প্রশ্ন হচ্ছে, অধ্যাপক ফারুকের নেতৃত্বে একটি টিম গবেষণা করেছে। এ গবেষণায় তারা পেয়েছেন উল্লিখিত পাঁচটি কোম্পানির দুধে অ্যান্টিবায়োটিকসহ আরও বেশকিছু উপাদান, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করেও তারা একই উপাদান পেয়েছেন। ওই আমলার ‘সমস্যা’টা এখানেই- অধ্যাপক ফারুক আগে কেন মন্ত্রণালয়কে গবেষণার ফলাফল জানালেন না? কেন এটা ‘পিয়ার রিভিউ’ ম্যাগাজিনে প্রকাশ না করে সংবাদ সম্মেলন করলেন? ইত্যাদি হাজারটা প্রশ্ন তিনি তুলেছেন। এ ভদ্রলোক আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন কি না সন্দেহ! অনেক সচিবকেই চিনি, যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথাকথিত মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছেন। আমি বেশ ক’বছর পিএসসিতে ভাইভা বোর্ডে ছিলাম। তখন আমি অনেক বিএ পাস পরীক্ষার্থী পেয়েছি, যাদের কেউ কেউ চূড়ান্ত বিচারে উত্তীর্ণ হয়ে সচিব পর্যন্ত হয়েছেন! অধ্যাপক ফারুক তো মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো অনুদান নিয়ে ওই গবেষণাটি করেননি যে, তাকে তার গবেষণাটি মন্ত্রণালয়েই জমা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, তিনি যদি গবেষণার ফলাফলটি কোনো গবেষণা জার্নালে প্রকাশ করতে চান বা গবেষণাকর্ম জমা দেন, শুধু তখনই ‘পিয়ার রিভিউ’র প্রশ্নটি আসবে, এর আগে নয়। এমনও তো হতে পারে তিনি আগামীতে এটা কোনো জার্নালে প্রকাশ করবেন, কিংবা আদৌ করবেন না। গবেষণার ‘মেথোডলজি’ নিয়েও প্রশ্ন তোলা কি ওই আমলার সাজে? তিনি ‘মেথোডলজি’ কী তা বোঝেন? সব ‘মেথোডলজি’ এক হয় না। সমাজবিজ্ঞানের ‘মেথোডলজি’র সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো শাখার ‘মেথোডলজি’কে মেলানো যাবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন অধ্যাপক ফারুক গবেষণা সংবাদমাধ্যমে উপস্থাপন করলেন? এটা তিনি করেছেন জনস্বার্থকে বিবেচনায় নিয়ে। বলা ভালো, এ গবেষণার জন্য তিনি আরেকটি মন্ত্রণালয় থেকে অনুদান পেয়েছেন। বিভাগের সভাপতি এটা অনুমোদনও করেছেন। তাহলে? তিনি গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল কেন জাতিকে জানাবেন না? এর সঙ্গে তো জনস্বার্থ জড়িত। তিনি সঠিক কাজটিই করেছেন।
আমি নিজে গবেষণা করি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আমার গবেষণাধর্মী বই আছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির ওপর আমার একাধিক গ্রন্থ রয়েছে। প্রতিটি গ্রন্থে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা ও নীতি পর্যালোচনা করা হয়েছে এবং কিছু সুপারিশমালাও দেয়া হয়েছে। উল্লিখিত আমলার ‘হুমকি’টা যদি আমি বিবেচনায় নিই, তাহলে কি আমি আমার পাণ্ডুলিপি আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাব? তারা ‘অনুমোদন’ দেবেন, তারপর আমি তা প্রকাশ করব? এটা একটা ভুল ধারণা। কোনো গবেষকই এমনটা করেন না। তাই অধ্যাপক ফারুক যেটা করেছেন, সেটা যৌক্তিক। তিনি দায়বদ্ধতা থেকে এটা করেছেন। আমি তাকে সাধুবাদ জানাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরকারি চাকরি করেন না আমলাদের মতো। তারা রাষ্ট্র থেকে বেতন-ভাতা পান বটে, কিন্তু তাদের ‘সরকারি চাকুরে’ হিসেবে গণ্য করা অন্যায়। ওই আমলা একজন সিনিয়র অধ্যাপককে ‘হুমকি’ দিয়ে শুধু বড় অন্যায়ই করেননি, বরং পুরো আমলাতন্ত্র সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছেন। আমি মনে করি, একজন অধ্যাপক ফারুককে ‘হুমকি’ দেয়া মানে পুরো শিক্ষক সমাজকে হুমকি দেয়া। আমি হুমকি দেয়া ওই আমলার ‘বিচার’ দাবি করছি। আমি মনে করি, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া যে মানহানির মামলা করার প্রস্তাব দিয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা অধ্যাপক ফারুক এটা বিবেচনায় নিতে পারেন।
এখন মূল প্রশ্নে আসি। দ্বিতীয়বারের মতো পরীক্ষায়ও দুধে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে। ওই পাঁচটি দুধ কোম্পানি ও মন্ত্রণালয় এটা মানতে নারাজ। তারা আপত্তি জানিয়েছে। হাইকোর্ট এ ব্যাপারে একটি নির্দেশনা দিয়েছেন- চারটি গবেষণাগার থেকে দুধ পরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন। এখানেও কথা আছে। যেসব প্রতিষ্ঠানে ‘দুধ পরীক্ষা’ হবে, তার মাঝে সরকারি প্রতিষ্ঠানও আছে। তারা কি সরকারের ‘অবস্থানের’ বাইরে যেতে পারবে? যদি ভিন্ন ভিন্ন রিপোর্ট পাওয়া যায়, তখন কী হবে? এতে করে কি পুরো ‘সত্যটা’ পাওয়া যাবে? এ জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাহায্য নেয়া যেতে পারে এবং বিদেশ থেকে ‘দুধের নমুনা’ পরীক্ষা করিয়ে আনা যেতে পারে। একই সঙ্গে সমস্যার মূলে যেতে হবে। গরুকে যে গো-খাদ্য সরবরাহ করা হয় অথবা খাওয়ানো হয়, তাতে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়। ফলে গো-মাংসে ও দুধে অ্যান্টিবায়োটিক থাকবেই। গো-খাদ্য উৎপাদনে কী পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে কিংবা আদৌ যাবে কি না, সে ব্যাপারে নীতিমালা থাকা দরকার। একই সঙ্গে নিয়মিত গো-খাদ্য পরীক্ষা করাও জরুরি। এখানে আমাদের শিথিলতা রয়েছে। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড এখানে নেই বললেই চলে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় একটি গবেষণাকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে বরং গো-খাদ্য উৎপাদন, পশুর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ- এসব যদি মনিটর করত, তাহলে ভালো করত। একই সঙ্গে আরও একটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন- আর তা হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ, যাদের মাঝে নারীরাও রয়েছেন, তারা গো-দুগ্ধ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। গ্রামগঞ্জে খামার গড়ে উঠছে। এ ধরনের সংবাদে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। তাদের অনেকেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গো-খামার করেছেন। দুধ বিক্রি যদি কমে যায়, তাহলে কোম্পানিগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খামারিদের কাছ থেকে আর দুধ ক্রয় করবে না। আসলে দুধে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ ও ব্যবহারের জন্য ছোট ছোট খামারিরা যতটুকু না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী কোম্পানিগুলো। সুতরাং খুদে খামারিরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেদিকে সরকারের লক্ষ রাখা উচিত।
সমস্যার মূলে যেতে হবে। একটি গবেষণাকে ‘মিথ্যা’ ও ‘অগ্রহণযোগ্য’ আখ্যায়িত করে কিংবা গবেষককে ‘হুমকি’ দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উচিত বিষয়টি সিরিয়াসলি নিয়ে কী করে এ সমস্যার সমাধান বের করা যায়, তার পথ খোঁজা। মন্ত্রণালয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতামত গ্রহণ করতে পারে। এমনকি অধ্যাপক ফারুকের মতামতও নেয়া যেতে পারে। একজন আমলা গবেষকদের হুমকি দেবেন, লাল চোখ দেখাবেন, শুভবুদ্ধির কোনো মানুষ এটা মেনে নেবে না। এটা আমলাতন্ত্রের ‘অতি ক্ষমতায়নের’ একটি ফল! আমলারা নিজেদের অতি ক্ষমতাবান মনে করেন! শিক্ষকতুল্য একজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপককে ‘হুমকি’ দিয়ে শুধু একজন অধ্যাপক ফারুককেই অসম্মানিত করা হয়নি, বরং সমগ্র শিক্ষক সমাজকেই অসম্মানিত করা হয়েছে।
যুগান্তর
২০ জুলাই ২০১৯
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment