রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পাসের হার বাড়িয়ে শিক্ষার মান বাড়ানো যায় না

আমাদের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। একসময় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল তার। সেসব এখন অতীত। এখন তিনি আর সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন না। পুঁজিবাদী রাজনীতির তিনি সমর্থক। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিজেকে জড়িত করেছেন অনেক আগেই। মন্ত্রী হয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী। শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে চান তিনি। কিন্তু মানোন্নয়নের নামে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীকে তিনি ও তার প্রশাসন যে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, তা আমরা কেউ ভাবছি না। গত ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির এক অনুষ্ঠানে তিনি গর্ব করে বললেন, দেশে শুধু পরীক্ষার পাসের হারই বাড়েনি, শিক্ষার মানও বেড়েছে। অর্ধসত্য আমাদের শিক্ষামন্ত্রী। পাসের হার বেড়েছে। এখানে তিনি সঠিক তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু মানও বেড়েছে এখানে তিনি সত্য কথাটা বলেননি। আসুন, পরিসংখ্যানের দিকে চোখ বুলানো যাক।এবার এইচএসসি পাস করেছে ৮ লাখ ৮৫ হাজার শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি আসনে এবার লড়বে ১০০ জন শিক্ষার্থী। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা ৭০ হাজার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় থাকা কলেজগুলোতে অনার্সে আসন সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। ৭৯ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা ৮০ হাজার। ৩৮ মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে আসন রয়েছে ৪ হাজার। বুয়েটের আসন ১ হাজার। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭০ হাজার ৬০২ জন। এখন অংকটা করে দেখা যেতে পারে কতজন শিক্ষার্থী এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে। দেশে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। মোট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৩৭টি। আর ছাত্রছাত্রী ভর্তি হবে ৩৫টিতে। চট্টগ্রাম মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনও চালু হয়নি। অথচ এর চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পর সমুদ্রবিদ্যায় দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে এটি চালু করতে হবে।শিক্ষামন্ত্রী পাসের হার বাড়ানোর জন্য গর্ব করলেন। কিন্তু আসুন, এই জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কাহিনী শুনি। মাননীয় মন্ত্রী যেদিন ডিআরইউতে গর্ব করছেন, সেদিনই একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে এক করুণ কাহিনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম পর্বে ভর্তি পরীক্ষার প্রথম দিনের ফলাফল- শতকরা ৮০ ভাগ পরীক্ষার্থী ন্যূনতম পাস নম্বর তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। মাননীয় মন্ত্রীর শিক্ষার মান এখন থাকল কোথায়? এটা আমরা এখন মোটামুটি সবাই জেনে গেছি, এইচএসসিতে পাসের হার বাড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ ছিল। জিপিএ-৫ কি এখন ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটা বোঝা হয়ে গেল না! জিপিএ-৫ তাকে কী দেবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বর তারা পেল না? এজন্য শিক্ষামন্ত্রী কী কৃতিত্ব নেবেন? মাননীয় মন্ত্রী, ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষ অনার্সে ২ লাখ ১৭ হাজার ৮৯১ জন পরীক্ষা দিয়েছিল। পাস নম্বর পেতে ব্যর্থ হয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার, অর্থাৎ মোট শিক্ষার্থীর ৮১ ভাগই ন্যূনতম পাস নম্বর পায়নি। মাননীয় মন্ত্রী এর ব্যাখ্যা আপনি কী দেবেন?মাননীয় মন্ত্রী, শিক্ষার মান বাড়ছে বলে আপনি যখন গর্ব করেন, তখন আপনাকে আমি সমর্থন করতে পারি না। বাস্তবতা হচ্ছে শিক্ষার মানের প্রচণ্ড অবনতি হয়েছে। জিপিএ-৫ এখন গলার কাঁটা। এই জিপিএ-৫ এখন হাসির ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আপনার সরকার দেশে ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। এটা নিয়েও আপনার গর্ব হতে পারে। কিন্তু এর মাঝেও আমি কোনো কৃতিত্ব দেখি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানো যাবে না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি করে ফেলেছি ইতিমধ্যে। রাজনৈতিক বিবেচনায় শত শত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এক বিষয়ের শিক্ষক অন্য বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শিক্ষকদের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত হয়নি। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। এমনকি তরুণ শিক্ষকদের দায়বদ্ধতাও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। তরুণ প্রজন্ম শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসেবে বেছে নেয়নি। তাই উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। ভালো শিক্ষক না হলে ভালো ছাত্র তৈরি হয় না, মন্ত্রী হিসেবে তো এটা আপনার জানার কথা।উচ্চশিক্ষা নিয়ে মাননীয় মন্ত্রীর কাছে পূর্ণ চিত্র আছে কী না সন্দেহ। একদিকে ভালো ছাত্ররা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকায় যেমন শিক্ষকতায় আসতে পারছে না, অন্যদিকে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা তাদের অবসরের বয়সসীমা ৬৭-তে উন্নীত করায় এখানেও তৈরি হয়েছে বৈষম্য। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন হচ্ছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থের জোগানদাতা। সেই মঞ্জুরি কমিশনই যখন অবসরের বয়সসীমা ৬৭ নিয়ে আপত্তি তুলেছে, তখন কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এটা বাস্তবায়ন করে কীভাবে? এখানে মানসম্মত উচ্চশিক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। নেয়া হচ্ছে দলীয় আনুগত্য আর রাজনীতির বিষয়টি। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপিপন্থী শিক্ষকরা। উচ্চশিক্ষা নিয়ে আরও কিছু কথা বলা দরকার। প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই এখন ঢালাওভাবে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে। কিন্তু কারা করছে পিএইচডি? পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা, সিনিয়র জেনারেল আর সচিবরা এখন পিএইচডি করছেন। যে কেউ, তার যদি মেধা থাকে, তিনি পিএইচডি করতেই পারেন। কিন্তু আমরা ভুলে যাই পিএইচডি একটি গবেষণা। গবেষককে ছুটি দিতে হয়। লাইব্রেরিতে যেতে হয়। ফিল্ড ওয়ার্ক করতে হয়। কেইস ওয়ার্ক করতে হয়। লাইব্রেরিতে না গিয়ে, ফিল্ড ওয়ার্ক না করে, ফুলটাইম অফিস করে কি গবেষণা হয়? এটি দেখার কেউ নেই। মাননীয় মন্ত্রীর কাছেও সঠিক তথ্যটি নেই। ফলে উচ্চশিক্ষার নামে আমরা শুধু মাস্টার্সধারীদের সংখ্যাই বাড়াচ্ছি না, এখন আবার পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের সংখ্যাও বাড়াচ্ছি। ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারীও রয়েছে। এরা আবার স্বনামে কার্ড ছাপিয়ে তা বিলিও করছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এটা দেখে না। মাননীয় মন্ত্রীর সময় নেই। আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা বয়সের ভারে ক্লান্ত, অবসন্ন! কাজটি তাহলে কে করবে?অপরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা। কোন কোন সেক্টরে আমাদের কত গ্রাজুয়েট দরকার, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। ফলে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বিবিএর মতো বিষয়ে সার্টিফিকেট নিচ্ছে এবং তারা এখন বেসরকারি খাতে ভদ্র কেরানীতে পরিণত হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও আমাদের চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। সেটিও আমরা করছি না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে ঘরে ঘরে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী তৈরি করে আর যাই হোক আমরা শিক্ষার মান বাড়াতে পারিনি। কোটা ব্যবস্থা নিয়েও চিন্তা করার সময় এসেছে। যেখানে জিপিএ-৫ নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হতে পারছে না, সেখানে কোটার কারণে ভর্তি হচ্ছে শত শত শিক্ষার্থী। অযোগ্য এসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে জাতীয় জীবনে কোনো অবদান রাখতে পারছে না। বরং এরা জাতির জন্য বোঝাস্বরূপ। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আবার পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। এদিকেও দৃষ্টি দেয়া দরকার। মাননীয় মন্ত্রীর সময় কই?জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের শতকরা ৮০ জন যখন ন্যূনতম পাস নম্বর তুলতে ব্যর্থ হয়, তখন সত্যিকার অর্থে বিষয়টা আমাদের ভাবায়। পাসের হার বাড়িয়ে দেখানোর মাঝে কোনো কৃতিত্ব নেই। উত্তরপত্রগুলো সাধারণভাবে মূল্যায়ন করা ও নম্বর বাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। এখন অভিভাবকরা বুঝতে পারবেন জিপিএ-৫ পাওয়া তার সন্তানটি তার জন্য বোঝা হয়ে গেল। ওইসব শিক্ষার্থীদের মাঝে এক ধরনের হতাশা এসে যাবে, যখন জিপিএ-৫ নিয়েও তারা কোথাও ভর্তি হতে পারবে না। এসব বিষয় নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিন্তাভাবনা করা উচিত। আমার ধারণা তাকে যারা পরামর্শ দেন, সঠিক পরামর্শটি তারা দেন না। মাননীয় মন্ত্রী নিশ্চয়ই এটি উপলব্ধি করবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ১৭ তারিখ থেকে শুরু হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগরে। আমার ধারণা জাহাঙ্গীরনগরের ক্ষেত্রেও আমরা একই চিত্র দেখতে পাব। তাই সিদ্ধান্তটি নেয়ার সময় এখনই। Daily JUGANTOR ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

0 comments:

Post a Comment