কয়েকটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। চেন্নাই হয়ে কলকাতা, অতঃপর বাংলাদেশের মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্র উপকূল পথকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত বিস্তার ঘটানো। এটা হয়তো ভালো। তাতে বাংলাদেশ-ভারত সামুদ্রিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে। এতে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে, তা ভবিষ্যতের ব্যাপার। সিঙ্গাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত এই বাণিজ্য রুট (?) বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কতটুকু আকৃষ্ট করতে পারবে, এটাও একটা প্রশ্ন। বাংলাদেশ ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য একাধিক রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এটা কি গ্রহণ করবেন? মনে হয় না। কারণ তাঁরা চান ব্যবসা করতে। সহজ-সরল কথায় জিনিস বিক্রি করতে। পুঁজি বিনিয়োগ তাঁরা করবেন না। ফলে বাংলাদেশের ওই প্রস্তাব কাগজ-কলমে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। গুয়াহাটি-শিলং-ঢাকা বাস সার্ভিস চালুর বিষয়টি কিংবা মৈত্রী ট্রেনের বগির সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টি আগেই আলোচিত হয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়; কিন্তু মৈত্রী ট্রেনে কেন যাত্রী বাড়ছে না, বিষয়টি তলিয়ে দেখা হয়নি। বাংলাদেশি যাত্রীরা মৈত্রী ট্রেনের যাত্রা পছন্দ করে; কিন্তু 'যাত্রী হয়রানি' বন্ধ না হলে বগির সংখ্যা বাড়িয়েও কোনো লাভ হবে না। গুয়াহাটি-শিলং বাস সার্ভিস শুনতে ভালো শোনায়; কিন্তু এ রুটের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কে করবে? কবে হবে এসব কাজ। এসব ব্যাপারে কি কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে? ভাঙা পথে এসি বাস চললে, তাতে যাত্রী পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় রয়েছে অনেক। তিস্তার পানিবণ্টন, টিপাইমুখ বাঁধ, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, স্থল সীমানা নির্ধারণ, শুল্ক কমানো ও বাংলাদেশি পণ্যের পরিমাণ বাড়ানো, ভারতের আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প, বন্দিবিনিময় ইত্যাদি। কোনো একটি বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট 'সিদ্ধান্ত' নেই। যৌথ ইশতেহারে বলা হয়েছে, তিস্তার পানি ভাগাভাগির বিষয়ে আগের প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকবে ভারত। এটা কূটনীতির ভাষা। এটা আশ্বাস। এই আশ্বাসে আমাদের সন্তুষ্ট হওয়ার কথা নয়। আমরা আমাদের ন্যায্য হিস্যা চাই। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্যা মমতা ব্যানার্জিকে নিয়ে। মমতার জন্য তিস্তার পানি একটি 'রাজনৈতিক ইস্যু'। ২০১৬ সালে বিধানসভার নির্বাচন। লোকসভার নির্বাচনে তৃণমূলের পক্ষে বেশি ভোট পড়েছে। সুতরাং তিস্তা তাঁর জন্য একটা ইস্যু। এটা তিনি আবারও ব্যবহার করবেন। দিল্লিকে তিনি ছাড় দেবেন না এতটুকুও। তবে সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে তিনি বেকায়দায় আছেন। তৃণমূল-জামায়াত সম্পর্কের বিষয়টি মাহমুদ আলী-অজিত দোভালের আলোচনায় এসেছে। সিবিআই তদন্ত করছে। এখন এই সারদা কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র কিভাবে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করবে, এটা দেখার বিষয়। তবে ২০১৬ সালের আগে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে কোনো সমঝোতার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ভারতীয় অনলাইন সংবাদ সংস্থা ২৪ ঘণ্টা ২১ সেপ্টেম্বর আমাদের জানিয়ে দিয়েছে 'তিস্তার জল ও স্থল সীমান্ত চুক্তি নিয়ে জটিলতার অবসান হয়নি।' সীমানা চিহ্নিত করার একটি উদ্যোগ নিয়েছিল সাবেক মনমোহন সরকার। রাজ্যসভায় একটি বিলও উপস্থাপিত হয়েছিল। এখন বলা হচ্ছে, তা এখন আছে স্থায়ী কমিটিতে। আর তিস্তা নিয়ে বলা হয়েছে, 'সব দলের (অর্থাৎ তৃণমূলের সঙ্গে!) সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছার চেষ্টা চলছে।' অর্থাৎ আশ্বাস। চেষ্টা চলছে! এসবই কূটনীতির ভাষা। বলা ভালো, বাংলাদেশের ভেতরে রয়েছে ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল আর ভারতে রয়েছে ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল। এদের কেউ ভারতের সঙ্গে থাকতে চায়, কেউ চায় বাংলাদেশের সঙ্গে থাকতে। স্থানীয় বিজেপি আবার এর বিরোধী। আসাম বিজেপিও স্থল সীমানা চিহ্নিতকরণের পক্ষে নয়। ফলে সংবিধান সংশোধনের জন্য আনীত বিল রাজ্যসভায় এবং পরে লোকসভায় অনুমোদিত হবে- এটা দেখার জন্য আমাদের আরো বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। স্থল সীমানা চিহ্নিতকরণের সঙ্গে ভারতীয় সংবিধানের সংশোধন প্রশ্নটি জড়িত।
আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের বিষয়ে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হয়- এমন কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছে ভারত সরকার। এটা বাংলাদেশিদের জন্য সুখকর। আমরা এটা জেনেছি একটি সংবাদমাধ্যমের নয়াদিল্লি থেকে পাঠানো প্রতিবেদন থেকে। কিন্তু যত দূর জানা যায়, মোদি ক্ষমতা গ্রহণ করে আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ও আছে মোদির পক্ষে। বাংলাদেশ আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হবে সে কথা বারবার বলে আসছে। এখন প্রকাশিত বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। সত্যিকার অর্থেই ভারত যদি এই প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে না যায়, তাহলে তাতে ভারতের পরিবেশবাদীরাই যে খুশি হবেন, তা নয়। বরং বাংলাদেশ বড় ধরনের পানি সংকট থেকে রক্ষা পাবে। একই কথা প্রযোজ্য টিপাইমুখ বাঁধের ক্ষেত্রেও। মোদি সরকার সাবেক মনমোহন সিং সরকারের দেওয়া বক্তব্যই উল্লেখ করেছে মাত্র। তাদের ভাষায়, ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভারতে ইতিমধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে এবং ভারত সরকার ৯ হাজার কোটি রুপি খরচও করে ফেলেছে। এ অর্থ তাহলে ব্যয় হলো কোথায়? গঙ্গা চুক্তি নিয়েও আলোচনার প্রয়োজন আছে। কেননা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে না। চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। জনসংখ্যা তখন বাড়বে তিন গুণ। পানির চাহিদাও বাড়বে। সুতরাং চুক্তিতে পর্যালোচনার যে সুযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের উচিত এ ব্যাপারে ভারতকে রাজি করানো। অনুপ চেটিয়াকে (উলফা নেতা ও বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী) ফেরত দেওয়া ও নূর হোসেনকে (নারায়ণগঞ্জ সাত খুনের আসামি) ফেরত আনার বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে। নূর হোসেন কলকাতায় একটি অপরাধ করেছেন। সেই অপরাধে তাঁর বিচার হচ্ছে। এখন বিচার চলাকালে তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো যাবে কি না, এটা একটা আইনগত প্রশ্ন। তবে অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে এ বিষয়কে মেলানো যাবে না। অনুপ চেটিয়া নিজেই ভারতে যেতে চেয়েছেন। সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও। সিদ্ধান্ত হয়েছে সীমান্তবর্তী জেলার জেলা প্রশাসকরা অক্টোবরে দিল্লিতে মিলিত হবেন; কিন্তু তাতে সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে কি? যেদিন জেসিসির বৈঠক চলছে, সেদিনও বিএসএফের গুলিতে তিনজন বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। মোদির নেপাল, ভুটান, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশকে নিয়ে উপ-আঞ্চলিক জোটের যে ধারণা, তাতে মিয়ানমারের অন্তর্ভুক্তিও চাচ্ছেন। এতে নতুন একটা জোট গঠিত হতে পারে; যদিও বিসিআইএম জোট (বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার) কাজ করছে এবং বাংলাদেশ এই জোট কার্যকর করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে। এখন মোদির প্রস্তাবিত নয়া জোটের সঙ্গে বিসিআইএমের কী ভূমিকা থাকবে সেটা একটা প্রশ্ন হয়েই থাকবে। দুই দেশের বাণিজ্য ছয় বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে; কিন্তু ভারতে বাংলাদেশের পণ্যের সম্প্রসারণে কোনো উদ্যোগের কথা বলা হয়নি। ট্যারিফ ও প্যারা-ট্যারিফের কারণে বাংলাদেশি পণ্য ভারতে বাজার পাচ্ছে না। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ব্যাপারে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। আমরা ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছি। আরো ৫০০ মেগাওয়াটের প্রতিশ্রুতি মিলেছে। আসলে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করতে হবে আঞ্চলিক ভিত্তিতে। বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও ভারত সম্মিলিতভাবে বিনিয়োগ করে হিমালয় অঞ্চলে বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে; কিন্তু ভারত এটা করছে দ্বিপক্ষীয়ভাবে।
ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জেসিসি বৈঠকে যোগদান এবং ভারত সফর কোনো বড় ধরনের সফলতা বয়ে আনতে পেরেছে- এটা বলা যাবে না। আমরা আশ্বাস পেয়েছি। এ ধরনের আশ্বাস আমরা আগেও পেয়েছিলাম। এ ক্ষেত্রে সরকার পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশের ব্যাপারে মোদি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে- এটা বলা যাবে না। তবে আলাপ-আলোচনায় তথাকথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর প্রসঙ্গটি ভারতীয় পক্ষ উপস্থাপন করেনি। মোদি নির্বাচনের আগে ও পরে একাধিকবার এই প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন।
একুশ শতকে বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্রভূমি হবে এশিয়া। দুটি বড় অর্থনৈতিক শক্তি ভারত ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক, সেই সঙ্গে জাপানের ভূমিকা এ অঞ্চলের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। জেসিসির বৈঠকের সময়ই চীনের প্রেসিডেন্ট ভারত সফরে এসেছিলেন। এর আগে বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী। এ অঞ্চল যে গুরুত্ব পাচ্ছে এটা এর বড় প্রমাণ। ভারত বড় শক্তি। আমাদের উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর আস্থার সম্পর্ক যদি গড়ে তোলা না যায়, তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। ভারতের মনোভাবের পরিবর্তন তাই জরুরি। বাংলাদেশ শুধু এককভাবে দিয়ে যাবে; কিন্তু ভারতের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতা আমরা পাব না- এ প্রবণতা সন্দেহ সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট।
Daily Kaler Kontho
24.09.14
0 comments:
Post a Comment