ড. তারেক শামসুর রেহমান
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪১ বছরে পা দেবে চলতি মার্চ মাসে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে শুরু করে ২০১২ সালের ২৬ মার্চ_ এই সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি যদি পর্যালোচনা করা যায়, তাহলে মূলত তিনটি ধারা আমরা লক্ষ করব। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত একটি ধারা। দ্বিতীয় ধারার সূচনা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের আগস্টের পর, যা অব্যাহত থাকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। তৃতীয় ধারার সূচনা হয়েছে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। এ তিনটি ধারাতেই কিছু কিছু উল্লেখ্যযোগ্য অগ্রগতি আমরা লক্ষ করি। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল, তার কয়েকটি উল্লেখ্যযোগ্য দিক ছিল_ ক. সংসদীয় গণতন্ত্র, খ. সংসদীয় গণতন্ত্রের আওতায় দলীয় কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা, গ. সমাজতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো হল ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি। কোনো কোনো বিশ্লেষক এটা বলার চেষ্টা করেছেন যে এটা ছিল অনেকটা 'ভারতীয় মডেল'। ওই সময় বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। যেমন_ ক. সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের 'বিশেষ সম্পর্ক' স্থাপন, খ. ভারতের নির্ধারক ভূমিকা। তবে আদর্শ হিসেবে জোট নিরপেক্ষতা অনুসরণ করা, গ. অর্থনৈতিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, ঘ. চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে অনীহা ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় ছিলেন ৪৩ মাস। ওই সময় ব্রেজনেভ (সাবেক সেভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান) প্রণীত যৌথ নিরাপত্তা চুক্তির প্রতি সমর্থন, তৎকালীন দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকারের ৭ দফা দাবির প্রতি সমর্থন, ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতা শীর্ষক সম্মেলনের প্রতি সমর্থন ইত্যাদি কারণে বহির্বিশ্বে একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল যে বাংলাদেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে একটা অ্যালায়েন্স গড়ে তুলছে, যা এ অঞ্চলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বার্থকে রক্ষা করবে। বহির্বিশ্বে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণেই বাংলাদেশ ওই সময় সোভিয়েত শিবিরে অবস্থান করেছিল এবং সোভিয়েত-ভারত সম্পর্কের কারণে এটা একধরনের বাধ্যবাধকতাও ছিল। অভ্যন্তরীণভাবে একটা 'চাপ'ও ছিল, যারা মনে করতেন সোভিয়েত সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশে 'সমাজতন্ত্র' নির্মাণ করা যাবে না। ওই সময় ১৯৭২ সালের মার্চে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যা ছিল বিতর্কিত। শেখ মুজিব ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে ন্যাম সম্মেলনে যোগ দিলেও ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রেও গিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন। চীনের সঙ্গে প্রাথমিক যোগাযোগের একটা উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। কিন্তু সফল হননি। ১৯৭৫ সালের আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার পর বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনা হয়। এর আগে ১৯৭৫ সালে যে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল, তা বাতিল ঘোষিত হয়। সৌদি আরব ও চীন বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭৫ সালের আগস্ট-পরবর্তী ঘটনার মধ্য দিয়ে শহীদ জেনারেল জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনেন। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির ওপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। জিয়া মনে করতেন বাংলাদেশ হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শিক্ষা এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে ইসলামের শিক্ষা স্বরূপ। জিয়ার শাসনামলেই বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি ফান্ডের স্থায়ী কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভ করে। আল কুদস কমিটি ও ১৯৮১ সালে ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে ইরান-ইরাক যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারী কমিটিরও সদস্য ছিল বাংলাদেশ। জিয়ার আমলেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী পরিষদের সদস্যপদের একটিতে নির্বাচিত হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণ সম্পর্কিত এনপিটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। জেনারেল জিয়া ভারতের ভূমিকার ব্যাপারে কঠোর হয়েছিলেন। বাংলাদেশ ১৯৭৬ সালের মে মাসে ইস্তাম্বুলে এবং একই বছরে ৪২ জাতি ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে ফারাক্কা প্রশ্নটি উত্থাপন করেছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টনের প্রশ্নে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রশ্নে তার অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি চীনের সঙ্গে শুধু সম্পর্ক বৃদ্ধিই করেননি, বরং বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে চীনের উপস্থিতিকে প্রয়োজনীয় করে তুলেছিলেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক আফগান আগ্রাসনের (১৯৭৮) ব্যাপারেও বাংলাদেশ কঠোর হয়েছিল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বেগম জিয়া কিংবা শেখ হাসিনার (১৯৯৬-২০০১) বৈদেশিক নীতি ছিল জিয়া প্রণীত বৈদেশিক নীতির ধারাবাহিকতা। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির ব্যাপারে এরশাদ, বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে তেমন কোনো পার্থক্য লক্ষ করা যায়নি। তবে শেখ হাসিনার সময় চীনের ওপর থেকে 'সামরিক নির্ভরতা' কিছুটা হ্রাস করে রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির একটি উদ্যোগ লক্ষ করা যায়।
এরশাদের সময় (১৯৮২-১৯৯০) পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে ১৪ জন সোভিয়েত কূটনীতিককে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে পশ্চিমা বিশ্বে তিনি সমাদৃত হয়েছিলেন। তার আমলেই ১৯৮৫ সালে সার্ক আত্মপ্রকাশ করে, যদিও এর উদ্যোগটা নিয়েছিলেন শহীদ জিয়া। তবে ১৯৮১ সালের ৯ মে ভারতীয় নৌবাহিনী দক্ষিণ তালপট্টি দখল করে নিলেও তিনি ভারতের ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করতে পারেননি। বেগম জিয়ার (১৯৯১-৯৬, ২০০১-২০০৬) বৈদেশিক নীতির উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, ক. চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়া, খ. যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে আরো উন্নতকরণ, গ. আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ককে আরো কার্যকরী করা, ঘ. সৌদি আরব-বাংলাদেশ সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া, ঙ. ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি সমঝোতায় উপনীত হওয়ার চেষ্টা করা। বেগম জিয়ার সময় বিচারক কূটনীতি প্রয়োগ করে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নেয়। তার আমলে বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে। বেগম জিয়ার দ্বিতীয় টার্মে (২০০১-২০০৬) বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী বৈদেশিক নীতির সূচনা করে, যা ছিল আগে উপেক্ষিত। বেগম জিয়ার সময় চীন 'কুনমিং উদ্যোগ' এর কথা বলে (চীনের ইউনান প্রদেশ, মিয়ানমার, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো ও থাইল্যান্ডের সমন্বয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। কিন্তু ভারতের আগ্রহ ছিল 'গঙ্গা'-সেক্রং সহযোগিতার' ওপর, যে কারণে 'কুনমিং উদ্যোগ' এর আর জট খোলেনি। ভারত এখন আসিয়ান-এর সদস্য হতে চায়। যে কারণে 'কুনমিং উদ্যোগ' ও যেখানে চীনের জড়িত হওয়ার কথা রয়েছে, সে ব্যাপারে তার আগ্রহ কম। বেগম জিয়ার সময় মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মিয়ানমার আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্য সংকটে মিয়ানমার আমাদের জন্য একটি বড় সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিতে পারে।
শেখ হাসিনা দুই টার্মের জন্য ক্ষমতাসীন হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি হয়েছিল। যদিও তার আমলে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তিটি তিনি আর নবায়ন করেননি। ভারতে আশ্রিত পাহাড়ি শরণার্থীদের তিনি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তার আমলে সার্কের ভেতরে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত (ঝঅএছ) গৃহীত হয়েছিল। যদিও তা কার্যকরী হয়নি। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশে ভারতীয় পশু আমদানি বাড়ে তিন গুণ। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান পরপর কয়েকটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তিনি শান্তি স্থাপনের একটি উদ্যোগ নেন, যা প্রশংসিত হয়। তার সময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরকালে বাংলাদেশ সিটিসিটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। একই সঙ্গে 'হানা' চুক্তিও (হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাসিসটেন্স নিডস অ্যাসেসমেন্ট) স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। তিনি ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ক্ষুদ্রঋণ শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে চীনকে বেছে নেওয়া হলেও সামরিক ক্ষেত্রে চীনের ওপর থেকে পরিষদে নির্ভরশীলতা তিনি কমানোর উদ্যাগ নিয়েছিলেন। তার আমলে ঢাকায় রাশিয়ার অস্ত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ওই সময় চীনের বদলে রাশিয়া থেকে ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় করেছিল (মূল্য ১২৪ মিলিয়ন ডলার)। চীন মিগ-২৯ বিমান সরবরাহ করতে রাজি হলেও বাংলাদেশ ওই বিমান রাশিয়া থেকে সংগ্রহ করেছিল। শেখ হাসিনার সঙ্গে বাংলাদেশ দুটি আঞ্চলিক জোট ডি-৮ ও বিমসটেক-এ যোগ দেয়। তিনি ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে (ইসলামবাদ, মার্চ, ১৯৯৭) যোগ দিয়ে ইসলামী বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি একটি অভিন্ন শহর প্রতিষ্ঠারও দাবি জানিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি একটি মহাজোট সরকার গঠন করেছেন।
মহাজোট সরকারের সময় অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি উন্নত হয়েছে। ট্রানজিট (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডর) নিয়ে বাংলাদেশে বড় বিতর্ক থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে তা কার্যকরও হয়েছে, যদিও ট্রানজিট ফি এখনো নির্ধারিত হয়নি। বলা হচ্ছে ট্রানজিটের বিষয়টি বহুপক্ষীয়তার আলোকে দেখা হবে। কিন্তু দেখা গেল ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করছে, ভুটান বা নেপাল এখনো ট্রানজিট পায়নি। ভারতের এ দুটো দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার কথা। কিন্তু ইতিমধ্যে এই সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে_ এ তথ্য আমাদের জানা নেই। এমনকি ভারতের 'সাত বোন' রাজ্যগুলো কর্তৃক চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দর ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে করে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশি পণ্য খালাশ করতেই হিমশিম খাবে। এ ক্ষেত্রে 'সাত বোন' রাজ্যের পণ্য শক্ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ভারত অবকাঠামো খাতে যে ঋণ দিয়েছে তাও বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর ঋণের মতোই এই ঋণ দিয়ে ভারতীয় পণ্য ও সেবা কিনতে আমরা বাধ্য। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতাসংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব অনেক বেশি। ওই চুক্তিতে যে 'ভাবে' ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে করে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে বেশি করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। গত তিন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক যেভাবে পরিচালিত হয়েছে তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে, তা বলা যাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা সন্দেহ অবিশ্বাসে ঢাকা। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. ইউনূসের অপসারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে হিলারি ক্লিনটন যে খুশি হননি, তা আকারে ইঙ্গিতে আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। হিলারি ক্লিনটন মিয়ানমার সফর করলেন, বাংলাদেশে আসেননি। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকা- নিয়েও ওয়াশিংটন যে খুশি, তা বলা যাবে না। এমনকি বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে মার্কিন প্রশাসন। দুর্নীতি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা। দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন স্থগিত করার ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য একটি ইমেজ সংকট সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশে একটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে আলোচনা চূড়ান্ত করেছে। এই পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে বাংলাদেশে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তবে একটি সফলতা এসেছে সমুদ্রসীমা নিয়ে। ট্রাইব্যুনালের রায় আমাদের পক্ষে আসায় মিয়ানমারের সঙ্গে ৩৮ বছরের বিরোধের সমাধান হয়েছে। সমুদ্রে আমাদের অধিকার রক্ষিত হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু কূটনীতিতে আমরা তেমন সফল হইনি। মোট কথা গেল তিন বছরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে সফলতার হার তুলনামূলক বিচারে অনেক কম। জাতীয় স্বার্থকে চিহ্নিত করার ব্যর্থতা বহির্বিশ্বে আমাদের অবস্থানকে দুর্বল করেছে। ঘন ঘন বিদেশ সফর আর সম্মেলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আর যা-ই হোক, পররাষ্ট্রনীতিতে বড় সফলতা অর্জন করা যায়নি। যে কারণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। পররাষ্ট্রনীতিতে সফলতা পেতে হলে একদিকে যেমন প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি, অন্যদিকে তেমন প্রয়োজন সঠিক নীতিটি প্রণয়ন।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
DESTINY 21.3.2012
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment