অতিসম্প্রতি
সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের বক্তব্য উল্লেখ করে লেখাটা শুরু করতে
চাই। ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ওই সংবাদে বলা হয়েছে_ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
অনার্স প্রথম বর্ষের জন্য ভর্তি পরীক্ষায় শতকরা ৮০ ভাগ পরীক্ষার্থী নূ্যনতম
পাস মার্ক তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ এবার এইচএসসি পাস করেছে ৮ লাখ ৮৫ হাজার
শিক্ষার্থী, যাদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭০ হাজার ৬০২ জন। এত বিপুলসংখ্যক
ছাত্র জিপিএ-৫ পেয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য নূ্যনতম পাস
নাম্বার পেল না? তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, এত বিপুলসংখ্যক জিপিএ-৫-ধারী
ছাত্রছাত্রী কোথায় যাবে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা মাত্র ৭০ হাজার।
বাকিদের ভাগ্যে কী আছে, যখন খোদ জিপিএ-৫-প্রাপ্তদের ভর্তিই নিশ্চিত নয়?
দেশে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে এবং এটাও সত্য, দেশে
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। ৩৭টি পাবলিক (দুটি এখনো কাজ শুরু করেনি)
আর ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের উচ্চশিক্ষা। এর বাইরে রয়েছে
৩৮টি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে নানা
অভিযোগ। সব না হলেও কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সার্টিফিকেট বাণিজ্য করছে। এটা
ইউজিসি বন্ধ করতে পারছে না। নানা জটিলতায় আটকে আছে সিদ্ধান্ত। ফলে অবৈধ
সার্টিফিকেট বাণিজ্য করে তারা লাখ লাখ টাকা আয় করছে। কিন্তু ক্ষতি করছে
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। পাস না করেও সার্টিফিকেট কেনা যায়। আর ওই
সার্টিফিকেটধারীরা দেশে বেকার সমস্যা বাড়াচ্ছে।
আমরা উচ্চশিক্ষা নিয়ে রীতিমতো জুয়া খেলছি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর
যে নজরদারি বাড়ানো দরকার তা মঞ্জুরি কমিশন করছে না। ইউজিসির নাম পরিবর্তন
হচ্ছে। জনবলও বাড়বে। সদস্য সংখ্যাও বাড়বে। তাতে করে কি উচ্চশিক্ষার মান
বাড়ানো যাবে? এতে করে সরকারের খরচ বাড়ল।
আমি অনেক দিন থেকেই বলে আসছি, শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেখভাল
করার জন্য আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান দরকার। উচ্চশিক্ষা কমিশন দিয়েও হতে পারে।
তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা একটি স্বাধীন শাখা থাকবে। এখানে
নূ্যনতম তিন থেকে চার জন সদস্য থাকবেন। আলাদা প্রশাসন থাকবে। না হলে মাত্র
একজন সদস্যকে দিয়ে (যা এত দিন হয়ে আসছে) ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
পরিচালনা করা সম্ভব নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে যুগের চাহিদা। এটা
আমরা অস্বীকার করতে পারব না। এখানে মালিকপক্ষের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে
হবে। একে 'ব্যবসায়িক কেন্দ্র' করা যাবে না। মালিকরা পুঁজি বিনিয়োগ করবেন
বটে, কিন্তু ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি থেকে তা তারা করবেন না। করবেন সামাজিক
দায়বদ্ধতা থেকে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে। কিন্তু
কী হচ্ছে ওই সেক্টরে? দারুল ইহসানের অবৈধ ক্যাম্পাস ৯৮টি। তারা বিজ্ঞাপন
দিয়ে বলছে সরকার তাদের অনুমতি দিয়েছে। অথচ ইউজিসির চেয়ারম্যান স্বয়ং বলছেন
আউটার ক্যাম্পাস অবৈধ। তাহলে কোন সাহসে এবং কাদের পরামর্শে এরা ছাত্র ভর্তি
করাচ্ছে? উচ্চ আদালতের নজরে কি আসছে না বিষয়টি? শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি পারে
না উদ্যোগী হয়ে চিরস্থায়ীভাবে আউটার ক্যাম্পাস বন্ধ করে দিতে? 'শর্ষের
মধ্যে যদি ভূত' থাকে তাহলে ভূত তাড়াব কীভাবে? প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয় দুটো?
দুজন ভিসি, তারা দাবি করছেন তারা অনুমোদিত। উত্তরার এশিয়ান ইউনিভার্সিটির
অবস্থা ভয়াবহ। শুধু সার্টিফিকেট বাণিজ্যই নয়, মালিকানা দাবি করেছেন দুই
ভাই। আরো ভয়াবহ শিক্ষকরা 'নোট' বিক্রি করেন এবং ছাত্রদের তা কিনতে বাধ্য
করেন। জন্মের পর থেকেই সাদেক সাহেব ভিসি। এখন তৈরি হচ্ছে তার ছেলে, তিনিও
ভিসি হওয়ার পথে। ওখানে পড়ায় কারা? কী তাদের ডিগ্রি। অবসরপ্রাপ্ত
কলেজশিক্ষকদের দিয়ে চলছে 'বিশ্ববিদ্যালয়'। এটা যেন একটা পারিবারিক ব্যবসা
কেন্দ্র। ইবাইস নিয়েও একই সমস্যা। মালিকপক্ষ একাধিক। মানি লন্ডারিংয়ের
অভিযোগ যার বিরুদ্ধে তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক-মোক্তার। যিনি
মার্কিন দূতাবাসে চাকরি করতেন, তিনিও এখন ভিসি
কিছু দিন আগে একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল_ ১৩ শতাংশ
শিক্ষকের (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষা সনদ জাল। আমার মনে হয়, এ সংখ্যা
আরো বেশি হবে। ভুয়া পিএইচডি নিয়ে চাকরি নিয়েছেন অনেকে। আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের
এমনি এক ভুয়া পিএইচডির খবর আমি নিজে কর্তৃপক্ষকে দিয়েছি। কিন্তু তাতে
পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির
পিএচইডি ডিগ্রি জাল। আমি অন্তত দশজন ভিসির নাম বলতে পারব যারা কোনো দিন
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতা না করেই 'অধ্যাপক' পদবি ব্যবহার করছেন। কী
দুর্ভাগ্য এ জাতির। দেখার কেউ নেই। অভিভাবকরা অসহায়। তারা একরকম বাধ্য হয়েই
তাদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন।
উচ্চশিক্ষা নিয়ে এই ছিনিমিনি খেলা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন
করে কিছু লোকের চাকরির সংস্থান হবে বটে (তাও আবার রাজনৈতিক বিবেচনায়),
কিন্তু উচ্চশিক্ষার তাতে মানোন্নয়ন ঘটবে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও
উচ্চশিক্ষায় ধস নেমেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চশিক্ষায় অনিয়মের খবর
উপাচার্য মহোদয়রা অবহিত হয়েও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার 'স্বার্থে' তারা
নিশ্চুপ। এখানেও তারা 'কমপ্রোমাইজ' করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ১৩ লাখ লোকের ইন্টারভিউ নিয়ে পিএইচডি অভিসন্দর্ভ
রচনার কাহিনী সবার মুখে মুখে। কিন্তু বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক এখনো 'দ্বিগুণ
উৎসাহে' আরো পিএইচডি ছাত্র নিচ্ছেন। রাজশাহী ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের
'পিএইচডি কাহিনী' আরেক দিন বলা যাবে। এ মুহূর্তে বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। যা করা খুব জরুরি তা হচ্ছে
অবিলম্বে একটি 'এক্সিডিটেশন কাউন্সিল' গঠন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর
মান নির্ধারণ করে দেয়া, যাতে করে অভিভাবকরা 'মান' দেখে তার সন্তানকে
'ভালো' একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারেন। সেই সঙ্গে বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের 'ডাটাবেজ' তৈরি করা জরুরি, যাতে ভুয়া
পিএইচডিধারীদের চিহ্নিত করা যায়। আমি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশে
একটি শাখা স্থাপনেরও পক্ষপাতী। এতে আমাদের লাভ দুটো_ এক. আমাদের সন্তানরা
পড়াশোনার একটা অংশ বিদেশে গিয়ে পড়তে পারবে। দুই. বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ভালো শিক্ষক নিয়োগ দেবে
এবং তাদের শিক্ষার মান বাড়ানোর উদ্যোগ নেবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের
মালিকপক্ষ আবার এর বিরুদ্ধে। তারা 'ব্যবসা হারানো'র আশঙ্কা করছেন। তারা
পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন। এখন পুঁজি বাড়াতে চান। তাদের অনুরোধ করি, আপনারা
গার্মেন্ট, আলু-পটোল ব্যবসায় বিনিয়োগ করুন। বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়।
শিক্ষকতায় একটি 'পরিণত বয়সে' এসে মনে হয়েছে এ সেক্টরটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে
শুধু আমাদের নেতৃত্বের অভাবে। আমাদের কোনো 'ভিশন' নেই। আমরা ২০২১ সালে
বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে চাই। কিন্তু আমরা সেই নেতৃত্ব
কি প্রতিষ্ঠা করতে পারছি যারা আমাদের একুশ শতকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত
করার 'রূপকল্প' তৈরি করবেন? আমরা লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট ও মাস্টার্স ডিগ্রি
তৈরি করছি, যারা মেধাহীন। নেতৃত্ব দেয়ার 'কোয়ালিটি' তাদের নেই। পাবলিক
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও পারছে না রাজনৈতিকভাবে নিয়োগকৃত ভিসিদের কারণে। আমরা
একটা সার্টিফিকেট-সর্বস্ব জাতিতে পরিণত হতে যাচ্ছি। ঘরে ঘরে এখন মাস্টার্স
আর বিবিএ।
একজন এসআইও এসেছিল আমার কাছে পিএইচডি করতে। ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা বেড়েছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এদের সবাইকে ধারণ করতে পারে না বিধায়ই বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সার্টিফিকেট 'বিক্রি'র প্রতিষ্ঠান খুলে আর যাই হোক
উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন করা যায় না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই থাকবে। কিন্তু সেখানে ইউজিসির নিয়ন্ত্রণ
বাড়ুক। ব্যক্তিগতভাবে ইউজিসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি তিনি
আন্তরিক। তিনি চান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সার্টিফিকেট বাণিজ্য করবে
না। কিন্তু ফাঁক-ফোকর দিয়ে এসব বিশ্ববিদ্যালয় বেরিয়ে যাচ্ছে। আর হাজার
হাজার ছাত্রছাত্রী ওইসব অবৈধ সার্টিফিকেট নিয়ে উচ্চশিক্ষিত বেকার সমস্যাকে
আরো জটিল করছে। অথচ নূ্যনতম ডিগ্রি নিয়ে (গ্র্যাজুয়েশন) তারা 'জব মার্কেটে'
যেতে পারে। পরিকল্পনাহীনভাবে আমাদের সন্তানরা বিবিএ পাস করছে। বিবিএর জন্য
যে মেধা ও জ্ঞান দরকার তা তাদের নেই। ফলে তারা একেকজন তথাকথিত বিবিএ
ডিগ্রিধারী হয়ে 'ভদ্র কেরানিতে' পরিণত হয়েছে। এর আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই।
আসলে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই উচ্চশিক্ষা পরিচালিত হচ্ছে। জিপিএ-৫ নিয়েও
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছে না অনেকে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে জিপিএ-৫
বাড়ানোর সিদ্ধান্তই ছিল ভুল। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির সংবাদটি
আমাদের জন্য চিন্তার কারণ। নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি নিয়ে ভাববেন, এটাই আশা
করি।
Daily Jai Jai Din
16.09.14
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment