রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ভালো খবর, মন্দ খবর

সংবাদপত্রগুলোতে এখন ভালো খবরের পাশাপাশি মন্দ খবরও ছাপা হচ্ছে। প্রতিদিনই ভালো খবরের পাশাপাশি জন্ম হচ্ছে মন্দ খবরেরও। কোনো কোনো সংবাদ আমাদের ভালো লাগে। কোনো কোনো সংবাদ আমাদের কষ্ট দেয়। অনেকগুলো ভালো খবরের মাঝে একটিÑ ৭ জুলাই থেকে ঢাকায় দুই রুটে রিকশা চলাচল বন্ধ হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে গাবতলী থেকে আসাদ গেট হয়ে আজিমপুর, সায়েন্স ল্যাব থেকে শাহবাগ, কুড়িল বিশ্বরোড থেকে রামপুরা হয়ে খিলগাঁও সায়েদাবাদ পর্যন্ত রিকশা চলাচল করবে না। ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কন্ট্রোল অথরিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্তটি হয়েছে। এই সিদ্ধান্তটিকে আমি সাধুবাদ জানাই। রিকশা ধীরগতির যান। রিকশার কারণে যানযট বৃদ্ধি পায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকা শহর রিকশায় সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। আমি নিজে ফ্লাইওভারেও অবাক হয়ে রিকশা চলতেও দেখেছি। অথচ কিছুদিন আগে পর্যন্ত প্রধান সড়কে রিকশা চলত না। এখন দিব্যি প্রধান সড়কে রিকশা চলছে। ট্রাফিক পুলিশদের ম্যানেজ করেই এই রিকশা প্রধান সড়কে উঠে এসেছিল। অথচ দেখার কেউ নেই। এখন সিদ্ধান্তটি হয়েছে বটে, কিন্তু সংশয় একটা থেকেই গেল। আদৌ কি সড়ক পথে রিকশা চলাচল বন্ধ হবে? যাদের ওপর দায়িত্ব বর্তিয়েছে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করার, তারা কি এই রিকশা চলাচল বন্ধ করবেন? একটা সংশয় তো থেকেই গেল। ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকনের উদ্যোগে এই সিদ্ধান্তটি হয়েছে বটে, এখন সিদ্ধান্তটি কার্যকর ও মনিটরিং করার দায়িত্বটিও তার ওপর বর্তাবে। আরও একটা কথা দূরপাল্লার গাড়িগুলো এখন ক্রমশই ঢাকার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগেও গভীর রাত ছাড়া গাবতলী শ্যামলী তথা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন পর্যন্ত রাস্তায় গাড়ি পার্কিং করা থাকত না। এখন সন্ধ্যের পরই গাড়িগুলো দুপাশে পার্কিং করা থাকে। ফলে সৃষ্টি হয় অবর্ণনীয় যানজটের। যারা রাত ১১টা কিংবা ১২টার দিকে এ পথে চলাচল করেন (আমার নিজের অভিজ্ঞতা আছে), তারা এর ভুক্তভোগী। রাত ১২টাতেও যানজট। মেয়র সাঈদ খোকন যদি এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চান, তাহলে কোনো প্রটোকল ছাড়াই রাতে শ্যামলী গাবতলী চলে আসুন। দেখবেন রাস্তার দুপাশে গাড়ির দীর্ঘ লাইন। রাস্তা ছোট হয়ে যায় তাতে। এগুলো সব অবৈধ পার্কিং। কে তাদের অনুমতি দিল এভাবে রাস্তায় পার্কিং করার? রিকশা তুলে দিয়ে ডিএসসিসি যদি ভালো কাজ করে থাকে, তাহলে গাবতলী, কল্যাণপুর, শ্যামলী সড়ক থেকেও অবৈধ পার্কিং তুলে দিয়ে আরেকটি ভালো কাজ করবেন। এ প্রত্যাশা থাকলই। আরেকটি ভালো খবর নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। ফলে এখন থেকে নদী দখল, ভরাট, নদী দূষণ ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এটা একটা যুগান্তকারী রায়। তুরাগ নদী নিয়ে করা একটি রিটের রায় দেওয়া হয়েছিল ৩ ফেব্রæয়ারি। সম্প্রতি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। এতে ১৭ দফা একটি সুপারিশমালাও আছে। কিন্তু শঙ্কা এখানেও আছে। একজন মানুষ হত্যা করলে যে বিচার, নদী হত্যা করলেও সেই বিচার হবে। রায়ের এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। শঙ্কাটা হচ্ছে যারা নদী দখল করে, নদী ভরাট করে, তারা অত্যন্ত ক্ষমতাবান। সরকারের প্রশ্রয়ে এরা থাকে। হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন বটে, কিন্তু যারা বাস্তবায়ন করবেন, তারা কতটুকু আন্তরিক। নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কি তারা আদৌ কোনো ‘ভ‚মিকা’ নেবেন? কিছুদিন আগে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তুরাগ নদী উচ্ছেদের ছবি ও সংবাদ প্রত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। আমরা খুব উৎসাহিত হয়েছিলাম এ কারণে যে, মিরপুর বেড়িবাঁধ দিয়ে নিত্যদিন আমাদের চলাচল করতে হয়। উত্তরা ১৮নং সেক্টর (পঞ্চবটি) থেকে ঢাকায় প্রবেশের পথ এটাই। কিন্তু সন্ধ্যের পর বালুর ট্রাকে সৃষ্টি হয় অসহনীয় যানজট। বালু ব্যবসায়ীরা কারও তোয়াক্কা করে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকে এদের নিয়ন্ত্রণে। তুরাগ নদীর একটা অংশ এখনও ভরাট। নদী ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে একাধিক ভাসমান রেস্তোরাঁ। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? হাইকোর্টের এই রায়ের পর কি রেস্তোরাঁগুলো এখন অপসারিত হবে? একটি ভালো খবরও এভাবে হারিয়ে যায়। আরেকটি ভালো খবরÑ সারা দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ডিম, কলা আর রুটি দেওয়ার বিষয়ে সরকার চিন্তা-ভাবনা করছে। আপাতত পরীক্ষামূলকভাবে অক্টোবর থেকে দেশের ১৬ উপজেলায় ‘মিড ডে মিল’ হিসেবে রান্না করা খাবার পরিবেশন করা হবে। এ ধরনের ভালো খবর হয়তো আরও আছে, যা খুব কমই সংবাদপত্রে ছাপা হয়, বা আমাদের চোখে পড়ে।
কিন্তু ভালো খবরগুলোর গুরুত্ব হারিয়ে যায় মন্দ খবরের কারণে। সমাজে মন্দ খবরের সংখ্যই বেশি। সাম্প্রতিককালে মন্দ খবরগুলোই যেন বেশি করে চোখে পড়ে। কিছুদিন আগে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ‘বালিশ’ কাহিনি সারা দেশে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। সেখানে রাশিয়ান ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য ২১টি কাতেল বিশিষ্ট ভবন তৈরি করা হয়েছিল। ভবন তৈরি ও মালামাল সরবরাহের দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছিল একটি সংবাদপত্র। তাতে দেখা যায়, একটি বালিশ ক্রয় করা হয়েছে ৫৯৫৭ টাকা দিয়ে, আর তা ভবনে তুলতে খরচ হয়েছে ৭৬০ টাকা। একটি বিদ্যুতের স্টোভ কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে ৭৭৪৭ টাকা এবং যারা এটা তুলেছেন তাদের উত্তোলন খরচ দেখানো হয়েছে স্টোভপ্রতি ৬৬৫০ টাকা (ঢাকা ট্রিবিউন, ৪ জুলাই)। শেষ অবধি এ বিষয়ে হাইকোর্ট একটি আদেশ দিয়েছেন। তাতে নির্মাণাধীন ওই ভবনে আসবাবপত্র বিশ্বস্ততার সঙ্গে (গুড ফেইথ) কেনা ও উত্তোলনের ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট একটি রুল জারি করেছেন (মানবজমিন, ৩ জুলাই)। আমরা জানি না শেষ অবধি দোষী ব্যক্তিরা শাস্তি পাবে কি না? তবে সংসদে প্রধানমন্ত্রী যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী সম্পর্কে মন্তব্য করেন, তখন দোষীদের বিচার হবে, এটা আশা করতেই পারি। 
কিন্তু এ ধরনের বালিশ কাহিনি তো শত শত। এর কয়টিইবা সংবাদপত্রে প্রকাশ পায়, কয়টির ক্ষেত্রেই বা হাইকোর্ট রুল ইস্যু করেন? হাইকোর্টের এই রুল ইস্যুর কাহিনি যখন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, তখন প্রকাশিত হয়েছে আরও কয়েকটি সংবাদÑ বিটিসিএলের আধুনিকায়ন প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় ৮০০ কোটি টাকা, যেখানে একটি সিলিং ফ্যান কেনা হয়েছে এক লাখ টাকা করে (সমকাল, ৪ জুলাই)। 
সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ৮০ লাখ টাকার সরঞ্জাম কেনা হয়েছে ৭ কোটিতে, আর ভবন তৈরির আগেই যন্ত্রপাতি কিনতে প্রতিনিধিদল গিয়েছিলেন জার্মানিতে হেলফ জার্নাল, ১১ জুন)। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে আছে আরেকটি সংবাদÑ ৯৯ হাজার কোটি টাকা ঋণে সুদ দিতে হবে ৬৯ হাজার কোটি টাকা (কালের কণ্ঠ, ২৩ আগস্ট, ২০১৬)। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে চুক্তি হয়েছে ১৮ লাখ টাকার, অগ্রিম দিতে হয়েছে ১০ লাখ (যুগান্তর, ২৮ জুন)। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার পাহাড় জমেছে, এক বছরে বেড়েছে ১৩০০ কোটি টাকা (যমুনা টিভি)। ‘বালিশ’ কাহিনির মতো আরও একটি সংবাদ ৭ লাখ টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে একটি রেইনট্রি গাছ। এটা পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার পায়রা সেতুর লেবুখালী নদীর তীর রক্ষা প্রকল্পের আওতায় ভ‚মি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের ক্ষেত্রে ধরা হয়েছে এ টাকা। (যমুনা টিভি, ২৯ জুন)। আর সিলেটে রেলওয়ে দুর্ঘটনার পর জানা গেল ‘বাঁশ কাহিনি’Ñ রেলওয়ে সিøপার যাতে খুলে না যায়, সে জন্য বাঁশ দিয়ে পেরেক মেরে আটকানো হয়েছে। সংবাদপত্রে রয়েছে সে কাহিনিÑ হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে ৮০টি নাটের জায়গায় রয়েছে ৩৫টি, তাও পুরনো, ক্ষয়ে যাওয়া এবং নষ্ট (সিলেট টাইমস)। আগের রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক আমাদের জানিয়েছিলেন রেললাইন সিøপারে বাঁশ ব্যবহার সম্পূর্ণ যৌক্তিক (সময় টিভি)। আর এবার, মৌলভীবাজারে আন্তঃনগর ‘উপবন এক্সপ্রেস’ দুর্ঘটনার পর বর্তমান রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জানালেন, মানুষ হুমড়ি খেয়ে ট্রেনে ওঠে, তাই এই দুর্ঘটনা (বিডি মর্নিং, ২৪ জুন)। মন্দ সংবাদ তো আরও আছেÑ ২০ বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ২ লাখ কোটি টাকা (ডেইলি স্টার, ২৪ জুন), দুধে ডিটারজেন্ট, অ্যান্টিবায়োটিক, ফরমালিন; ময়লায় টেক্সটাইলের রঙ; তেল মানহীন (ডেইলি স্টার, ২৫ জুন), পামঅয়েলের সঙ্গে ফেবিকল গাম মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে খাঁটি গাওয়া ঘি (সমকাল, ৪ জুলাই)। 
আর রডের বদলে বাঁশ দিয়ে তৈরি হয়েছে সড়ক, সরকারি ভবন, ব্রিজ। এ সংখ্যা তো অনেক। বরগুনার সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে রিফাত শরীফ নামে এক ব্যক্তিকে তার স্ত্রীর সামনে কুপিয়ে হত্যা করার দৃশ্য ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। এ ঘটনায় হাইকোর্টের বিচারপতিরা মর্মাহত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, এটা জনগণেরও ব্যর্থতা। বাংলাদেশের মানুষতো এমন ছিল না (কালের কণ্ঠ, ২৭ জুন)। আদালতের আরও একটি মন্তব্য ছিল এ রকমÑ নয়ন বন্ড এক দিনে তৈরি হয়নি, তাকে কেউ না কেউ লালন করেছে (ইত্তেফাক, ৪ জুলাই)। মিথ্যা বলেননি হাইকোর্টের বিচারপতিরা। 
একজন সন্ত্রাসী যদি প্রশ্রয় না পায়, তাহলে সে প্রকাশ্যে এভাবে মানুষ খুন করতে পারে না। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কথাই পরোক্ষভাবে বলে গেলেন বিচারপতিরা। সমাজ কীভাবে বদলে যাচ্ছে এটা তার বড় প্রমাণ। একজন ডিআইজি মিজান ঘুষ দেওয়ার কথা প্রকাশ্যে বলেন, কোটি কোটি টাকা আবৈধভাবে অর্জন করেন। আর ওসি মোয়াজ্জেমের কাহিনি তো সবার জানা। মন্দ সংবাদগুলো সব ভালো সংবাদগুলোকে চেপে রাখে। ভালো সংবাদগুলো আর সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায় না। একটি অন্যায় আরেকটি অন্যায়কে ডেকে আনে। একটি মন্দ সংবাদ আরেকটি মন্দ সংবাদের জন্ম দেয়। একটি মন্দ সংবাদের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের যখন বিচার হয় না, তখন মানুষের মাঝে হতাশা বাড়ে। এ ধরনের হতাশা একটি দেশের জন্য কখনই কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনতে পারে না। 

তারেক শামসুর রেহমান


দৈনিক সময়ের আলো 
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৯ জুলাই, ২০১৯

0 comments:

Post a Comment