রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং কিছু মৌলিক প্রশ্ন



গত ৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চীন সফর শেষ করে ঢাকায় যে সংবাদ সম্মেলনটি করেন, তাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, রাখাইনকে বাংলাদেশের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার যে প্রস্তাব একজন মার্কিন কংগ্রেসম্যান করেছেন, তা অত্যন্ত গর্হিত ও অন্যায়। তিনি আরও বলেছেন, আমরা এই অঞ্চলে শান্তিতে বিশ^াসী। কারও ভূখ- আমাদের লাগবে না। বলা ভালো, মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির এশিয়া সম্পর্কিত উপকমিটিতে কংগ্রেসম্যান ব্র্যান্ড শারম্যান একটি প্রস্তাব করেন গত ১৩ জুন। তাতে তিনি বলেন, মিয়ানমার সরকার যদি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী না হয়, রাখাইন স্টেটের উত্তরাঞ্চলের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকজনকে নিরাপত্তা দিতে না চায়, অথবা অপারগ হয়, তাহলে ওই স্টেটের (অর্থাৎ রাখাইন স্টেটের) রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাকে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করা উচিত এবং ওই এলাকাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করতে (অর্থাৎ বাংলাদেশের অংশ করতে) যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেওয়া উচিত, যা ওই এলাকার মানুষও চাচ্ছে।’ বক্তব্যটি স্পষ্ট। যেহেতু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার সুরক্ষা দিতে পারছে না, সুতরাং ওই এলাকা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হোক! শারম্যান এভাবেই কথাটা বলতে চেয়েছেন।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কংগ্রেসম্যান শারম্যানের ওই ‘প্রস্তাব’ শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি, তিনি আরও বলেছেন, ‘মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী দেশ। সেখানে যখন এ ধরনের একটা ঘটনা ঘটেছে, সেখানকার লোকজন আমাদের কাছে আশ্রয় চেয়েছে, মানবিক কারণে আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। আশ্রয় দেওয়ার অর্থ এটা নয়, আমরা তাদের রাষ্ট্রের একটা অংশ নিয়ে চলে আসব। এই মানসিকতা আমাদের নেই। এটা আমরা চাই না। প্রত্যেক দেশ তাদের সার্বভৌমত্ব নিয়ে থাকবে, এটাই আমি চাই।’ প্রধানমন্ত্রী সঠিকই বলেছেন। মিয়ানমার একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। রোহিঙ্গা সমস্যা তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান তাদেরই করতে হবে। বাংলাদেশ তাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। উপরন্তু জাতিসংঘের সনদে এ ধরনের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ। জাতিসংঘ সনদের ২নং ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে (২.৩) যে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সকল রাষ্ট্র আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে সকল ধরনের বিরোধের মীমাংসা করবে। তারা এমন কোনো সিদ্ধান্তে যাবে না, যা বিশ^ শান্তিকে বিঘিœত করে।

