বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, একটা ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা। অর্থাৎ কোনো একটি দেশের প্রতি ‘অতিরিক্ত ঝুঁকে’ না যাওয়া। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত আর নিকট প্রতিবেশী দেশ হচ্ছে চীন। উন্নয়নের স্বার্থে দুটি দেশের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ক দরকার। কোনো দেশের সঙ্গেই ‘কৌশলগত’ কোনো সম্পর্কে না জড়িয়ে যাওয়াই আমাদের জন্য মঙ্গল। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি চীন ঘুরে এসেছেন। আগামী অক্টোবরে তিনি ভারত সফরে যাচ্ছেন। উন্নয়নের স্বার্থে চীনের সহযোগিতা যেমনি আমাদের প্রয়োজন, ঠিক তেমনি প্রয়োজন ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতার। এ ক্ষেত্রে কোনো একটি দেশের প্রতি যদি আমরা বেশি ‘ঝুঁকে’ পড়ি, তা হলে তাতে করে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটা বিবেচনায় নিয়েই বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে আসছে। আর সেজন্যই চীন সফরের পরপর প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটাই সঠিক পররাষ্ট্রনীতি।
চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ইতিহাস অনেক পুরনো। শুধু ১৯৭৫ সালের আগস্টে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছিল, এটা মনে করলে আমরা ভুল করব। ১৪০৫ থেকে ১৪৩৩ সাল পর্যন্ত চীনা এডমিরাল ঝেং হি ভারত মহাসাগরে সাতবার তার বাণিজ্যতরী নিয়ে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন মিং সাম্রাজ্যের তৎকালীন সম্রাট ইয়ংলির প্রতিনিধি। ওই সময় তিনি তৎকালীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওতেও এসেছিলেন। এভাবেই চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। চীন এখন এডমিরাল ঝেং হির সফরকে গুরুত্ব দেয়। তাকে শ্রেষ্ঠ কূটনীতিক হিসেবে চীন স্বীকার করে। তারও আগে আমাদের বিক্রমপুরে জন্ম নেওয়া (তৎকালীন পালা সাম্রাজ্য) অতীশ দীপংকর শ্রীমান বৌদ্ধধর্মচর্চা ও প্রচারের জন্য সুদূর তিব্বতে পর্যন্ত গিয়েছিলেন এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। পরে জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তার দেহভস্ম চীন থেকে বাংলাদেশে আনা হয়। ফলে সম্পর্কের একটা ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। এডমিরাল ঝেং হি প্রায় ছয়শ বছর আগে যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ভিত্তি রচনা করেছিলেন, আজ তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। বাংলাদেশ বিদেশ থেকে যা আমদানি করে তার মধ্যে শতকরা ৩৪ ভাগ আসে চীন থেকে (১৫.১ বিলিয়ন ডলার) আর ১৬ ভাগ আসে ভারত থেকে (৭.০৫ বিলিয়ন ডলার)। তবে রপ্তানির তালিকায় চীনের অবস্থান অনেক পেছনে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ৩৯.২ বিলিয়ন ডলার পণ্য রপ্তানি করেছিল, যার মধ্যে শীর্ষে ছিল জার্মানি (৬.১১ মিলিয়ন)। এর পর ছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্থান (৫.৮১ মিলিয়ন)। প্রধানমন্ত্রীর চলতি চীন সফরে (জুলাই ২০১৯) ৯টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। একটি চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের জন্য চীন ২ হাজার ৫শ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করবে। অন্য চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক বিনিময় ও পর্যটন কর্মসূচি নিয়ে সমঝোতা স্মারক, ইয়ালু ঝাংঝে ও ব্রহ্মপুত্র নদের তথ্যবিনিময়সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক এবং তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা, ডিপিডিসির আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুৎব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ নিয়ে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট, অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতাবিষয়ক চুক্তি ইত্যাদি। শেখ হাসিনা-লি কেকিয়াং আলোচনায় বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডরকে শক্তিশালী করতে এই রুটের মধ্যকার অবকাঠামো খাত উন্নয়নের আহ্বান জানানো হয় (সিজিটিএন ৫ জুলাই)। বলা ভালো, চীন ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’র (ওবিওআর) যে বিশাল কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে, তাতে যে মোট ৬টি অর্থনৈতিক করিডর রয়েছে, বিসিআইএম করিডর তার একটি। বাংলাদেশ-চীন (ইউনান প্রদেশ)-ভারত (উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য) ও মিয়ানমারকে নিয়ে প্রস্তাবিত এই অর্থনৈতিক করিডরটি গড়ে উঠছে। ফলে সড়কপথে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশ সংযুক্ত হবে। ইউনান প্রদেশের কুনমিং থেকে সুদূর কক্সবাজার পর্যন্ত সড়কপথ তৈরি হবে। অদূর ভবিষ্যতে এ পথে রেললাইনও চালু হবে। তবে বিসিআইএম নিয়ে প্রশ্ন আছে। ভারত শেষ পর্যন্ত এই করিডরের ব্যাপারে তার সম্মতি জানালেও ভারত ওবিওআরে যোগ দেয়নি। অথচ বাংলাদেশ যোগ দিয়েছে। ওবিআরের পরিকল্পনার আওতায় কক্সবাজারের সন্নিকটে সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হওয়ার কথা ছিল। এ ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষরের কথা থাকলেও তা আর স্বাক্ষরিত হয়নি ভারতের আপত্তির কারণে। ফলে শেখ হাসিনা-লি কেকিয়াং দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বিসিআইএমের অবকাঠামো খাত নির্মাণের আহ্বান জানালেও ভারতের ‘ভূমিকা’ নিয়ে একটা প্রশ্ন আছেই। ভারত না চাইলে বিসিআইএম করিডরের ধারণা শুধু ধারণা পর্যায়েই থেকে যাবে।
চীনের আর্থিক সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রকল্প এখন বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হচ্ছে বা হবে। এ ক্ষেত্রে চীনা ঋণের শর্ত কী, সুদের হার কী, আমরা তা জানি না। সাম্প্রতিককালে ‘চীনা ঋণ’ নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ঋণগ্রহীতা দেশগুলো এক ধরনের ‘চীনা ঋণ ফাঁদ’-এ পড়েছে, এ ধরনের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে (শ্রীলংকা, কেনিয়া, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া)। তবে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি নিজে একজন অর্থনীতিবিদও বটে, তিনি আমাদের জানিয়েছেন, দেশের স্বার্থ রক্ষা করেই চীনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হবে। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, ‘আমরা যাতে চীনের ঋণের ফাঁদে না পড়ি, সে বিষয়ে সতর্ক রয়েছি’ (একটি অনলাইনে, ২৮ জুন)। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ যে চীনা ঋণ পাচ্ছে (৩১ বিলিয়ন ডলার), তা পাকিস্তানের সিপিইসির (ঈচঊঈ) পর (৬০ বিলিয়ন ডলার) দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ (টাইমস অব ইন্ডিয়া, ৫ জুলাই)। তাই চীনা ঋণ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই। তবে প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, চীনের প্রতি তিনি ঋণচুক্তির শর্তাবলি সহজ করার এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে সঠিক সময়ে তহবিল ছাড়ের আহ্বান জানিয়েছেন। চীন এই আহ্বানে কতটুকু ছাড় দিয়েছে, সে বিষয়ে অবশ্য আমরা তেমন কিছু জানি না। উন্নয়নকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়েছি। এজন্য আমাদের বৈদেশিক ঋণ প্রয়োজন। বাংলাদেশ ওবিওআরে যোগ দিয়েছে। ফলে চীনের ঋণ পাওয়া আমাদের জন্য সহজ। কিন্তু আমরা যেন শ্রীলংকার হামবনাতোতা সমুদ্রবন্দরের অভিজ্ঞতার কথা ভুলে না যাই। মালয়েশিয়ার কথাও যেন আমাদের মনে থাকে। তবে চীনা ঋণ আমাদের প্রয়োজন আছে। চীন অবকাঠামো খাতে ঋণ দিয়ে থাকে। ওই ঋণ আমাদের প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আমরা ভারতীয় ঋণও গ্রহণ করছি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথমবার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ সফর করেছিলেন ২০১৫ সালের ২৭ মে। এর পর প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যান ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। ভারতের ঋণে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। চীনের মতো ভারতের জন্যও বিশেষ ইপিজেড তৈরি করা হয়েছে। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা সেখানে বিনিয়োগ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুদেশের সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদেও তা স্বীকার করেছেন। ৪০ বছরের ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। এটি ছিল একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসরত ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ‘তাদের ইচ্ছায়’ ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ওইসব বিচ্ছিন্নতাবাদী ভারতে প্রবেশ করে নাশকতামূলক কর্মকা- পরিচালনা করত। এখন তার অবসান হয়েছে। আমরা ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছি। আরও বিদ্যুৎ পাওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে। বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যে এখন ভারতের পণ্য যাচ্ছে। তবে দুদেশের মধ্যে সমস্যা যে নেই, তা নয়। যেমন তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি এখনো হয়নি শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে। টিপাইমুখ বাঁধ ও আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়েও কথা আছে। বাংলাদেশ ভারতে তার বাণিজ্য রপ্তানি বাড়াতে পারছে না শুধু ট্যারিফ আর প্যারা ট্যারিফের কারণে। সীমান্ত হত্যা আজও বন্ধ হয়নি। গঙ্গা পানিচুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। তখন জনসংখ্যা ও পানির চাহিদা বাড়বে ৩ গুণ। তাই পানিবণ্টনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু করা জরুরি। ভারতে পানি সংকট রয়েছে। এখন আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প যদি বাস্তবায়িত হয় তা হলে বাংলাদেশে পানি সংকট দেখা দেবে।
দক্ষিণ এশিয়া বড় ধরনের পানি সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে কীভাবে পানি সমস্যার সমাধান করা যায়। বিশেষ করে হিমালয় অঞ্চলে ‘রিজার্ভিয়ার’ নির্মাণ করে পানি ধরে রাখা ও শুষ্ক মৌসুমে তা ছেড়ে দেওয়াÑ এ ব্যাপারে ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নেওয়া দরকার। নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় আমরা নতুন একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা শুনেছিলাম (বিপিআইএন)। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার একটি ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে জ্বালানি ও পানি সমস্যার সমাধানে এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। ভুটান ও নেপালে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পানি সংরক্ষণের একটি বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এ অঞ্চলের উন্নয়নে এই সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। তবে এ ক্ষেত্রে ভারতকে উদার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কেননা বাংলাদেশ যদি নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে চায়, তা হলে তা ভারতীয় সীমানার ওপর দিয়ে আমদানি করতে হবে। ভারতের সম্মত্তি না পেলে, তা সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তাই চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে চীন-ভারত সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। ভারত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তার করার প্রশ্নে চীন ও ভারতের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা আমরা লক্ষ করি। এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ আক্রান্ত হতে পারে। তাই খুব কৌশলে এই দেশ দুটির সঙ্গে আমাদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি তাই একটি ভালো ‘অ্যাপ্রোচ’। ‘কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, বরং বন্ধুত্ব’ করে এবং আমাদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করতে হবে্
আমাদের সময়
আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৯
আমাদের সময়
আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৯
তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
0 comments:
Post a Comment