তিনি ভোলেননি এতগুলো বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও। এ ধরনের একজন ব্যক্তিত্ব যখন ভারতের নয়াদিল্লির রাইসিনা হিলের রাষ্ট্রপতি ভবনে উঠলেন, তখন তো আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জানেন। ভারতীয় মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশের বিষয়টি তিনিই দেখভাল করতেন। অতীতে সমস্যাগুলোর ব্যাপারে তিনি যে একটা সমাধান বের করতে পেরেছিলেন, সে কথা আমি বলব না। তবে তার আন্তরিকতা নিয়ে কোন প্রশ্ন ছিল না। অর্থমন্ত্রী হিসেবে ক’মাস আগেও তিনি ঢাকা ঘুরে গেছেন। তখনও তিনি আমাদের আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন। বলেছেন, সমস্যার সমাধান হবে। ধৈর্য রাখতে হবে।
ভারত বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। ভারতের বৈদেশিক নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দ্বিপাক্ষিকতা, অথচ আমরা বিশ্বাস করি বহুপাক্ষিকতায়। আর ওই দ্বিপাক্ষিকতার কারণেই অনেক সমস্যার জট খুলছে না। একজন নীতিনির্ধারক হিসেবে প্রণব মুখার্জি এসব জানতেন। আগে কেবিনেটের একজন সদস্য হিসেবে তিনি যতটুকু প্রভাব রাখতে পারতেন, এখন তার সুযোগটি সীমিত। এখন তিনি রাষ্ট্রপতি, এখন আর কেবিনেট সদস্য তিনি নন। কোন নীতিনির্ধারণী সভায়ও তিনি থাকবেন না। তিনি এখন সবার অভিভাবক, রাষ্ট্রের এক নম্বর ব্যক্তি। রাষ্ট্রের এক নম্বর ব্যক্তি এককভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তার সেই সুযোগও নেই। সংবিধান তার ক্ষমতাকে সীমিত করে দিয়েছে। তিনি চাইলেও অনেক কিছু করতে পারবেন না। তবে আমরা তো প্রত্যাশা করবই। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি, ছিটমহল বিনিময়, বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে দু’দেশের মাঝে বিরোধ আছে। সমস্যার সমাধান হয়নি। এখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি নীতিনির্ধারণ করতে পারবেন না বটে, তবে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণের কাছে তার অভিমত তো রাখতে পারবেন।
তিস্তার পানিবণ্টনের ব্যাপারটি নিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। চুক্তি হচ্ছে না। এ সংক্রান্ত কোন দিকনির্দেশনা না থাকলেও, বিবিসির বাংলা বিভাগ (৯ মে) আমাদের জানাচ্ছে যে, তিস্তার পানিবণ্টনের ব্যাপারে আদৌ কোন চুক্তি হচ্ছে না। এ কথাটা নাকি দীপু মনিকে জানিয়েও দেয়া হয়েছে। যদিও দীপু মনি তা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত প্রতিশ্র“তি দিলেও এখন অবধি কোন চুক্তি হয়নি। এখানে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্যা। আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই। কিন্তু ভারত আমাদের সেই অধিকার নিশ্চিত করছে না। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও ভারত আমাদের বারবার মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং একাধিকবার বলেছেন, ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? নয়াদিল্লিতে ইতিমধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সেখানে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার। প্রায় ৯ হাজার কোটি রুপিও ব্যয় হয়ে গেছে। বাঁধটি যদি নির্মিত হয়, তাতে বাংলাদেশের কী ক্ষতি হবে, তা একাধিক সেমিনারে আলোচিত হয়েছে। এখানে আমাদের ব্যর্থতা আমরা শক্ত অবস্থানে যেতে পারছি না। জেসিসির যৌথ ইশতেহারে এ সংক্রান্ত কোন কথা বলা হয়নি। গঙ্গা চুক্তি আমরা করেছিলাম ১৯৯৬ সালে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। এর আগেই পদ্মায় পানি নেই। চুক্তি অনুযায়ী আমরা পানি পাচ্ছি না। ২০২৭ সালে লোকসংখ্যা বাড়বে ৩ গুণ। যে বিপুল পানির চাহিদা থাকবে, তার কী হবে? চুক্তি অনুযায়ী পর্যালোচনার সুযোগ আছে। কিন্তু সেই সুযোগটি আমরা নিচ্ছি কই? অতীতে কখনও আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করিনি। সীমান্ত হত্যা আজও বন্ধ হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও একের পর এক সীমান্ত হত্যা হচ্ছে। এমন কোন দৃষ্টান্ত নেই যেখানে বিজিবির গুলিতে কোন ভারতীয় নাগরিক মারা গেছেন। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন নিরপরাধ বাংলাদেশী নাগরিক। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ৪২ মাসে কতজন বাংলাদেশী মারা গেছেন, তার পরিসংখ্যান ‘অধিকার’-এর কাছে আছে। এ নিয়ে কত শীর্ষ বৈঠক হল। কিন্তু হত্যা বন্ধ হয়নি। প্রণব মুখার্জি যখন ঢাকায়, তখনও এটা নিয়ে কিছু বলা হল না। সীমান্ত চিহ্নিত ও অপদখলীয় ভূমির ব্যাপারেও প্রণব মুখার্জি মুখ খোলেননি ঢাকায়। গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি।
বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল ও ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের ব্যাপারে আমরা কিছুই শুনলাম না। ভারতের ভেতরে যারা রয়েছেন, তারা ভারতেই থাকতে চান। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের ভেতরে যারা রয়েছেন, তারা বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবেই থাকতে চান। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেই ১৯৭৪ সালে। তারপর কখনোই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার উদ্যোগ নেয়নি সংবিধান সংশোধন করার। সমস্যাটা তো আমাদের নয়। সমস্যাটা ভারতের। আজ প্রায় ৩৮ বছর পরও এ কথাগুলো আমাদের বলতে হয়। এতে কি ভারতের সদিচ্ছা প্রকাশ পায়? ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল ভারত। প্রণব মুখার্জি ঢাকায় এসে ২০ কোটি ডলার অনুদানের কথা বলে গেলেন। কিন্তু ঋণের টাকা দিয়ে তো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না? ১৩টি প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার অভাবে প্রকল্পগুলো আটকে আছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের রয়েছে বিশাল এক বাণিজ্য ঘাটতি। ২০০৯-১০ সালে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১০-১১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে। আর ২০১১-১২ সালের পরিসংখ্যান যখন আমাদের হাতে আসবে, ধারণা করছি তা ৪ বিলিয়ন ডলারের অংককে ছাড়িয়ে যাবে। ভারত মাঝে মধ্যে কিছু পণ্যের শুল্কমূল্য প্রবেশাধিকারের কথা বলে বটে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশ এসব পণ্যের অনেকগুলোই রফতানি করে না। ভারতের অশুল্ক বাধা দূর করা নিয়েও নানা কাহিনী আছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নানা ধরনের শুল্ক দূর করা যাচ্ছে না। ফলে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি সেই তুলনায় বাড়ছে না। শুধু ঘাটতি বাড়ছেই। এটা আমাদের জন্য শংকার কারণ।
ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি নিয়ে আদৌ কোন অগ্রগতি নেই। ২০১৩ সালে আমরা বিদ্যুৎ পাবÑ এ ব্যাপারটি আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। বাংলাদেশ বড় ধরনের বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে রয়েছে। বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন বন্ধ অনেক কারখানায়। অথচ ভারত যদি আন্তরিক হয়, তাহলে আমাদের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান সম্ভব।
মহাজোট সরকারের গত ৪২ মাসে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখব ভারতের পাল্লা ভারি, আমাদের প্রাপ্তি কম। আমরা ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছি (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডোর), কিন্তু ট্রানজিট ফি এখনও নির্ধারিত হয়নি। বলা হচ্ছে, ট্রানজিটের বিষয়টি বহুপাক্ষিকতার আলোকে দেখা হবে। কিন্তু দেখা গেল ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করছে, ভুটান বা নেপাল এখনও ট্রানজিট পায়নি। ভারতের এ দুটো দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার কথা। কিন্তু ইতিমধ্যে এই সুবিধা এই দুটো দেশকে নিশ্চিত করা হয়েছেÑ এ তথ্য আমাদের জানা নেই। আগামীতে ভারতের ‘সাত বোন’ রাজ্যগুলোও আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করবেÑ এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতাও স্বাক্ষরিত হয়েছে। অথচ আমাদের যে ন্যূনতম প্রাপ্তি, সে ব্যাপারে এতটুকু ভারতীয় উদ্যোগও আমরা লক্ষ্য করিনি। আজ তাই প্রণব মুখার্জি যখন ভারতের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছেন, আমরা চাইব তার প্রতি সম্মান দেখিয়েই ভারত সমস্যাগুলোর সমাধানে উদ্যোগ নেবে। প্রণব মুখার্জি বরাবরই আমাদের সম্যাগুলোর ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশ বরাবরই একটি ফ্যাক্টর। আগামীতে ২০১৪ সালে ভারতে সাধারণ নির্বাচন। ইউপিএ জোটে ভাঙনের আলামত শোনা যাচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেস পুনরায় ডিগবাজি খেয়ে যে বিজেপি শিবিরে যাবে না, তার কোন গ্যারান্টি নেই। সুতরাং ভারতীয় নেতৃবৃন্দেরই উচিত হবে সমস্যাগুলোর সমাধান করা। সমস্যাগুলোর সমাধান না হলে তা এক নির্বাচনী ইস্যু হতে পারে ভারতে। এমনকি বাংলাদেশে মহাজোট সরকারের জন্যও তা কোন ভালো সংবাদ হবে না।
ভারতের কংগ্রেসের রাজনীতিতে অত্যন্ত মেধাবী এই বাঙালি এখন রাইসিনা হিলের রাষ্ট্রপতি ভবনে। তিনি নিশ্চয়ই সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারককে এই পরামর্শটিই দেবেন যে বাংলাদেশের সঙ্গে বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধান করা হোক। আমরা বাংলাদেশীরা, প্রণব মুখার্জির রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণকে স্বাগত জানাই।
Daily JUGANTOR
28.7.12
0 comments:
Post a Comment