জাতিসংঘ সনদের ২.৪ ধারায় বলা আছে কোনো রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিস্মিত হয় এমন কোনো কর্মকা-ে অংশ নেবে না। সুতরাং জাতিসংঘ সনদের ২.৩ ও ২.৪ ধারা লঙ্ঘিত হয় এমন কোনো কর্মকা-ে (অর্থাৎ পরোক্ষভাবে যুদ্ধ কিংবা অন্যের এলাকা দখল করা) বাংলাদেশ অংশ নিতে পারে না। কংগ্রেসম্যান শারম্যানের বক্তব্য জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থি ও অগ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চেয়ে আসছে। এটাই বাংলাদেশের ডিপ্লোম্যাসি। রাখাইন প্রদেশে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, যা এখনো উত্তোলন করা হয়নি। মিয়ানমার ২০১২ সালে একটি আইন পাস করেছে (ঠরৎমরহ খধহফং গধহধমবসবহঃ অপঃ-ঠঋঠ)। এই আইন অনুযায়ী পরিত্যক্ত কিংবা যে জমি ব্যবহার হচ্ছে না, সেই জমি অধিগ্রহণের ক্ষমতা রাষ্ট্রকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র তার প্রয়োজনে ও উন্নয়নের স্বার্থে যেকোনো ব্যক্তিগত জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে। মিয়ানমার সরকার তাই করেছেও।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, রাখাইনের প্রায় ৩৬২ গ্রাম থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করে সেখানকার বসতবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ওইসব গ্রামের বসতবাড়ির কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই। এসব এলাকায় কোথাও কোথাও সেনা ছাউনি করা হয়েছে। কোথাও বা আবার এই জমি বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হয়েছে। খনি খনন করে তারা সেখান থেকে মূল্যবান পাথর সংগ্রহ করছে। একই সঙ্গে অন্যান্য মিনারেলের অনুসন্ধান চলছে। তুলনামূলক বিচারে চীন ও ভারতের আগ্রহ এখানে বেশি। রাখাইন পাশ ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের গভীরে বিপুল পরিমাণ গ্যাস ও তেলের রিজার্ভ পাওয়া গেছে। চীনের আগ্রহটা সে কারণেই।
চীন রাখাইনের পাশ ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্রে গ্যাস আহরণ করছে এবং সেই গ্যাস তারা নিয়ে যাচ্ছে ইউনান প্রদেশে। ইউনান প্রদেশের কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। অথচ তার জ¦ালানি দরকার। তাই পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস ও তেল মিয়ানমারের একাধিক রাজ্যের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইউনান রাজ্যে। ২০১৪ সালের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় মিয়ানমারের ১২ দশমিক ৭ মিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে চীন (৯.৭ মিলিয়ন কিউবিক মিটার) ও থাইল্যান্ডে (৩ বিলিয়ন) সরবরাহ করেছে। ২০১৮-এর পরিসংখ্যান পেলে দেখা যাবে সরবরাহের পরিমাণ অনেক বেশি। বলাবাহুল্য ইউনান প্রদেশের ‘জ¦ালানি সুধা’ মেটাচ্ছে মিয়ানমারের গ্যাস। পরিসংখ্যান বলছে ১৯৮৮-২০১৮ সময়সীমায় চীন ২০ দশমিক ২৪ মিলিয়ন ডলার মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছে। এর মাঝে ৫৭ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে; তেল, গ্যাস ও খনি খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ১৮ শতাংশ। চীন রাখাইন প্রদেশের শুধঁশঢ়যুঁ-তে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। এতে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। ৫২০ হেক্টর জমিতে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে সেখানে, যাতে স্থানীয় ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। চীন একই সঙ্গে গঁংব-গধহফধষধু রেলওয়ে লাইনও তৈরি করছে। এতে করে শুধঁশঢ়যুঁ থেকে চীনের ইউনান প্রদেশের সীমান্তবর্তী গঁংব পর্যন্ত রেললাইন ও পাইপলাইন সংযুক্ত হবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে চীন রাখাইন প্রদেশের গভীর সমুদ্রে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে যে পরিমাণ গ্যাস ও তেল উত্তোলন করছে, তা এই পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশে নিয়ে যাওয়া। সুতরাং সেখানে চীন বিশাল বিনিয়োগ করছে। সেখানে তাদের জাতীয় স্বার্থ রয়েছে। সেই জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে চীন এমন কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারে না, যাতে মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খারাপ হয়। তাই প্রধানমন্ত্রী যখন চীনে গিয়েছিলেন, তখন রোহিঙ্গা প্রশ্নে তারা বাংলাদেশের অবস্থানকে সমর্থন করেছেন এবং আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চেয়েছেন। বাংলাদেশ জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাক কিংবা মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি হোক, এটা চীন চায়নি।

চীন ভালো করে জানে এ সমস্যার যদি সমাধান না হয়, তাহলে ইঈওগ করিডর মুখ থুবড়ে পড়বে। অর্থাৎ কুনমিং (ইউনানের রাজধানী) থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রস্তাবিত যে সড়ক তলা রেলপথ (মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে) তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আদৌ বাস্তবায়িত হবে না। অথচ চীনের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে ইঈওগ করিডরের পরিকল্পনাটি। চীন তাই এক ধরনের সমঝোতা চায়, যাতে তার স্বার্থ রক্ষিত হয়।

বলতেই হবে মিয়ানমারের একটা অংশকে বিচ্ছিন্ন করা কিংবা অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত করা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ। দক্ষিণ সুদান কিংবা ইস্ট তিমুরের সঙ্গে রাখাইন স্টেটের তুলনা করা যাবে না। নিঃসন্দেহে রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা সারা বিশ^বাসীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। কিন্তু এর সমাধান ওই প্রদেশকে বাংলাদেশের সঙ্গে সংযুক্তির মধ্য দিয়ে নয়। বরং মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশে যে চুক্তি হয়েছে, ওই চুক্তি বলে মিয়ানমারের জনগোষ্ঠীকে (রোহিঙ্গা) মিয়ানমার গ্রহণ করতে বাধ্য। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আজ বাধ্য করতে হবে মিয়ানমারকে ওই চুক্তি মানতে। প্রয়োজনে জাতিসংঘের উদ্যোগে মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। চুক্তি স্বাক্ষরের দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও একজন রোহিঙ্গা তার নিজ দেশে ফিরে না যাওয়ায় মিয়ানমারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশকে এখন শক্ত কূটনৈতিক অবস্থানে যেতে হবে। কংগ্রেসম্যান শারম্যানের বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে প্রধানমন্ত্রী দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি কোনো উসকানিতে সাড়া দেননি। বরং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও বিশ^াসের কথা আবারও উল্লেখ করেছেন। এটাই সঠিক রাজনীতি। কোনো বৃহৎ শক্তির প্ররোচনায় বাংলাদেশ এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, যা এই এলাকায় উত্তেজনার জন্ম দেয়।

দেশরূপান্তর
১৩ জুলাই ২০১৯
নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
তারেক শামসুর রেহমান 
লেখক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

0 comments:

Post a Comment