আয়মান
আল জাওয়াহিরির একটি ভিডিও বার্তা বাংলাদেশে বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম
দিয়েছে। আল কায়েদার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকা-ের পর আয়মান আল
জাওয়াহিরি বর্তমানে আল কায়েদার নেতৃত্বে রয়েছেন। গত বুধবার এ ভিডিও
বার্তাটি প্রচারিত হয়। এ বার্তায় জাওয়াহিরি বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারে আল
কায়েদার নিজস্ব সংগঠন গঠন করার কথা ঘোষণা করেছেন। সংগঠনটির নামকরণ করা
হয়েছে ‘কায়দাত আল জিহাদ ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিন্যান্ট’। জাওয়াহিরি
জানিয়েছেন, ভারতীয় উপমহাদেশে জিহাদের পতাকা তুলে ধরে আল কায়েদা ইসলামি শাসন
প্রতিষ্ঠা করবে। যে কোনো বিবেচনায় এ ধরনের ভিডিও বার্তা আমাদের জন্য
উদ্বেগের একটি বড় কারণ। বাংলাদেশ সরকার বিষয়টির ব্যাপারে কোনো বড় ধরনের
সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করলেও ভারতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে
কয়েকটি রাজ্যে, আসাম, গুজরাট ও কাশ্মীরে তারা নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়িয়েছে।
আল কায়েদা যে বাংলাদেশে তাদের তৎপরতা বাড়াতে চায়, এ ব্যাপারটি আমরা
দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ করে আসছি। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, গেল ফেব্রুয়ারি মাসে
জাওয়াহিরির নামে একটি ভুয়া অডিও বার্তা প্রচার করা হয়েছিল। রাসেল নামে
একজন ছাত্রকেও তখন গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ওই অডিও বার্তাটি ভুয়া প্রমাণিত
হলেও গত বুধবারের ভিডিও বার্তাটি যে আসল, তা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং যারা
সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কাজ করে, তারাও স্বীকার করে নিয়েছে। আমি নিজে ঝওঞঊ
ঞবৎৎড়ৎরংস গড়হরঃড়ৎরহম এৎড়ঁঢ় এবং ঞযব খড়হম ধিৎ ঔড়ঁৎহধষ ‘চেক’ করে দেখেছি,
সেখানে ভিডিও বার্তাটি স্থান পেয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, এই ভিডিও বার্তাটি
আসল। এরা সত্যতা না পেলে, তা প্রকাশ করে না। রাসেলের অডিও বার্তাটি এরা
প্রকাশ করেনি। প্রসঙ্গক্রমেই আল কায়েদা নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। এটি
সত্য, বিন লাদেনের মৃত্যুর (অথবা হত্যা!) পর আমি সংবাদপত্রে একাধিক নিবন্ধ
লিখেছি আল কায়েদার ভবিষ্যৎ স্ট্র্যাটেজি নিয়ে। আমি বলার চেষ্টা করেছি আল
কায়েদা তার স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তন এনেছে। যারা এই স্ট্র্যাটেজি সম্পর্কে
ধারণা না রাখেন, তাদের পক্ষে আল কায়েদা সম্পর্কে বলা ঠিক নয়। বাংলাদেশে
আল কায়েদার নেটওয়ার্ক কাজ করছে, এমন একটি কথা আমরা বেশ কিছুদিন ধরেই শুনে
আসছি। কিন্তু আমি গবেষণা করে দেখেছি আল কায়েদায় যে স্ট্র্যাটেজি, যেভাবে
তারা অপারেশন পরিচালনা করে, এখন অবদি বাংলাদেশে এমনটি দেখা যায়নি। আল
কায়েদার তাত্ত্বিক হচ্ছে আবু মুসাব আল সুরি। তার একটি গ্রন্থ রয়েছে।
গ্লোবাল রেজিস্ট্যান্স মুভমেন্ট। তার স্পাইডার ওয়েব (ঝঢ়রফবৎ ডবন) তত্ত্বটি
এখন ইসলামিক জঙ্গিদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। মাকড়সারা যেভাবে জাল বিস্তার করে
এবং জাল নষ্ট হয়ে গেলে অন্য জায়গায় গিয়ে জাল বোনে, আল কায়েদার সঙ্গে
সম্পৃক্ত জঙ্গিরা এভাবেই তাদের অপারেশন পরিচালনা করে। তবে ইয়েমেন থেকে শুরু
করে সিরিয়া পর্যন্ত তারা বেশ কিছু জঙ্গি সংগঠনকে তাদের সহযোগী সংগঠন বলে
মনে করে এবং তাদের সাহায্য করে। ২০০০ সালের পর থেকেই ওই অঞ্চলে গঠিত হয়েছে
অষ ছধবফধ রহ অৎধনরধহ চবহরহহংঁষধ, অষ ছধবফধ রহ ওংষধসরপ গধমযৎবন, অষ ছধবফধ রহ
ওৎধয়। এগুলো হচ্ছে আল কায়েদার স্থানীয় সংগঠন। এর বাইরে বেশ কিছু সংগঠন
রয়েছে, যাদের সঙ্গে আল কায়েদার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। যেমন- আল গামা আল
ইসলামিয়া (মিসর), আল নুসরা ফ্রন্ট (সিরিয়া) ইত্যাদি। গাদ্দাফী-পরবর্তী
লিবিয়া কিংবা তিউনিশিয়ায় এদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। সোমালিয়ার আল
সাহান কিংবা কেনিয়ার বোকো হারাম গ্রুপের সঙ্গেও রয়েছে এদের যোগাযোগ।
লিবিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ মালিতে ইতোমধ্যে এরা শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে। ইয়েমেনের
বিস্তীর্ণ অঞ্চল আল কায়েদার নিয়ন্ত্রণে, যে কারণে আলী আবদুল্লাহ সালেহ
পরবর্তী ইয়েমেনে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি এবং সেখানে এখনো ড্রোন বিমান হামলা
অব্যাহত রয়েছে। সুতরাং আল কায়েদার বাংলাদেশে স্ট্র্যাটেজি ও ভবিষ্যৎ
কর্মপন্থা বুঝতে হলে আমাদের আল কায়েদার ইতিহাস ও স্ট্র্যাটেজি বুঝতে হবে।
আল কায়েদা শরিয়াহ ভিত্তিতে দেশ চালানোর পক্ষে। নুসরা ফ্রন্ট সিরিয়ায় একটি
‘ইসলামিক আমিরাত’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এমনকি আফগানিস্তানের তালেবানের একটি
গ্রুপও আফগানিস্তানকে ‘ইসলামিক আমিরাত’-এ পরিণত করতে চায়। ইয়েমেনেও আর
কায়েদা তেমনটি চায়। এখন বাংলাদেশে যেসব সংগঠন আল কায়েদার সহযোগী সংগঠন
হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তারা কি আদৌ এ ‘রাজনীতিতে’ বিশ্বাস করবে? তারা
কি চায় দেশে শরিয়াহ আইন প্রবর্তিত হোক? বাংলাদেশে কিছু জঙ্গি সংগঠনকে
নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শায়েখ আবদুর রহমান কিংবা বাংলা ভাইয়ের উত্থান
নিঃসন্দেহে জঙ্গি তৎপরতাকে উৎসাহিত করেছিল। রাষ্ট্র এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
নিয়েছে। ৫টি জঙ্গি সংগঠনকে ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরা সবাই যে
আল কায়েদার ‘রাজনীতি’কে সমর্থন করে, তা নয়। অনেকের সঙ্গেই আল কায়েদার
তাত্ত্বিক মতপার্থক্য রয়েছে। দেশে জঙ্গি তৎপরতা এখন নিয়ন্ত্রিত। তাই
সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই আমার কাছে যে প্রসঙ্গটি বড় হয়ে দেখা
দিয়েছে তা হচ্ছে, জাওয়াহিরি কী বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতাকে উসকে দিলেন?
বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভিরু কিন্তু তারা অতীতে কখনো বা এখনো জঙ্গিবাদকে
সমর্থন করে না। বাংলাদেশ আফগানিস্তানে তালেবানি তৎপরতাকেও সমর্থন করেনি।
ঠিক তেমনি ইসলামের নামে যে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, তাও সমর্থন করে না। তাই
জাওয়াহিরি যখন জিহাদের কথা বলেন, এটিও সমর্থনযোগ্য নয়। বাংলাদেশ
আফগানিস্তান নয়; কিংবা বাংলাদেশের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকেও মেলানো
যাবে না। বাংলাদেশের ইসলাম আর ইরাক-সিরিয়ার ইসলাম এক নয়। আমাদের
নীতিনির্ধারকদের উচিত বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া। যদি সত্যিই এটি
প্রমাণিত হয় যে, জাওয়াহিরির এই বার্তার পর কোনো সংগঠন (হেফাজতে ইসলাম কিংবা
অন্য কেউ) এই বার্তাটি ব্যাপক প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে, তাহলে তাদের আইনের
আশ্রয়ে নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে উচ্চপর্যায়ে সতর্ক হওয়া উচিত। ভিডিও বার্তায়
যে বক্তব্য ছিল তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ববিরোধী। যারা
স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তারা দেশের শত্রু।
মুসলিম উম্মাহ নিয়ে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে
বঙ্গবন্ধু ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। এরপর শহীদ জিয়াউর রহমানের
সময় বাংলাদেশের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। সেই ধারাবাহিকতা
আজও অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ এমন কিছু করেনি যাতে মুসলিম উম্মাহর নামে
জিহাদি আন্দোলন করতে হবে। সুতরাং এটি স্পষ্ট, জাওয়াহিরি আমাদের একটি ভুল
মেসেজ দিতে চেয়েছেন। জিহাদের নামে জঙ্গিবাদকে উসকে দিয়ে এ দেশে ইসলামকে
শক্তিশালী করা যাবে না। ইসলাম আর জঙ্গিবাদ- এক নয়। বরং পরস্পরবিরোধী
বাংলাদেশকে আমরা জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাই না। এটি হবে
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। জঙ্গিবাদের প্রশ্নে আজ সবাইকে এক হতে হবে।
আমরা যেন পাকিস্তানের কথা ভুলে না যাই। পৃথিবীর বেশ কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ নিয়ে গবেষণা হয়। এরা নিয়মিত গবেষণাধর্মী জার্নাল
প্রকাশ করে। আমাদের উচিত বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের ধরন নিয়ে আরও গবেষণা করা।
প্রয়োজনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নিয়ে গবেষণা হতে পারে। যাতে করে আমাদের
নীতিনির্ধারকরা সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা রাখতে পারেন। এটি
স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিরা রয়েছে। এরা বিভিন্ন সংগঠনের
নামে এবং সংগঠনের ভেতরে কাজ করে। জেএমবি যে কত তৎপর, তার প্রমাণ আমরা
পেয়েছিলাম ত্রিশালে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ্যে পুলিশের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ
করে জেএমবির ক্যাডারদের ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায়। এ ঘটনাকে হালকাভাবে দেখার
কোনো সুযোগ নেই। আসামিদের এক জেল থেকে অন্য জেলে ট্রান্সফারের ঘটনা
স্বাভাবিক। কিন্তু জেএমবির ক্যাডার বলে কথা। তারা মৃত্যুদ-প্রাপ্ত। তাদের
যখন অন্য জেলে ট্রান্সফার করা হয়, তখন কি যথোপযুক্ত নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে
যাওয়া হয়েছিল? এ তথ্যটি সীমিত কিছু ব্যক্তির জানার কথা। তাহলে এ তথ্যটি
ফাঁস হলো কীভাবে? এটি তো ঠিক বাংলাদেশের বেশ কিছু ব্যক্তি আশির দশকে
আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন তালেবানদের পক্ষে দখলদার সোভিয়েত সৈন্যদের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ করার জন্য। এদের উদ্যোগেই তো জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ-এর মতো সংগঠনের
জন্ম হয়েছে। এদের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে সত্য, কিন্তু আরও
অনেকে আছেন, যারা জনসাধারণের মাঝে মিশে আছেন। আমি জানি না আমাদের গোয়েন্দা
সংস্থাগুলোর কাছে এদের পূর্ণ তালিকা আছে কি না? না থাকলে এ কাজটি এখন করা
উচিত। উপরে উল্লিখিত ঘটনাগুলো আমাদের নীতিনির্ধারকদের বেশ কিছু মেসেজ দিয়ে
গেল। নিশ্চয়ই তারা এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাববেন। জাওয়াহিরির বার্তাটি কোনো
অবস্থাতেই হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, কিছুদিন
আগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে দুটি সংগঠন
(গ্লোবাল রিলিফ ফাউন্ডেশন ও আল হারমাইন) আল কায়েদা থেকে ফান্ড পায়। আমি
জানি না, সরকার ওই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর কী ধরনের ব্যবস্থা ওই সংগঠন
দুটির বিরুদ্ধে নিয়েছে। আল কায়েদার বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবেই অত্যন্ত
ঘৃণার চোখে দেখা হয়। যেখানেই আল কায়েদা ঢুকেছে, সেখানেই সমাজ, সংস্কৃতি,
অর্থনীতি তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। সোমালিয়া আজ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। আর
পাকিস্তান সে পথেই যাচ্ছে। বাংলাদেশে আল কায়েদার একটি ভিডিওবার্তা প্রচারিত
হলো। যেদিন রাসেলের গ্রেপ্তারের খবর ছাপা হয়েছিল, সেদিনও আমরা বলেছিলাম-
আমাদের সতর্ক হতে হবে। যারা বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িত, তারা চায়
আল কায়েদা বাংলাদেশে আসুক। এখন জাওয়াহিরি আমাদের জানান দিলেন। জঙ্গিবাদ
আমাদের শত্রু। সবাইকে আজ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এক হতে হবে। আমাদের মধ্যে
বিভেদ থাকলে, জঙ্গিরা শক্তিশালী হবে মাত্র।
Daily Amader Somoy
06.09.14
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment