রাহুল গান্ধী পদত্যাগ করেছেন। তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি। ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে তিনি কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ৩ জুলাই তিনি পদত্যাগ করেন। সর্বস্তরের পার্টির কর্মী ও নেতারা তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের দাবি করলেও তিনি পদত্যাগের ব্যাপারে ‘দৃঢ় কমিটমেন্ট’ ছিলেন। লোকসভার নির্বাচনে পরাজয়ের দায়ভার বহন করে তিনি পদত্যাগের এই সিদ্ধান্ত নিলেন। এ কথা তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন। ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, তার এই পদত্যাগ কী সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন ডেকে আনবে? কিংবা নয়া নেতৃত্বে কী কংগ্রেস ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? অথবা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোÑ যারা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে চায়, তাদের জন্য আদৌ কি কোনো শিক্ষা?
একটি রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম রাহুল গান্ধীর। নেহরু পরিবার শুধু ভারতীয় রাজনীতিতে একটি অবিস্মরণীয় নামই নয়, ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বের সারিতেও ছিল এই পরিবার। স্বাধীনতার আগে থেকেই নেহরু পরিবার ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য তৈরি করেছিল। ঠিক ১০০ বছর আগে ১৯১৯ সালে মতিলাল নেহরু ভারতীয় কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ১০০ বছর পর নেহরু পরিবারের সর্বশেষ প্রতিনিধি রাহুল গান্ধী কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করলেন। মাঝখানে নেহরু পরিবারের একাধিক প্রতিনিধি ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মতিলাল নেহরুর সন্তান জওয়াহেরলাল নেহরু ছিলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তিনি চার দফায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন (১৫ আগস্ট ১৯৪৭ থেকে ২৭ মে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত মোট ১৬ বছর ২৮৬ দিন)। কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী একনাগাড়ে এত দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেননি। তার জ্যেষ্ঠ সন্তান ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ছিলেন একনাগাড়ে মোট ১১ বছর ৫৯ দিন (২৪ জানুয়ারি ১৯৬৬ থেকে ২৪ মার্চ ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত)। দ্বিতীয় দফায় তিনি ক্ষমতায় ফিরে আসেন ১৯৮০ সালের ১৪ জানুয়ারি আর ক্ষমতায় ছিলেন ৩১ অক্টোবর ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মোট ৪ বছর ২৯১ দিন। নিজ দেহরক্ষীর হাতে মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ সন্তান রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন ৩১ অক্টোবর ১৯৮৪ সালে আর ক্ষমতায় ছিলেন ৫ বছর ৩২ দিন (১৯৮৯ সালের ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত)। তার মৃত্যুর পর আর নেহরু পরিবারের কাউকে প্রধানমন্ত্রীর পদে দেখা যায়নি। রাজীব গান্ধী-পরবর্তী কগ্রেস দুই-দুবার ক্ষমতাসীন হয়েছিল (নরসিমা রাও ১৯৯১ সালের ২১ জুন থেকে ১৯৯৬ সালের ১৬ মে ৪ বছর ৩৩০ দিন এবং মনমোহন সিং ২০০৪ সালের ২২ মে থেকে ২০১৪ সালের ২৬ মে ১০ বছর ৪ দিন)। কিন্তু নেহরু পরিবারের কাউকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে দেখা যায়নি। রাজীব গান্ধীর স্ত্রী সোনিয়া গান্ধীর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। তবে সোনিয়া গান্ধী জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক ছিলেন না। জন্মসূত্রে ইতালির নাগরিক সোনিয়া রাজীব গান্ধীকে বিয়ে করে পরবর্তীকালে ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এটি সত্য, তিনি মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী পদে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের হাতে কংগ্রেস সভাপতির পদটি রেখে দিয়েছিলেন। অভিযোগ আছে, তিনি প্রধানমন্ত্রী না হলেও (যাতে উগ্র হিন্দুবাদীদের প্রচ- আপত্তি ছিল) ‘প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ’ করতেন। ২০০৪ থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন। তার নেতৃত্বেই কংগ্রেস ১৪ ও ১৫তম লোকসভা নির্বাচনে অংশ নেয় এবং কেন্দ্রে ইউপিএ সরকার গঠন করতে সক্ষম হয় (১৪তম লোকসভায় ১৪৫ আসন, ১৫তম লোকসভায় ২০৬ আসন। মোট আসন ৫৪৩)। এর পরই তিনি কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব ছেড়ে দেন জ্যেষ্ঠ সন্তান রাহুল গান্ধীর কাছে। কিন্তু ১৭তম লোকসভা কিংবা ২০১৪ সালের ১৬তম লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি ঘটে। ১৬তম লোকসভায় কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র ৪৪ আর সর্বশেষ ১৭তম লোকসভায় পায় ৫২ আসন। ফলে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এখন কংগ্রেসের নেহরু পরিবারের বাইরে একজনকে সভাপতি হিসেবে বরণ করে নিতে হবে। ১৩৩ বছরের (জন্ম ২৮ ডিসেম্বর ১৮৮৫) যে সংগঠন, ওই সংগঠনটি এর আগে আর এত বড় সংকটের মধ্যে পড়েনি। রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর নরসিমা রাও কংগ্রেসের হাল ধরেছিলেন। এর পর সিতারাম কেশরিও দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারেননি। ফলে নেহরু পরিবারের ‘একজন’কেই কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। এখন পরিস্থিতি কি সেদিকেই যাচ্ছে?
পরবর্তিত পরিস্থিতির কারণে কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় ‘একজন’কে (শচিন পাইলট, অশোক গেহলট, জ্যোতিরাদিত্য সিন্দিয়া) কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব নিতে হলেও তিনি যে সাময়িকভাবে এই দায়িত্ব পালন করবেন, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। কংগ্রেস মানেই হচ্ছে পরিবারতন্ত্র। নেহরু পরিবারের দিকেই শেষ পর্যন্ত তাকাতে হয় কংগ্রেসকে। তাই কংগ্রেসের নেতৃত্ব যে শেষ পর্যন্ত প্রিয়াংকা গান্ধীর ওপরই বর্তাবে, তা বোধহয় এক রকম নিশ্চিত করেই বলা যায়। ৪৭ বছর বয়সী প্রিয়াংকা রাহুল গান্ধীর ছোট বোন ও বর্তমানে কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক। অন্তর্বর্তীকালীন ‘কেউ একজন’ সভাপতির দায়িত্ব নেবেন এবং চূড়ান্ত বিচারে আমরা দেখব প্রিয়াংকা গান্ধীকেই কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিতে। একটি কথা এখানে বলতেই হয়, পরিবারতন্ত্র ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। শুধু গান্ধী-নেহরু পরিবার কেন বলি? প্রতিটি রাজ্যেই ওই পরিবারতন্ত্র বহালÑ বাবা নেতৃত্ব ছেড়ে দিচ্ছেন ছেলেকে, ছেলে এমপি হচ্ছেন, মন্ত্রী হচ্ছেন। কোথাও কোথাও আবার ব্যক্তির নামে দল গঠিত হয়েছে (যেমনÑ উড়িষ্যায় বিজু জনতা দল)। মূর্খ (অক্ষরজ্ঞান না থাকা অর্থে) রাবড়ি দেবী শুধু স্বামীর দল ও তার নামে (লালু প্রসাদ যাদব) বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। এখন তার ছেলে ‘ক্ষমতা’ পরিচালনা করছেন। তাই পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে মোদি যত কথাই বলুন না কেন, বাস্তবতা হচ্ছেÑ কংগ্রেসকে শেষ পর্যন্ত নেহরু পরিবারের দিকেই তাকাতে হবে।
রাহুল গান্ধী এখন নেতৃত্ব ছেড়ে দিলেন। কিন্তু নেতৃত্ব নয়, বরং ‘রাজনীতি’ এখন ঠিক করতে হবে। ‘মোদি ম্যাজিক’কে ঠেকাতে হলে এবং ২০২৪ সালে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য কংগ্রেসকে ‘নতুন রাজনীতি’ নিয়ে মানুষের কাছে যেতে হবে। ভারতে বেকার সমস্যা প্রবল। কর্মজীবী মানুষের মধ্যে ৫০ শতাংশের কোনো চাকরি নেই। বেকারত্বের হার ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ। এখন তা এসে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশে। প্রতিমাসে ১২ লাখ তরুণের জন্য কাজ দরকার। কৃষক ঋণ পরিশোধ না করে আত্মহত্যা করছেন। মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত। ভারতের জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। তাদের জন্য কর্মসংস্থান দরকার। ২০১৯ সালে মাত্র ৭৮ নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন (৫৪৩ জনের মধ্যে)। এটি আরও বাড়ানো দরকার। তাই কংগ্রেসকে এক ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে যেতে হবে। কংগ্রেসকে এখন ওই পরিকল্পনাই প্রণয়ন করতে হবে। এটি না করলে নেতৃত্ব পরিবর্তন করেও কংগ্রেস সাধারণ মানুষের আস্থা পাবে না। দুই-দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে নরেন্দ্র মোদি একটা ‘ইমেজ’ তৈরি করেছেন। এ ‘ইমেজ’ ভাঙাটা চাট্টিখানি কথা নয়। রাহুল গান্ধী কংগ্রেসকে সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারেননি, এমনকি তাদের পৈতৃক আসন আমেথি (উত্তর প্রদেশ) থেকে তিনি নির্বাচনে হেরে গেছেন। শুধু কেরালার ভায়ানাদ (ডধুধহধফ) আসন থেকে বিজয়ী হয়ে তিনি লোকসভায় এসেছেন। তার নেতৃত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা যে ‘সঠিক’ ছিল না, এটিই বড় প্রমাণ। তাই তিনি সরে দাঁড়িয়েছেন। এ জন্য তিনি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এটা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্যও ভালো খবর। তার এই সিদ্ধান্ত ভারতে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। অন্যান্য দলকেও এ রকম সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহ জোগাবে। বিশ্বের যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। নির্বাচনে দল যদি হেরে যায়, তা হলে দলের সভাপতি পদত্যাগ করেন এবং নতুন একজন সভাপতিকে দল পরিচালনার সুযোগ দেন। এখানে যে বিষয়টি কাজ করে, তা হচ্ছে পদত্যাগীকারী সভাপতি মনে করেনÑ তার নেতৃত্ব ও নীতি সাধারণ মানুষ তথা ভোটাররা গ্রহণ করেননি। ফলে নয়া নেতৃত্ব ও নয়ানীতির জন্য তিনি সরে দাঁড়ান। আমরা যদি ব্রিটেনের দিকে তাকাই, তা হলে এই দৃষ্টান্ত দেখতে পাব। থেরেসা মে প্রধানমন্ত্রী পদে পদত্যাগ করেছেন। কারণ তার ব্রেক্সিট প্রপোজাল তিনি ব্রিটেনের পার্লামেন্টে অনুমোদন করিয়ে নিতে পারেননি। এর আগে জনমতে (২০১৬) ব্রেক্সিট প্রশ্নে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ভোটাররা। তার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়ায় ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগ করেছিলেন। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন থেরেসা মে। এখন তিনিও পদত্যাগ করলেন। এটিই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশে এ রকমটি হয়। আমাদের দেশের জন্যও এটি এক ধরনের শিক্ষা হতে পারে। আমাদের দেশেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব দীর্ঘদিন ক্ষমতা ধরে রাখেন। দলীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলেও দলের মূল নেতৃত্ব একজনের হাতেই থেকে যায়। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে না নয়া নেতৃত্ব, সৃষ্টি হচ্ছে না একুশ শতক উপযোগী দলীয় রাজনীতি। এক ব্যক্তি ঘিরে রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। প্রায় ক্ষেত্রেই তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা দলীয় রাজনীতিতে প্রধান্য পাচ্ছে বেশি। এ ক্ষেত্রে রাহুল গান্ধীর পদত্যাগে আমাদের জন্যও একটা ‘শিক্ষা’ হতে পারে।
দৈনিক আমাদের সময়
`৯ জুলাই ২০১৯
তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
0 comments:
Post a Comment