রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রাহুল গান্ধীর পদত্যাগ ও ভারতে পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি

ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পদ থেকে রাহুল গান্ধী পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু এই পদত্যাগ কি ভারতের পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতিতে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে? কিংবা কংগ্রেস কি আবারও নেহরু-গান্ধী পরিবারের দিকে তাকাবে? সীমিত সময়ের জন্য কাউকে দায়িত্ব দিয়ে আবার কি গান্ধী পরিবারই কংগ্রেসের নেতৃত্ব দেবে? এ বিষয়গুলো এখন ভারতে বহুল আলোচিত। এখনো এ বিষয়ে লেখালেখি হচ্ছে। গত ৩ জুলাই রাহুল গান্ধী পদত্যাগ করেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দলের পরাজয়ের সব দায়দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়ে তিনি সভাপতির দায়িত্ব ছেড়ে দেন। নিঃসন্দেহে তাঁর এই পদত্যাগ সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তিনি নিজের পারিবারিক আসনেও (আমেথি, উত্তর প্রদেশ) হেরে গিয়েছিলেন। যে আদর্শ ও নীতি নিয়ে তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস লোকসভা নির্বাচনে গিয়েছিল, ভারতীয় ভোটাররা তা গ্রহণ করে নেয়নি। এ ক্ষেত্রে তিনি সভাপতি হিসেবে থেকে যেতে পারতেন। উপমহাদেশের রাজনীতিতে এমনটাই হয়। দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্ব ধরে রাখেন। এমনকি নির্বাচনে পরাজয়ের পর কিংবা আদালত কর্তৃক নির্বাচনে নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরও (পাকিস্তান) নেতৃত্ব থেকে যায় পরিবারের হাতেই। রাহুল গান্ধী এমনটি পারতেন। যে কংগ্রেসের নেতৃত্ব বারবার নেহরু-গান্ধী পরিবার থেকে এসেছে, সেই পরিবারের সর্বশেষ প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সভাপতি পদে থেকে যেতে পারতেন; কিন্তু তিনি থাকলেন না। নয়া নেতৃত্ব, নয়া নীতি ও নয়া রাজনীতির জন্য তিনি সভাপতির চেয়ার ছেড়ে দিলেন। কিন্তু ভারতীয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কি কোনো উদাহরণ?
স্পষ্ট করেই বলতে পারি, এই পদত্যাগ কোনো উদাহরণ তৈরি করবে না ভারতীয় রাজনীতির জন্য। ২৯টি রাজ্য ও সাতটি ‘ইউনিয়ন টেরিটরি’ নিয়ে ভারতের ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে উঠেছে। জম্মু ও কাশ্মীর থেকে কেরালা পর্যন্ত সর্বত্রই পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ কিছু পরিবার কোনো কোনো রাজ্যে এত বেশি শক্তিশালী যে কোথাও কোথাও একটি পরিবার স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। বিজেপি কিংবা কংগ্রেসের মতো দলও ওই পারিবারিক রাজনীতির কাছে দাঁড়াতে পারছে না। দাদা একসময় রাজনীতি করেছেন। দাদার পর বাবা, তারপর তাঁর নাতিরা এখন স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। সনাতন ভারতীয় রাজনীতির চিত্র এখন পাল্টে গেছে। একটি একক দলের পক্ষে এখন আর সরকার গঠন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সরকার গঠনে প্রয়োজন হয় আঞ্চলিক দলগুলোর সমর্থনের। ভারত এখন কোয়ালিশনের রাজনীতির যুগে প্রবেশ করেছে। সে জন্যই দেখা যায়, ভারতে জন্ম হয়েছে ইউপিএ ও এনডিএ জোটের। বলাই বাহল্য, দুটি বড় দল কংগ্রেস ও বিজেপি এই দুটি জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি বারবার নেহরু পরিবার তথা পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, নেহরুর প্রতিপক্ষ হিসেবে তিনি বল্লভ ভাই প্যাটেলকে সামনে এনেছেন। তাঁর একটি বিশাল স্ট্যাচু তিনি তৈরি করেছেন গুজরাট রাজ্যের নর্মদা জেলার কাভাদিয়া এলাকায়। ১৮২ মিটার দীর্ঘ এই স্ট্যাচু (স্ট্যাটিউ অব ইউনিটি) তৈরি করতে খরচ হয়েছে দুই হাজার ৯৮৯ কোটি রুপি, যা ৪২০ মিলিয়ন ডলার সমতুল্য। বল্লভ ভাই প্যাটেল ছিলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
মোদি ভারতকে পরিবারতন্ত্রের বেড়াজাল থেকে বের করে নিয়ে আসতে চান; কিন্তু তা সম্ভব হবে না। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। কর্ণাটকের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে দেব গৌড়া পরিবার। দেব গৌড়া সীমিত সময়ের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন (জনতা দল, ১৯৯৬-৯৭)। এখন তাঁর ছেলে এইচ ডি কুমারাস্বামী কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী। নাতি প্রাজোয়াল রেভান্মা ও নিখিল কুমারাস্বামী (আরেক নাতি) কর্ণাটকের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। দেব গৌড়ার দল জনতা দল (সেক্যুলার) কর্ণাটকে আঞ্চলিক রাজনীতিতে অন্যতম একটি শক্তি। উত্তর প্রদেশে রয়েছে মুলায়াম সিং যাদব পরিবার। সমাজবাদী দল নিয়ে তাদের অবস্থান সেখানে শক্তিশালী। ছেলে অখিলেশ যাদব উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। ঝাড়খণ্ডে রয়েছেন শিবু সরেনের পরিবার ও তাঁর দল জেএসএম বা ঝাড়খণ্ডমুক্তি মোর্চা। মেয়ে অবুলি সরেন এখন ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছেন বাবার স্থান নিতে। তামিলনাড়ুতে রয়েছে করুণানিধির পরিবার। মেয়ে কানিমাঝি এখন দল ডিএমকের মূল ব্যক্তি। মহারাষ্ট্রে সারদ পাওয়ারের রয়েছে নিজ দল এনসিপি। মেয়ে সুপ্রিয়া সুলে এখন বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন। বিহারে রাম বিলাস পাসওয়ান ও লালুপ্রসাদের খবর সবাই জানে। পাসওয়ান পরিবার—দুই ছেলে চিরাগ পাসওয়ান ও রামচন্দ্র পাসওয়ান এবং ভাই পশুপতি কুমার পরাশ এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। তাঁর দল হচ্ছে লোক জনশক্তি পার্টি। আর লালুপ্রসাদ যাদব ও তাঁর দল রাষ্ট্রীয় জনতা দল। তাঁর দুই ছেলে তেজ প্রতাপ যাদব ও তেজস্বী যাদব, মেয়ে মিসা ভারতী, হেমা যাদব—সবাই মিলে একটি সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন বিহারে। সবার স্মরণ থাকার কথা, মূর্খ (যিনি পড়ালেখা জানতেন না) রাবড়ি দেবী (লালুপ্রসাদ যাদবের স্ত্রী) বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। অন্ধ্র প্রদেশের রামা রাওয়ের ছেলে কিশোর চন্দ্র দিত্ত ও মেয়ে শ্রুতি দেবী, পাঞ্জাবে আকালি দলের মূল নেতা শুকবির সিং বাদল ও তাঁর পরিবার পাঞ্জাবের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। মায়াবতীর কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। উত্তর প্রদেশের লাখ লাখ দলিতের, অর্থাৎ নিম্ন শ্রেণির মানুষের ‘সেন্টিমেন্ট’কে পুঁজি করে মায়াবতী চার-চারবার উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। লালুপ্রসাদ ও রাম বিলাস পাসওয়ানও দলিত, অর্থাৎ নিম্ন শ্রেণির। এটাই তাঁদের প্লাস পয়েন্ট।
এই দলিত আর পারিবারিক রাজনীতিই হচ্ছে ভারতীয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ। ক্ষমতায় আসার জন্য প্রয়োজনে তাঁরা দল বদল করেন। কখনো নিজে দল গঠন করে স্থানীয়ভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে চান। কিন্তু রাহুল গান্ধী ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি উচ্চ বংশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি পারিবারিক ধারায় রাজনীতিতে এসেছিলেন। মোতিলাল নেহরু (১৯২৮), জওয়াহেরলাল নেহরু (১৯২৯, ৩০, ১৯৩৬, ১৯৩৭, ১৯৫১, ৫২, ৫৩, ৫৪), ইন্দিরা গান্ধী (১৯৫৯, ১৯৭৮-৮৩), রাজীব গান্ধী (১৯৮৫-৯১), সোনিয়া গান্ধীর (১৯৯৮-২০১৭) পথ ধরে রাহুল গান্ধীও কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন (২০১৭-১৯)। তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস ১৭তম লোকসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু কংগ্রেস সর্বশেষ ১৭তম লোকসভায় পায় ৫২ আসন। ফলে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এখন কংগ্রেসকে নেহরু পরিবারের বাইরে একজনকে সভাপতি হিসেবে বরণ করে নিতে হবে। ১৩৩ বছরের (জন্ম ২৮ ডিসেম্বর ১৮৮৫) যে সংগঠন, সেই সংগঠনটি এর আগে আর এত বড় সংকটের মধ্যে পড়েনি। রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর নরসিমা রাও কংগ্রেসের হাল ধরেছিলেন। এরপর সীতারাম কেশরিও দায়িত্ব নিয়েছিলেন; কিন্তু কংগ্রেসের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারেননি। ফলে নেহরু পরিবারের ‘একজন’কেই কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। এখন পরিস্থিতি কি সেদিকেই যাচ্ছে?
পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় ‘একজন’কে (শচীন পাইলট, অশোক গেহ্লট, জ্যোতিরাদিত্য সিন্দিয়া) কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব নিতে হলেও তিনি যে সাময়িকভাবে এই দায়িত্ব পালন করবেন, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। কংগ্রেস মানেই হচ্ছে পরিবারতন্ত্র, নেহরু পরিবারের দিকেই শেষ পর্যন্ত তাকাতে হয় কংগ্রেসকে। সুতরাং কংগ্রেসের নেতৃত্ব যে শেষ পর্যন্ত প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর ওপরই বর্তাবে, তা বোধ হয় একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায়। ৪৭ বছর বয়সী প্রিয়াঙ্কা রাহুল গান্ধীর ছোট বোন ও বর্তমানে কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক। অন্তর্বর্তীকালের জন্য ‘কেউ একজন’ সভাপতির দায়িত্ব নেবেন। এবং চূড়ান্ত বিচারে আমরা দেখব প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকেই কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিতে। একটা কথা এখানে বলতেই হয়—পরিবারতন্ত্রই ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ভারতের প্রতিটি রাজ্যের রাজনীতিতে এই পরিবারতন্ত্র আছে। বংশপরম্পরায় একটি বা একাধিক পরিবার স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। আর স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার কারণে প্রায়ই সরকার গঠনে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। একসময় পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক ধরনের ‘প্রতিবাদ’ করেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেছিলেন। অথচ তাঁর নিজের বিরুদ্ধেই এখন পরিবারতন্ত্রের ব্যাপারে বড় অভিযোগ উঠেছে। তিনি ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বেশি প্রশ্রয় দিচ্ছেন এবং তাঁকে দল পরিচালনার জন্য তৈরি করছেন—এমন অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
সুতরাং ভারত তার পরিবারতন্ত্রের বাইরে যেতে পারবে না। এটাই ভারতীয় গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এর সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষ করে ইউরোপের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে মেলানো যাবে না। ব্রিটেনে সাধারণত নির্বাচনে কোনো দলের পরাজয় ঘটলে, দলের সভাপতি সরে দাঁড়ান। দল তখন নতুন একজন সভাপতি নির্বাচিত করে। আর হেরে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে ব্যক্তিগতভাবে বিজয়ী হলেও তিনি ‘ব্যাকবেঞ্চার’ এমপি হয়ে যান। তবে ব্রিটেনে না হলেও ফ্রান্স, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডে এক ধরনের পরিবারতন্ত্র আছে। সব সময় রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র যে খারাপ, তা বলা যাবে না। ভারতের ক্ষেত্রে পরিবারতন্ত্রের নতুন সদস্যদের অনেকেই উচ্চশিক্ষিত, বিদেশে পড়াশোনা করা অনেকেই আছেন। সুতরাং রাহুল গান্ধীর পদত্যাগ কংগ্রেসের জন্য কোনো ভালো খবর বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। কংগ্রেসকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে প্রয়োজন নয়া রাজনীতি এবং তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো। এই কাজটি কংগ্রেস করতে পারেনি। ‘মোদি ম্যাজিক’-এর বিকল্প হিসেবে কোনো রাজনীতি উপস্থাপন করতে পারেনি কংগ্রেস। তাই পরাজয় ছিল অবধারিত।
নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র


kalerkantho

১৪ জুলাই, ২০১৯

লেখক : 

তারেক শামসুর রেহমান

অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com


0 comments:

Post a Comment