ভদ্রলোকের নাম রবার্ট ও ব্লেক জুনিয়র। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একজন। তাঁর দায়িত্বে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া। তিনি ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সফরে এসে সংবাদ সম্মেলনে যা বললেন, তাতে করে একটি মেসেজ তিনি দিয়ে গেলেন বলেই মনে হলো। এর আগেও তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিন্তু এভাবে তিনি স্পষ্ট করে কখনো বক্তব্য রেখেছেন বলে মনে হয় না। তাঁর বক্তব্যের নানা ব্যাখ্যা হতে পারে এখন। তিনি শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে সংকীর্ণ রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে দেশের জন্য একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি আগামী নির্বাচন কিভাবে অবাধ, সুষ্ঠু এবং সব দলের অংশগ্রহণ উপযোগী হবে, এর ফর্মুলা প্রধান দুই দলকে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করারও আহ্বান জানান। ব্লেকের বক্তব্য আসলে এমন একসময়, যখন বিএনপি আগামী ১২ মার্চ, ঢাকা চলো কর্মসূচি পালন করতে যাচ্ছে। এর পাল্টা হিসেবে আওয়ামী লীগও ওই দিন কর্মসূচি দিয়েছে। বিএনপির দাবি মূলত একটাই_তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল। এ ক্ষেত্রে বিএনপি কিছুটা নমনীয় হয়ে যেকোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতেও রাজি। কিন্তু আওয়ামী লীগের বক্তব্য বর্তমানে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। আর নির্বাচন হতে হবে সংবিধান অনুসরণ করেই।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, বিশেষ করে এক-এগারোর (২০০৭) তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্কের মাত্রা বাড়ালেও এর আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে তেমন বিতর্ক হয়নি। ২০০৭ সালের এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্কিত হয়েছিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতির অসাংবিধানিক কিছু ভূমিকার কারণে। এর মধ্য দিয়ে পুরো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করা যাবে না। নিঃসন্দেহে একটি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গণতন্ত্রের পরিপন্থী। কিন্তু গণতন্ত্রের স্বার্থেই এবং গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করার জন্য এ ধরনের একটি ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়েছে বাংলাদেশে।
গণতন্ত্রে পরস্পরের প্রতি আস্থা রাখা ও বিরোধী দলকে গ্রহণযোগ্যতায় নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ জিনিসটির বড় অভাব। ফলে দেশে একের পর এক সংকট তৈরি হয়েছে, যা দেশকে একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, রাজনীতিতে মহাপ্রলয় অবসম্ভাবী। একই ধরনের কথা বলেছিলেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জুও। তিনি গণবিস্ফোরণের একটি আশঙ্কা করেছেন (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৮ নভেম্বর ২০১১)। এ ধরনের বক্তব্য শঙ্কা তৈরি করে। সরকারে যাঁরা থাকেন, ক্ষমতা পরিচালনা করেন, তাঁদের সহনশীল হতে হয়। কিন্তু দলের সিনিয়র নেতা সৈয়দ আশরাফ একবার বলেছিলেন, বিএনপি অংশ নিক আর না নিক, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই নির্বাচন হবে (যুগান্তর ১৮ জুন, ২০১১)। এই বক্তব্য অনভিপ্রেত। এতে করে সংকটের মাত্রা বাড়বে, কমবে না। সৈয়দ আশরাফ সিনিয়র নেতা। তার এ ধরনের উক্তি শোভন নয়। এতে জটিলতা আরো বাড়বে। বরং খালেদা জিয়ার বক্তব্যকে বিবেচনায় নিয়ে তিনি কিছু মন্তব্য করতে পারতেন। খালেদা জিয়া একাধিকবার জনসভায় বলে আসছেন। আর তা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকবে। তিনি লংমার্চে বারবার এ বক্তব্যটিই তুলে ধরেছেন। তিনি বলার চেষ্টা করেছেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নেই। কিন্তু একটি নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা বর্তমান সংবিধানের আলোকে প্রবর্তন করা সম্ভব। এ জন্য দরকার সরকারের সিনসিয়ারিটি। অর্থাৎ সরকার যদি আন্তরিক হয়, তাহলেই নির্বাচনের আগে একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
এমনকি সরকারের শরিকদের মধ্যেও অনেকে আছেন, যাঁরা মনে করেন সব ধরনের বিতর্ক এড়ানোর জন্য নির্বাচনের আগে একটি নিরপেক্ষ সরকার গঠন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞের ধারণাও এমনটি। ওটা না করে সরকার এককভাবে নির্বাচন করলে মঞ্জুর বা কাজী জাফরের আশঙ্কা সত্য বলে প্রমাণিত হতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, সমাধান এখনো সম্ভব। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে উচ্চ আদালতের রায়কে বিবেচনায় নিয়ে (দুই টার্ম এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার) সরকার নিজে অথবা শরিকদের কারোর মাধ্যমে একটি প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করতে পারে। তখন আমার বিশ্বাস, আলোচনায় বিএনপি অংশ নেবে। আগে সংসদে এসে বিএনপিকে প্রস্তাব দেওয়ার প্রয়োজন নেই। খালেদা জিয়ার বক্তব্যকে প্রস্তাব হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা যায়। দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনার প্রয়োজন আছে, এটা আমি বিশ্বাস করি। সংসদের বাইরেও আলোচনা হতে পারে। এমনকি তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমেও (যিনি বা যাঁরা দুই পক্ষের বন্ধু) আলোচনার সূত্রপাত করা যায়। আমি বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এমন কিছু শুভবুদ্ধির মানুষ আছেন, যাঁরা চান আলাপ-আলোচনা হোক। সেটা যে সংসদেই হতে হবে, তার কোনো মানে নেই। এমনকি আমাদের 'সিনিয়র সিটিজেন'দের কেউ কেউও এগিয়ে আসতে পারেন।
দেশের সমস্যা এখন অনেক। অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। বেকারত্ব বাড়ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ নেই। বৈদেশিক বিনিয়োগের অবস্থাও ভালো নয়। মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা বেশি কথা বলেন। সুশাসন নিয়ে নানা প্রশ্ন এখন। র্যাবের অনেক ভালো কাজ ম্লান হয়ে গেছে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায়। আমরা ভুলে যাই র্যাবকে এখন দেশের বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আসরে মানবাধিকারের প্রশ্নটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয়। আমরা চাই না র্যাব একটি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হোক। এসব ক্ষেত্রে বিরোধী দলের মতামত থাকা প্রয়োজন। কেননা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে বিরোধী দলের ভূমিকাকে উপেক্ষা করা যায় না।
কিন্তু সরকারের দৃষ্টি সেদিকে নেই। জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত একাধিক বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সেখানে বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করছে না। টিপাইমুখ বাঁধ প্রশ্নে খালেদা জিয়া সরকারকে সহযোগিতার কথা বললেও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নেতিবাচক দৃষ্টিতে এর সমালোচনা করেছেন। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে সাধারণ জনগণের উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেলেও সরকার এর প্রতিবাদ করেনি। সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করে একটি তুঘলকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সারা দেশের মানুষ যখন নানা সমস্যায় জর্জরিত, তখন সরকার ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে। এ বিচার নিয়ে বিদেশে কথা উঠেছে, স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি বলেছেন, বিচারের স্বচ্ছতার কথা। এমনই এক পরিবেশে যখন সর্বজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, বিচারকরা মুখ দেখে বিচার-অবিচার করেন (দিনকাল, ২৬ নভেম্বর ২০১১), তখন আমাদের একরাশ হতাশার মধ্যে ঠেলে দেয়। এই হতাশা সরকারি দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও লক্ষ করি। আবদুল জলিল তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন এভাবে_গুণ্ডাপাণ্ডা মনোনয়ন পেলে গণমুখী প্রশাসন হবে না। আর তোফায়েল আহমেদের মতে, ন্যাপ-সিপিবি আজ আওয়ামী লীগের কর্ণধার (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৬ নভেম্বর ২০১১)। এই যখন পরিস্থিতি, তখন সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের একটি সমঝোতা প্রয়োজন। ওই সমঝোতা হতে হবে নির্বাচনকে সামনে রেখে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রও চায় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন (মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনার বক্তব্য, যায়যায়দিন, ২৮ নভেম্বর ২০১১) এবং যেখানে সাবেক সিইসি নিজেই স্বীকার করেছেন, 'দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে হাজারো সমস্যা', সেখানে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সরকার এ ব্যাপারে যদি একটি 'সংলাপ'-এর উদ্যোগ নেয়, তাহলে তা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল।
এটা সত্যিই দুঃখজনক যে আমাদের এ কথাগুলো শুনতে হচ্ছে একজন অতিথির মুখ থেকে। ব্লেক বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলবেন, এটা আমি চাই না। এটা অনেকটা রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের শামিল। আমাদের রাজনীতি কী হবে, কোন পথে আমরা আমাদের সমস্যা সমাধান করব, বিষয়টি একান্তই আমাদের। যদিও ব্লেক যা বলেছেন, তা বোধ করি এ মুহূর্তে দেশের হাজার হাজার মানুষের একই অনুভূতি। খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা 'দলীয় রাজনীতি' পরিত্যাগ করে একটি 'সংলাপে' অংশ নেবেন এবং ২০১৩ সালে দশম সংসদ নির্বাচন কিভাবে অনুষ্ঠিত হবে, সে ব্যাপারে একটি 'ফর্মুলা' বের করবেন। সংবিধানের দোহাই দিয়ে দলীয়ভাবে নির্বাচন করা যাবে বটে, কিন্তু তাতে বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাবে না এবং ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতাও থাকবে না। আমরা চাই আর না চাই, পছন্দ করি আর নাই করি, ব্লেক ঢাকায় এসে এই মেসেজটিই আমাদের দিয়ে গেলেন_একটি নির্বাচন হোক তাতে যেন সবার অংশগ্রহণ থাকে।
গণতন্ত্রে পরস্পরের প্রতি আস্থা রাখা ও বিরোধী দলকে গ্রহণযোগ্যতায় নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ জিনিসটির বড় অভাব। ফলে দেশে একের পর এক সংকট তৈরি হয়েছে, যা দেশকে একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, রাজনীতিতে মহাপ্রলয় অবসম্ভাবী। একই ধরনের কথা বলেছিলেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জুও। তিনি গণবিস্ফোরণের একটি আশঙ্কা করেছেন (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৮ নভেম্বর ২০১১)। এ ধরনের বক্তব্য শঙ্কা তৈরি করে। সরকারে যাঁরা থাকেন, ক্ষমতা পরিচালনা করেন, তাঁদের সহনশীল হতে হয়। কিন্তু দলের সিনিয়র নেতা সৈয়দ আশরাফ একবার বলেছিলেন, বিএনপি অংশ নিক আর না নিক, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই নির্বাচন হবে (যুগান্তর ১৮ জুন, ২০১১)। এই বক্তব্য অনভিপ্রেত। এতে করে সংকটের মাত্রা বাড়বে, কমবে না। সৈয়দ আশরাফ সিনিয়র নেতা। তার এ ধরনের উক্তি শোভন নয়। এতে জটিলতা আরো বাড়বে। বরং খালেদা জিয়ার বক্তব্যকে বিবেচনায় নিয়ে তিনি কিছু মন্তব্য করতে পারতেন। খালেদা জিয়া একাধিকবার জনসভায় বলে আসছেন। আর তা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকবে। তিনি লংমার্চে বারবার এ বক্তব্যটিই তুলে ধরেছেন। তিনি বলার চেষ্টা করেছেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নেই। কিন্তু একটি নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা বর্তমান সংবিধানের আলোকে প্রবর্তন করা সম্ভব। এ জন্য দরকার সরকারের সিনসিয়ারিটি। অর্থাৎ সরকার যদি আন্তরিক হয়, তাহলেই নির্বাচনের আগে একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
এমনকি সরকারের শরিকদের মধ্যেও অনেকে আছেন, যাঁরা মনে করেন সব ধরনের বিতর্ক এড়ানোর জন্য নির্বাচনের আগে একটি নিরপেক্ষ সরকার গঠন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞের ধারণাও এমনটি। ওটা না করে সরকার এককভাবে নির্বাচন করলে মঞ্জুর বা কাজী জাফরের আশঙ্কা সত্য বলে প্রমাণিত হতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, সমাধান এখনো সম্ভব। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে উচ্চ আদালতের রায়কে বিবেচনায় নিয়ে (দুই টার্ম এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার) সরকার নিজে অথবা শরিকদের কারোর মাধ্যমে একটি প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করতে পারে। তখন আমার বিশ্বাস, আলোচনায় বিএনপি অংশ নেবে। আগে সংসদে এসে বিএনপিকে প্রস্তাব দেওয়ার প্রয়োজন নেই। খালেদা জিয়ার বক্তব্যকে প্রস্তাব হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা যায়। দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনার প্রয়োজন আছে, এটা আমি বিশ্বাস করি। সংসদের বাইরেও আলোচনা হতে পারে। এমনকি তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমেও (যিনি বা যাঁরা দুই পক্ষের বন্ধু) আলোচনার সূত্রপাত করা যায়। আমি বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এমন কিছু শুভবুদ্ধির মানুষ আছেন, যাঁরা চান আলাপ-আলোচনা হোক। সেটা যে সংসদেই হতে হবে, তার কোনো মানে নেই। এমনকি আমাদের 'সিনিয়র সিটিজেন'দের কেউ কেউও এগিয়ে আসতে পারেন।
দেশের সমস্যা এখন অনেক। অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। বেকারত্ব বাড়ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ নেই। বৈদেশিক বিনিয়োগের অবস্থাও ভালো নয়। মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা বেশি কথা বলেন। সুশাসন নিয়ে নানা প্রশ্ন এখন। র্যাবের অনেক ভালো কাজ ম্লান হয়ে গেছে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায়। আমরা ভুলে যাই র্যাবকে এখন দেশের বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আসরে মানবাধিকারের প্রশ্নটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয়। আমরা চাই না র্যাব একটি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হোক। এসব ক্ষেত্রে বিরোধী দলের মতামত থাকা প্রয়োজন। কেননা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে বিরোধী দলের ভূমিকাকে উপেক্ষা করা যায় না।
কিন্তু সরকারের দৃষ্টি সেদিকে নেই। জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত একাধিক বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সেখানে বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করছে না। টিপাইমুখ বাঁধ প্রশ্নে খালেদা জিয়া সরকারকে সহযোগিতার কথা বললেও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নেতিবাচক দৃষ্টিতে এর সমালোচনা করেছেন। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে সাধারণ জনগণের উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেলেও সরকার এর প্রতিবাদ করেনি। সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করে একটি তুঘলকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সারা দেশের মানুষ যখন নানা সমস্যায় জর্জরিত, তখন সরকার ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে। এ বিচার নিয়ে বিদেশে কথা উঠেছে, স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি বলেছেন, বিচারের স্বচ্ছতার কথা। এমনই এক পরিবেশে যখন সর্বজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, বিচারকরা মুখ দেখে বিচার-অবিচার করেন (দিনকাল, ২৬ নভেম্বর ২০১১), তখন আমাদের একরাশ হতাশার মধ্যে ঠেলে দেয়। এই হতাশা সরকারি দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও লক্ষ করি। আবদুল জলিল তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন এভাবে_গুণ্ডাপাণ্ডা মনোনয়ন পেলে গণমুখী প্রশাসন হবে না। আর তোফায়েল আহমেদের মতে, ন্যাপ-সিপিবি আজ আওয়ামী লীগের কর্ণধার (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৬ নভেম্বর ২০১১)। এই যখন পরিস্থিতি, তখন সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের একটি সমঝোতা প্রয়োজন। ওই সমঝোতা হতে হবে নির্বাচনকে সামনে রেখে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রও চায় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন (মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনার বক্তব্য, যায়যায়দিন, ২৮ নভেম্বর ২০১১) এবং যেখানে সাবেক সিইসি নিজেই স্বীকার করেছেন, 'দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে হাজারো সমস্যা', সেখানে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সরকার এ ব্যাপারে যদি একটি 'সংলাপ'-এর উদ্যোগ নেয়, তাহলে তা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল।
এটা সত্যিই দুঃখজনক যে আমাদের এ কথাগুলো শুনতে হচ্ছে একজন অতিথির মুখ থেকে। ব্লেক বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলবেন, এটা আমি চাই না। এটা অনেকটা রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের শামিল। আমাদের রাজনীতি কী হবে, কোন পথে আমরা আমাদের সমস্যা সমাধান করব, বিষয়টি একান্তই আমাদের। যদিও ব্লেক যা বলেছেন, তা বোধ করি এ মুহূর্তে দেশের হাজার হাজার মানুষের একই অনুভূতি। খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা 'দলীয় রাজনীতি' পরিত্যাগ করে একটি 'সংলাপে' অংশ নেবেন এবং ২০১৩ সালে দশম সংসদ নির্বাচন কিভাবে অনুষ্ঠিত হবে, সে ব্যাপারে একটি 'ফর্মুলা' বের করবেন। সংবিধানের দোহাই দিয়ে দলীয়ভাবে নির্বাচন করা যাবে বটে, কিন্তু তাতে বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাবে না এবং ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতাও থাকবে না। আমরা চাই আর না চাই, পছন্দ করি আর নাই করি, ব্লেক ঢাকায় এসে এই মেসেজটিই আমাদের দিয়ে গেলেন_একটি নির্বাচন হোক তাতে যেন সবার অংশগ্রহণ থাকে।
ড.তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
0 comments:
Post a Comment