|
image : daily sun |
প্রধানমন্ত্রীশেখ হাসিনার চীন সফরের প্রাক্কালে একটা প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে আলোচিত হয়েছিল, আর তা হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীনের মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে কি না এবং চীন এ প্রশ্নে কোনো মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করবে কি না? গত ১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী তাঁর চীন সফর শুরু করলেও বেইজিংয়ে সরকারি পর্যায়ে তিনি আলাপ-আলোচনা শুরু করেন ৩ জুলাই। দুই দিন এ আলোচনা চলবে। প্রধানমন্ত্রী চীনের প্রধানমন্ত্রীসহ চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও দেখা করবেন এবং দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হবেন। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় রোহিঙ্গা প্রশ্নটি যে আলোচিত হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু তা-ই নয়, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন, তাতে তিনি এটা স্পষ্ট করেছিলেন যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় রোহিঙ্গা সমস্যা স্থান পাবে। চীন বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার হচ্ছে চীন। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা, যারা মিয়ানমারের নাগরিক, তাদের বাংলাদেশে উপস্থিতি বাংলাদেশের স্থিতিশীলতাকে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে প্রবেশ এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশ বারবার আন্তর্জাতিক আসরে এ কথাটাই বলে আসছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এটা এখন উপলব্ধি করতে পেরেছে। সে কারণে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রপ্রদায়ের ‘চাপ’ও বাড়ছে। চীন এটা জানে ও বোঝেও। চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের দীর্ঘ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে চীন বরাবরই রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারকে সমর্থন জানিয়ে আসছে। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে চীন মিয়ানমারের পাশেই ছিল এবং মিয়ানমারের বক্তব্য সমর্থন করে আসছিল। তবে সাম্প্রতিককালে রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীনের অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত ২৫ জুন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং জুয়ো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ঢাকায় সাক্ষাৎ করেন। এ সময় রাষ্ট্রদূত বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে তাঁর দেশ গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী চীনা রাষ্ট্রদূতকে বলেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের অবশ্যই বাংলাদেশ থেকে তাদের নিজ মাতৃভূমিতে ফেরত যেতে হবে এবং এ বিষয়ে মিয়ানমারকে বোঝানোর জন্য তিনি চীনের প্রতি আহ্বান জানান (সাউথ এশিয়া মনিটর ২৬ জুন ২০১৯)। এটাই বাংলাদেশের অবস্থান—রোহিঙ্গা নাগরিকদের তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত যেতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে চীন একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। অতি সম্প্রতি তালেবান প্রশ্নে চীনের একটা ভূমিকা অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে। তালেবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সংলাপ’ যখন কোনো সমাধান বয়ে আনছিল না, ঠিক তখন চীন একটা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। চীনের এই ভূমিকা নতুন। অতীতে চীন কখনো অন্য কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে চীনের এ অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। চীন এখন বিশ্ব শক্তি। অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বড় অর্থনীতির দেশ চীন। আর এ কারণেই ‘বিশ্ব শক্তি’ হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চীন এখন বিশ্বরাজনীতি তথা আঞ্চলিক রাজনীতিতে একটা ভূমিকা রাখতে চায়। এ কারণেই চীন আফগানিস্তানের তালেবান সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসেছে। চীন এখন আফগান শান্তিচুক্তিতে গ্যারান্টার হিসেবে ভূমিকা রাখতে চায়। গত ২৬ জুন আফগান সরকারের এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়। জুন মাসে চীনের বিশেষ দূত দেং শিজুন কাবুল সফর করেছিলেন এবং সেখানে তিনি দেশটির নিরাপত্তা উপদেষ্টা হামদুল্লাহ মুজিবের সঙ্গে শান্তিপ্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। চীন এরই মধ্যে কাতারে নিযুক্ত তালেবানদের রাষ্ট্রদূত আবদুল গনি বারাদারকে বেইজিংয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল (ডন, ২০ জুন)। চীনের এই ‘তৎপরতা’ প্রমাণ করে, চীন আফগানিস্তানের তালেবান সমস্যা সমাধানে একটা ‘ভূমিকা’ রাখতে চায়। চীন আফগান সরকার ও তালেবানদের মধ্যকার আলোচনাকে সমর্থন করছে।আফগান সমস্যার সমাধানে চীনের এই ভূমিকা চীনকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। চীন একটি গ্যারান্টার তথা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। চীন রোহিঙ্গা প্রশ্নেও একই ভূমিকা পালন করতে পারে। চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের যেমন সীমান্ত রয়েছে, ঠিক তেমনি আফগানিস্তানের সঙ্গেও চীনের সীমান্ত রয়েছে। এই দুটি দেশেই চীনের স্ট্র্যাটেজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। চীন যে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (বিএআরআই)-এর বিশাল কার্যক্রম শুরু করেছে, তাতে মিয়ানমার ও আফগানিস্তানের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে; যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে আফগানিস্তান বিএআরআই-এ অন্তর্ভুক্ত ছিল না। চীন আফগানিস্তানকে পাশ কাটিয়ে পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়াকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। কিন্তু চীন এখন তাতে পরিবর্তন আনছে। চীন এখন পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর পাশাপাশি আফগানিস্তানকেও গুরুত্ব দিচ্ছে। আফগানিস্তানের ব্যাপারে তাদের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। লোগার প্রদেশের মেস আইনক (Mes Aynak) কপারখনি আহরণে চীন তিন বিলিয়ন (৩০০০ মিলিয়ন) ডলার বিনিয়োগ করেছে। টেলি কমিউনিকেশন খাতে চীনের রয়েছে বিশাল বিনিয়োগ। চীনের জিয়াংসু ((Jiangsu) প্রদেশ থেকে আফগানিস্তানের হাইরাতান (Hairatan) পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করছে চীন। চীন বাদাখাসান (Badakhshan) প্রদেশে একটি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করছে। অভিযোগে আছে, কোনো এক সময় সেখানে চীনা সেনা মোতায়েন হতে পারে। এ অঞ্চলে জ্বালানি খাতে চীনের দুটি প্রজেক্টCASA-1000 ও TAP-500 রয়েছে, যা সুদূর দক্ষিণ এশিয়ার জ্বালানি সংকট সমাধানে বড় ভূমিকা রাখবে। এই দুটি প্রজেক্টের আওতায় আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে গ্যাস/তেল নিয়ে যাওয়া হবে দক্ষিণ এশিয়ায়, যা থেকে প্রকারান্তরে আফগানিস্তানও উপকৃত হবে। আমরাTAPI প্রজেক্টের কথাও এখানে উল্লেখ করতে পারি (Tajikistan-Afganistan-Pakistan-India). TAPI প্রজেক্টে পাইপলাইনের মাধ্যমে তাজিকিস্তানের গ্যাস আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে নয়াদিল্লি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে। এতে ভারতের জ্বালানি চাহিদা মেটাবে। এমনকি বাংলাদেশও এ থেকে উপকৃত হতে পারে। চীনের একটা বড় ভয় জিন জিয়াং (Xin Jiang) প্রদেশের উইন্ডর বিদ্রোহীদের নিয়ে। এখানকার ‘ইস্ট তুর্কেস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট’-এর জঙ্গিরা তাজিকিস্তান ও আফগানিস্তানের তালেবানদের দ্বারা প্রশিক্ষিত। চীন মনে করে, তালেবানদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করলে উইন্ডর জঙ্গিদের প্রতি তালেবানদের সমর্থন কমে যাবে এবং জিন জিয়াং প্রদেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। এসব কারণেই আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা চীনের জন্য প্রয়োজন। পাকিস্তান-আফগানিস্তান সংকটেও চীন দূতিয়ালি করেছিল। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে তার সেনাবাহিনী পূর্ণ প্রত্যাহার করলে (যা তালেবানদের মূল দাবি) চীন সেখানে অন্যতম ‘শক্তি’ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। তালেবান ও একই সঙ্গে আফগান সরকারের কাছে চীন তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চায়।
|
image : Ap |
একই সঙ্গে মিয়ানমারে চীনা স্বার্থ নিয়েও আলোচনা করা যেতে পারে। আফগানিস্তানের মতো মিয়ানমারের সঙ্গেও চীনের সীমান্ত রয়েছে। চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে মিয়ানমারে। চীনের প্রচণ্ড জ্বালানি ক্ষুধা চীনকে পরিপূর্ণভাবে মিয়ানমারের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮৮-২০১৮ সময়সীমায় চীন ২০.২৪ বিলিয়ন (২০২৪০ মিলিয়ন) ডলার মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছে। এর মাঝে ৫৭ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে; তেল, গ্যাস ও খনি খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ১৮ শতাংশ। চীন মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে Kyaukphyu-তে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। এতে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ১.৩ বিলিয়ন (১৩০০ মিলিয়ন) ডলার। ৫২০ হেক্টর জমিতে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে এখানে, যাতে বলা হচ্ছে এক লাখ স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। চীন একই সঙ্গে
Muse-Mandalay রেলওয়ে লাইনও তৈরি করছে। এতে Kyaukphyu থেকে চীনের ইউনান প্রদেশের সীমান্তবর্তী Muse পর্যন্ত রেললাইন সংযুক্ত হবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে চীন রাখাইন প্রদেশের গভীর সমুদ্রে যে গ্যাস ও তেল উত্তোলন করছে, তা এই পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশে নিয়ে যাওয়া। চীন একই সঙ্গে ২০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ৮১০ কিলোমিটার দীর্ঘ Kyaukphyu-Kunming রেলওয়ে লাইনও তৈরি করছে। Muse-Mandalay রেলওয়ের সম্প্রসারিত অংশই হচ্ছে Kyaukphyu-Kunming রেলওয়ে লাইন। আমরা BCIM করিডরের কথাও উল্লেখ করতে পারি। এই করিডরের আওতায় ইউনান প্রদেশের সঙ্গে কক্সবাজারের সড়ক ও রেলপথ সংযুক্ত হবে। এ কারণেই চীন সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল। সেটি এখন আর তৈরি হচ্ছে না। চীন সোনাদিয়ার গভীর সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে ইউনান প্রদেশের উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করতে পারত। এমনকি সড়কপথে চীনা পণ্য বাংলাদেশেও আসতে পারত। এতে চীনা পণ্যের দাম কমে যেত।
BCIM অর্থনৈতিক করিডরের এটি একটি অংশ। এখন রোহিঙ্গা সংকটের কারণে BCIM করিডরের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে। সুতরাং চীন তার জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করে রোহিঙ্গা সংকটের একটা মধ্যস্থতা করতে পারে। মিয়ানমারের সঙ্গে তার সম্পর্ক যেমন ভালো, তেমনি বাংলাদেশের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নত করতে চাইবে চীন। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন যদি দূতিয়ালি করে এবং মিয়ানমারকে যদি বাধ্য করে তাদের নাগরিকদের নিজ দেশে ফেরত নিয়ে যেতে, তাহলে বাংলাদেশে চীনের অবস্থান আরো ভালো হবে। অনেকটা তালেবান সংকটে মধ্যস্থতা করার মধ্য দিয়ে চীনের গ্রহণযোগ্যতা যেভাবে বেড়েছে, রোহিঙ্গা সংকটে মধ্যস্থতা করেও বিশ্ব আসরে চীন তার গ্রহণযোগ্যতা আরো বাড়াতে পারে
নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
৪ জুলাই, ২০১৯
লেখক :
তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment