প্রধানমন্ত্রী তার চীন সফর শেষ করে সোমবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন। এই সফরে তিনি বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেন। চীনের লিওয়ানিং প্রদেশের দালিয়ান শহরে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তিনি তার চীন সফর শুরু করেন। ৬ জুলাই তিনি দেশে ফিরে আসেন।
এ সফরে তিনি চীনা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা বলেন। তিনি জানিয়েছেন, মিয়ানমারের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে দেশটির সরকারকে সম্মত করাতে চীন চেষ্টা করবে।
প্রয়োজনে চীন তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আবারও মিয়ানমার পাঠাবে। কিন্তু যে প্রশ্নটি এখন অনেকেই করার চেষ্টা করবেন তা হচ্ছে, এই ‘চীনা আশ্বাস’ কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখবে? চীনের কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি।
প্রত্যাশা করেছিলাম চীন একটি শক্ত অবস্থানে যাবে। কিন্তু ‘আশ্বাস’ আর ‘দ্বিপাক্ষিকভাবে সমস্যা সমাধানের’ কথা বলার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীন তার অবস্থান খুব একটা পরিবর্তন করেছে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশ আগেই স্পষ্ট করেছিল, চীনের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যে আলোচনা হবে, ওই আলোচনায় রোহিঙ্গা সমস্যা স্থান পাবে। চীন বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার চীন।
বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, যারা মিয়ানমারের নাগরিক, তাদের বাংলাদেশে উপস্থিতি বাংলাদেশের স্থিতিশীলতাকে বড় ধরনের ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিয়েছে। প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে প্রবেশ এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকিস্বরূপ।
বাংলাদেশ বারবার আন্তর্জাতিক আসরে এ কথাটাই বলে আসছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এটা এখন উপলব্ধি করতে পেরেছে। সে কারণে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘চাপ’ও বাড়ছে। চীন এটা জানে ও বোঝেও।
চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের দীর্ঘ সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে চীন বরাবরই রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারকে সমর্থন জানিয়ে আসছে। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে চীন মিয়ানমারের পাশেই ছিল এবং মিয়ানমারের বক্তব্য সমর্থন করে আসছিল।
সাম্প্রতিককালে রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীনের অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছিল। ২৫ জুন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং জুয়ো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ঢাকায় সাক্ষাৎ করেন।
ওই সময় রাষ্ট্রদূত বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে তার দেশ গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী চীনা রাষ্ট্রদূতকে বলেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের অবশ্যই বাংলাদেশ থেকে তাদের নিজ মাতৃভূমিতে ফেরত যেতে হবে এবং এ বিষয়ে মিয়ানমারকে বোঝানোর জন্য তিনি চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন (সাউথ এশিয়া মনিটর, ২৬ জুন ২০১৯)।
এটাই বাংলাদেশের অবস্থান- রোহিঙ্গা নাগরিকদের তাদের নিজ দেশ মিয়ানমার ফেরত যেতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে চীন একটা ভূমিকা পালন করতে পারে।
অতি সম্প্রতি তালেবান প্রশ্নে চীনের একটি ভূমিকা অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে। তালেবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সংলাপ’ যখন কোনো সমাধান বয়ে আনছিল না, ঠিক তখন চীন একটি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। চীনের এ ভূমিকা নতুন।
অতীতে চীন কখনও অন্য কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করেনি; কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে চীনের এ অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। চীন এখন বিশ্বশক্তি। অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বড় অর্থনীতির দেশ চীন। আর এ কারণেই ‘বিশ্বশক্তি’ হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চীন এখন বিশ্ব রাজনীতি তথা আঞ্চলিক রাজনীতিতে একটি ভূমিকা রাখতে চায়।
এ কারণেই চীন আফগানিস্তানের ‘তালেবান’ সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসেছে। চীন এখন আফগান শান্তি চুক্তিতে গ্যারান্টার হিসেবে ভূমিকা রাখতে চায়। ২৬ জুন আফগান সরকারের এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়। জুন মাসে চীনের বিশেষ দূত দেং শি জুন কাবুল সফর করেছিলেন এবং সেখানে তিনি দেশটির নিরাপত্তা উপদেষ্টা হামদুল্লাহ মুহিবের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।
চীন ইতিমধ্যে কাতারে নিযুক্ত তালেবানদের রাষ্ট্রদূত আবদুল গনি বারাদারকে বেইজিংয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছে (ডন, জুন ২০)। চীনের এই ‘তৎপরতা’ প্রমাণ করে চীন আফগানিস্তানের তালেবান সমস্যা সমাধানে একটি ‘ভূমিকা’ রাখতে চায়। চীন আফগান সরকার ও তালেবানদের মধ্যকার আলোচনাকেও সমর্থন করছে।
আফগান সমস্যার সমাধানে চীনের এ ভূমিকা চীনকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। চীন একটি গ্যারান্টার তথা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এখন চীন রোহিঙ্গা প্রশ্নেও একই ভূমিকা পালন করতে পারে। চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের যেমন সীমান্ত রয়েছে, ঠিক তেমনি আফগানিস্তানের সঙ্গেও চীনের সীমান্ত রয়েছে। এই দুটো দেশেই চীনের স্ট্র্যাটেজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে।
চীন যে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর (ওবিওআর) বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করেছে, তাতে মিয়ানমার ও আফগানিস্তানের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে আফগানিস্তান ওবিওআরে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। চীন আফগানিস্তানকে পাশ কাটিয়ে পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়াকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। কিন্তু চীন এখন তাতে পরিবর্তন আনছে।
চীন এখন পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর পাশাপাশি আফগানিস্তানকেও গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমার ধারণা ছিল, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে চীন একটি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু দেখা গেল, চীন দ্বিপাক্ষিক আলোচনাকে (বাংলাদেশ ও মিয়ানমার) বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।
এ ক্ষেত্রে চীন তার জাতীয় স্বার্থটাকেই বড় করে দেখল। বিশ্বশক্তি তথা আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে তার যে ভূমিকা পালন করার কথা, তার সেই ভূমিকাকে চীন এখন অনেকটাই এড়িয়ে গেল। চীন আগামীতে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে মিয়ানমারে পাঠাবে হয়তো; কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আর তা হচ্ছে, চীনা ঋণের সুদের হার কী হবে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনা ঋণের সুদের হার কমিয়ে আনার দাবি করেছিলেন। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে এ প্রশ্নটি উত্থাপিত হলেও এর কোনো সুস্পষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি। এ সংক্রান্ত কোনো খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়নি।
বলা ভালো, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে ৯টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। একটি চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের জন্য চীন ২ হাজার ৫০০ টন চাল সরবরাহ করবে। অন্য চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক বিনিময় ও পর্যটন কর্মসূচি নিয়ে সমঝোতা স্মারক, ইয়ালুঝাংবু ও ব্রহ্মপুত্র নদের তথ্য বিনিময়সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক এবং তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা, ডিপিডিসির আওতাধাীন এলাকায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ নিয়ে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট, অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতাবিষয়ক চুক্তি ইত্যাদি।
শেখ হাসিনা ও লি কেকিয়াংয়ের আলোচনায় বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোরকে শক্তিশালী করতে ওই রুটের মধ্যকার অবকাঠামো খাত উন্নয়নের আহ্বান জানানো হয় (সিজিটিএন, ৫ জুলাই)। বলা ভালো, চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবিওআর) কর্মসূচিতে যে মোট ছয়টি অর্থনৈতিক করিডোর রয়েছে, বিসিআইএম তার একটি।
বাংলাদেশ-চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য) ও মিয়ানমারকে নিয়ে প্রস্তাবিত ওই অর্থনৈতিক করিডোরটি গড়ে উঠছে। এর ফলে সড়কপথে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশ সংযুক্ত হবে।
ইউনান প্রদেশের কুনমিং থেকে সুদূর কক্সবাজার পর্যন্ত সড়কপথ তৈরি হবে। অদূর ভবিষ্যতে এ পথে রেললাইনও চালু হবে। তবে বিসিআইএম নিয়ে প্রশ্ন আছে। ভারত শেষ পর্যন্ত এ করিডোরের ব্যাপারে তার সম্মতি জানালেও দেশটি ওবিওআরে যোগ দেয়নি। অথচ বাংলাদেশ যোগ দিয়েছে।
ওবিওআরের পরিকল্পনার আওতায় কক্সবাজারের কাছে সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হওয়ার কথা ছিল। এ ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষরের কথা থাকলেও তা আর স্বাক্ষরিত হয়নি ভারতের আপত্তির কারণে।
ফলে শেখ হাসিনা-লি কেকিয়াং দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বিসিআইএমের অবকাঠামো খাত নির্মাণের আহ্বান জানানো হলেও ভারতের ‘ভূমিকা’ নিয়ে একটা প্রশ্ন আছেই। ভারত না চাইলে এ করিডোরের ধারণা শুধু ধারণা পর্যায়েই থেকে যাবে।
চীনের আর্থিক সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রকল্প এখন বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হচ্ছে ও হবে। এ ক্ষেত্রে চীনা ঋণের শর্ত কী, সুদের হার কী, আমরা তা জানি না। সাম্প্রতিককালে ‘চীনা ঋণ’ নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ঋণগ্রহীতা দেশগুলো এক ধরনের ‘চীনা ঋণ ফাঁদে’ পড়েছে, এ ধরনের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে (শ্রীলংকা, কেনিয়া, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া)।
তবে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি নিজে একজন অর্থনীতিবিদও বটে, তিনি আমাদের জানিয়েছেন, দেশের স্বার্থ রক্ষা করেই চীনের কাছ থেকে ঋণ নেয়া হবে।
তিনি আরও জানিয়েছিলেন, ‘আমরা যাতে চীনের ঋণের ফাঁদে না পড়ি, সে বিষয়ে সতর্ক রয়েছি।’ বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ যে চীনা ঋণ পাচ্ছে (৩১ বিলিয়ন ডলার), তা পাকিস্তানের সিপিইসির পর (৬০ বিলিয়ন ডলার) দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ (টাইমস অব ইন্ডিয়া, ৫ জুলাই)। সুতরাং চীনা ঋণ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই।
তবে প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, চীনের প্রতি তিনি ঋণচুক্তির শর্তাবলি সহজ করার এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে সঠিক সময়ে তহবিল ছাড়ের আহ্বান জানিয়েছেন। চীন এ আহ্বানে কতটুকু ছাড় দিয়েছে, সে বিষয়ে অবশ্য আমরা তেমন কিছু জানি না। উন্নয়নকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়েছি। এ জন্য আমাদের বৈদেশিক ঋণ প্রয়োজন। বাংলাদেশ ওবিওআরে যোগ দিয়েছে। এর ফলে চীনের ঋণ পাওয়া আমাদের জন্য সহজ।
কিন্তু আমরা যেন শ্রীলংকার হামবানটোটা সমুদ্রবন্দরের অভিজ্ঞতার কথা ভুলে না যাই। মালয়েশিয়ার কথাও যেন আমাদের মনে থাকে। তবে নিঃসন্দেহে এ কথাটা বলাই যায়, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের মধ্য দিয়ে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন নতুন উচ্চতায় উপনীত হল।
যুগান্তর
১৩ জুলাই ২০১৯
নিউইর্য়ক, যুক্তরাষ্ট্র
তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment