মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির এশিয়া সম্পর্কিত উপকমিটিতে গত ১৩ জুন ‘দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ এবং ২০২০ অর্থবছরের বাজেট’ সম্পর্কিত শুনানিতে এ উপকমিটির চেয়ারম্যান কংগ্রেসম্যান (ডেমোক্রেট, ক্যালিফোর্নিয়া) ব্র্যাড শেরম্যান একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন।
তিনি বলেছেন, মিয়ানমার সরকার যদি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী না হয়, রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকজনকে নিরাপত্তা দিতে না চায় অথবা অপারগ হয়, তাহলে ওই রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাকে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করা উচিত এবং ওই এলাকাকে বাংলাদেশের কাছে স্থানান্তর করতে (বাংলাদেশের অংশ করতে) যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেয়া উচিত, যা ওই এলাকার মানুষও চাচ্ছে।
কংগ্রেসম্যান শেরম্যান আরও বলেছেন, রোহিঙ্গারা এমন একটি সরকারের অধীনে থাকতে চায়, যারা তাদের নিধন নয়, সুরক্ষায় আন্তরিক অর্থে কাজ করবে।
ওই শুনানিতে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ভারপ্রাপ্ত সহকারী মন্ত্রী রাষ্ট্রদূত অ্যালিস ওয়েলস এবং ইউএস এইডের ভারপ্রাপ্ত সহকারী প্রশাসক গ্লোরিয়া স্টিলি নিজ নিজ বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তবে তারা উপরোক্ত বক্তব্যের আলোকে কোনো মতামত দেননি।
কংগ্রেসম্যান শেরম্যান যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা সরকারি কোনো বক্তব্য নয়। অর্থাৎ ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি এটা নয়। তবে কংগ্রেসের উভয় চেম্বার, অর্থাৎ সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে এ ধরনের প্রস্তাব পাস হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এ ধরনের একটি বক্তব্য সম্পূর্ণ নতুন এবং নিঃসন্দেহে তা চিন্তার খোরাক জোগাবে।
এ ধরনের একটি প্রস্তাব কোনো আমেরিকান রাজনীতিকের কাছ থেকে এই প্রথম এলো। এটা বলতেই হবে, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে এ প্রস্তাব আদৌ কোনো ভালো ‘সংবাদ’ বয়ে আনবে না। বাংলাদেশ সরকার কংগ্রেসম্যান শেরম্যানের প্রস্তাবে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও মিয়ানমার সরকারের একটি প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইকোনমিক টাইমস মিয়ানমার সরকারের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, তাদের মতে ওই প্রস্তাব একটি দেশের অখণ্ডতা ও স্বায়ত্তশাসনের প্রতি অশ্রদ্ধা। এটি অবাস্তব ধারণার ওপর ভিত্তি করে অমূলক প্রস্তাব বলে তারা মনে করেন।
কংগ্রেসম্যান শেরম্যানের প্রস্তাব যে অবাস্তব, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি কোনো ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলটির যথেষ্ট স্ট্র্যাটেজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। এ স্ট্র্যাটেজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের কারণে চীন ও ভারত রাখাইনে বড় বিনিয়োগ করেছে।
এখন মার্কিন কোম্পানিগুলোরও আগ্রহ রয়েছে এ অঞ্চলের ব্যাপারে। শেরম্যানের মন্তব্যের পেছনে এ ধরনের কোনো উদ্দেশ্য কাজ করছে- এমন সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
রাখাইন রাজ্যে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, যা এখনও উত্তোলন করা হয়নি। নব্বইয়ের দশকে মিয়ানমার একটি আইন পাস করে, যেখানে রাষ্ট্রকে ব্যক্তিগত যে কোনো জমি অধিগ্রহণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র ‘তার প্রয়োজনে ও উন্নয়নের স্বার্থে’ যে কোনো ব্যক্তিগত জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে। মিয়ানমার সরকার তা করেছেও।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, রাখাইনের প্রায় ৩৬২ গ্রাম থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করে সেখানকার বসতবাড়ি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। ওইসব গ্রামের বসতবাড়ির কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই। এসব এলাকায় কোথাও কোথাও সেনা ছাউনি করা হয়েছে। কোথাও বা আবার ওই জমি বিনিয়োগকারীদের দেয়া হয়েছে।
খনি খনন করে তারা সেখান থেকে মূল্যবান পাথর সংগ্রহ করছে। একইসঙ্গে অন্যান্য মিনারেলের অনুসন্ধান চলছে। তুলনামূলক বিচারে চীন ও ভারতের আগ্রহ এখানে বেশি।
রাখাইন ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের গভীরে বিপুল পরিমাণ গ্যাস ও তেলের রির্জাভ পাওয়া গেছে। চীনের আগ্রহটা সে কারণেই। চীন রাখাইনের পাশ ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্রে গ্যাস আহরণ করছে এবং সেই গ্যাস তারা নিয়ে যাচ্ছে তার ইউনান প্রদেশে। ইউনান প্রদেশে কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। অথচ তার জ্বালানি দরকার।
তাই পাইপলাইনের মাধ্যমে মিয়ানমারের একাধিক রাজ্যের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইউনান রাজ্যে। ২০১৪ সালের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় মিয়ানমার ১২ দশমিক ৭ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে চীন (৯.৭ বিলিয়ন কিউবিক মিটার) ও থাইল্যান্ডে (৩ বিলিয়ন) সরবরাহ করেছে। ২০১৮-এর পরিসংখ্যান পেলে দেখা যাবে, সরবরাহের পরিমাণ অনেক বেশি। বলাই বাহুল্য, ইউনান প্রদেশের ‘জ্বালানি ক্ষুধা’ মেটাচ্ছে মিয়ানমারের গ্যাস।
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮৮-২০১৮ সময়সীমায় চীন ২০ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে ৫৭ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে; তেল, গ্যাস ও খনি খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ১৮ শতাংশ। চীন রাখাইন রাজ্যের Kyaukpyu-তে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে।
এতে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। ৫২০ হেক্টর জমিতে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে সেখানে, যাতে স্থানীয় ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। চীন একইসঙ্গে Muse-Mandalay রেলওয়ে লাইনও তৈরি করছে। এতে করে Kyaukpyu থেকে চীনের ইউনান প্রদেশের সীমান্তবর্তী Muse পর্যন্ত রেললাইন ও পাইপলাইন সংযুক্ত হবে।
উদ্দেশ্য হচ্ছে, চীন রাখাইন প্রদেশের গভীর সমুদ্রে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে যে পরিমাণ গ্যাস ও তেল উত্তোলন করছে, তা এই পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশে নিয়ে যাওয়া। চীন একইসঙ্গে ২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ৮১০ কিলোমিটার দীর্ঘ Kyaukpyu-Kunming রেললাইনও তৈরি করছে। Muse-Mandalay রেললাইনের সম্প্রসারিত অংশই হচ্ছে Kyaukpyu-Kunming রেললাইন।
আমরা বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার) করিডোরের কথাও উল্লেখ করতে পারি। এ করিডোরের আওতায় ইউনান প্রদেশের সঙ্গে কক্সবাজারের সড়ক ও রেলপথ সংযুক্ত হবে।
এ কারণেই চীন সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল। সেটি এখন আর তৈরি হচ্ছে না। চীন সোনাদিয়ার গভীর সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে ইউনান প্রদেশে উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রফতানি করতে পারত।
এমনকি সড়কপথে চীনা পণ্য বাংলাদেশেও আসতে পারত। তাতে করে চীনা পণ্যের দাম কমে যেত। বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোরের এটি একটি অংশ। এখন রোহিঙ্গা সংকটের কারণে বিসিআইএম করিডোরের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে। সুতরাং চীন এতদিন যে রোহিঙ্গা সংকটে মিয়ানমারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তার কারণ মূলত এটাই।
ভারতের অবস্থানও অনেকটা তেমনি। চীন যেখানে রাখাইনের Kyaukpyu-তে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে, সেখানে ভারত Sittwe-তে যে সমুদ্রবন্দরটি রয়েছে, তার উন্নয়ন করছে।
এ অঞ্চলকে ঘিরে ভারতের Kaladan পরিকল্পনার কথা আমরা সবাই জানি। এ পরিকল্পনার আওতায় ভারত সমুদ্রপথে তার সাত বোন রাজ্যগুলোকে সংযুক্ত করছে। কলকাতার হুগলি নদী হয়ে ৫৩৯ কিলোমিটার দূরে Sittwe বন্দরকে সমুদ্রপথে সংযুক্ত করা হবে। তারপর নদীপথে মিয়ানমারের আরেক বন্দর Paletwa সংযুক্ত হবে।
Paletwa থেকে সড়কপথে (মিয়ানমারের Chin রাজ্য) Zorinpui সীমান্ত বন্দর অতিক্রম করে ১০০ কিলোমিটার দূরে মিজোরামের আইজল পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। এটাই Kaladan পরিকল্পনা। ভারতের রিলায়েন্স কোম্পানি রাখাইনের গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলন করছে। এই গ্যাস তারা নিয়ে যেতে চায় সাত বোন রাজ্যগুলোতে।
সুতরাং ভারতের স্বার্থকেও হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। এমন এক পরিস্থিতিতে পেন্টাগনের স্বার্থ থাকতে পারে। রাখাইনের গভীর সমুদ্রের গ্যাস, রাখাইনের খনিজসম্পদ, রাখাইনের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান ইত্যাদি নানা কারণে মার্কিন স্ট্র্যাটেজিস্টদের কাছে এ অঞ্চলের গুরুত্ব বাড়ছে। রাখাইনের উপকূল ঘেঁষে বঙ্গোপসাগর থেকে সহজে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করা যায়।
আর সেখান থেকে চীনা নৌবাহিনীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা সহজ। চীনকে ‘মনিটর’ করতে হলে এ অঞ্চলে তার উপস্থিতির প্রয়োজন রয়েছে। ফলে কংগ্রেসম্যান শেরম্যানের বক্তব্যের পেছনে এ ধরনের কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা, সেটাই লক্ষ করার বিষয়।
তবে বলতেই হবে, মিয়ানমারের একটা অংশকে বিচ্ছিন্ন করা কিংবা অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত করা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ। দক্ষিণ সুদান কিংবা ইস্ট তিমুরের সঙ্গে রাখাইন রাজ্যের তুলনা করা যাবে না।
নিঃসন্দেহে রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা সারা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে। কিন্তু এর সমাধান ওই প্রদেশকে বাংলাদেশের সঙ্গে সংযুক্তির মধ্য দিয়ে নয়। বরং মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যে চুক্তি হয়েছে, ওই চুক্তি বলে মিয়ানমারের জনগোষ্ঠীকে (রোহিঙ্গা) মিয়ানমার গ্রহণ করতে বাধ্য। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আজ বাধ্য করতে হবে মিয়ানমারকে ওই চুক্তি মানতে। প্
রয়োজনে জাতিসংঘের উদ্যোগে মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও একজন রোহিঙ্গাও তার নিজ দেশে ফিরে না যাওয়ায় মিয়ানমারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশকে এখন শক্ত কূটনৈতিক অবস্থানে যেতে হবে।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment