গ্রীষ্ম পুরোপুরি শুরু না হলেও তাপমাত্রা বাড়ছে। কিন্তু এরই মধ্যে কোথাও কোথাও লোডশেডিং শুরু হয়েছে। এবার গ্রীষ্ম কেমন কাটবে তা নিয়ে একটা শঙ্কা এখন থেকেই তৈরি হয়েছে। যে হারে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে, সে হারে বিদ্যুত্ উত্পাদন হচ্ছে না। গেল ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল গড়ে ৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট, যা আগামি এপ্রিলে গিয়ে দাঁড়াবে ৭ হাজার ১৫৭ মেগাওয়াটে। মার্চে বিদ্যুতের চাহিদা হবে ৬ হাজার ৯৫৮ মেগাওয়াট। ধীরে ধীরে এই চাহিদা বাড়বে। মে-জুন মাসে বিদ্যুতের চাহিদা আরও বাড়বে। কিন্তু সেই চাহিদার কতটুকু পূরণ হবে, সেটা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। এর ওপরে রয়েছে বোরো মৌসুমে চাষিদের বিদ্যুত্ চাহিদা। গত ৮ ফেব্রুয়ারি শীর্ষ পর্যায়ের এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, বোরো মৌসুমে প্রয়োজনে সার কারখানা বন্ধ রেখে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হবে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এবার সেচের জন্য ৭ হাজার ৮৭৬টি নতুন বিদ্যুত্ সংযোগ দেওয়া হবে। সংযোগ দেওয়ার বাকি রয়েছে ২৩ হাজার ২০৬টি। গত বছর বিদ্যুত্ সংযোগ দেওয়া হয়েছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৪৪১টি। বলা প্রয়োজন, দেশে বর্তমানে সাতটি সার কারখানায় দৈনিক প্রায় ২৯ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে কর্ণফুলী সার কারখানা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে দৈনিক প্রায় ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয় মাত্র ৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। পিডিবির হিসাব অনুযায়ী এবার সেচে পিক আওয়ারে লোডশেডিং হবে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। তবে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ধারণা বিদ্যুত্ ঘাটতির পরিমাণ দু’হাজার মেগাওয়াট ছড়িয়ে যেতে পারে। এই যে বিদ্যুত্ পরিস্থিতি, তা কোনো আশার কথা বলে না। রাজনৈতিক সঙ্কটের পাশাপাশি চাহিদামতো বিদ্যুত্ সরবরাহ করা যদি না যায়, তা হলে স্বাভাবিক কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে।
বিদ্যুত্ নিয়ে সঙ্কট আছে। চাহিদা বাড়ছে অস্বাভাবিকভাবে। কিন্তু সেভাবে উত্পাদন হচ্ছে না। হাজার হাজার ফ্ল্যাট এই ঢাকা শহরেই তৈরি হচ্ছে। এসব ফ্ল্যাটে কি আদৌ পূর্ণ বিদ্যুত্ সরবরাহ করা সম্ভব হবে? যদি না হয়, তা হলে যারা বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে নির্মীয়মান এই ফ্ল্যাটগুলো ক্রয় করেছেন, তারা এখন কী করবেন? আবাসন শিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েক লাখ মানুষ। তাদের আয় রোজগারের কী হবে? ডেভেলপাররা যদি ক্রেতাদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে না পারেন, তা হলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার কর্মী বেকার হয়ে যাবেন। সরকারের জন্য আদৌ তা কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না।
বিদ্যুৎ উত্পাদিত হয় প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে। এই গ্যাস এখন ফুরিয়ে আসছে। চলমান গ্যাস সঙ্কট মোকাবেলায় সরকার ২০০৯ সালে ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রোগ্রাম’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এর অধীনে অতি দ্রুত নতুন গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাপেক্সের হাতে থাকা ৩, ৬, ৮ ও ১১ নম্বর ব্লকের মোট ৩ হাজার ১০০ লাইন কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক (টু-ডি) সিসমিক জরিপের কাজ তিন বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে যে, স্থলভাগের ২৩টি ও অগভীর সমুদ্রের ৮টি ব্লককে পিএসসির আওতায় বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে কনোকো ফিলিপস একটির দায়িত্ব পেয়েছে। একই সঙ্গে রাশিয়ার তেল গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাসপ্রম এবং অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি সান্তোসও শিগগিরই কাজ পাচ্ছে। এমন অভিযোগও উঠেছে যে স্থলভাবে সুনেত্রার মতো বিশাল মজুদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে। কনোকো ফিলিপস যে দায়িত্বটি পেয়েছে, সেটা নিয়ে বাংলাদেশে বড় ধরনের বিতর্ক হচ্ছে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতারা এই চুক্তির বিরোধিতা করে দেশেব্যাপী প্রচুর গণসংযোগ করেছেন। তাদের যুক্তি একটাই-কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশের গ্যাস রফতানি করা যাবে না। গভীর সমুদ্রে গ্যাস পাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। কেননা মিয়ানমার এবং ভারত গভীর সমুদ্রে গ্যাস পেয়েছে। মািয়ানমারের গভীর সমুদ্রে প্রাপ্ত গ্যাস আগামী বছর যাবে থাইল্যান্ডে। চীনও এই গ্যাস কিনছে। এ ক্ষেত্রে যদি গ্যাস পাওয়া যায়, তা উত্তোলন ও জাতীয় গ্রিডে দিতে ন্যূনতম আরও পাঁচ থেকে ছয় বছর সময় প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারের কাছে বিকল্প কী, এটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। যদিও একটা কথা ইদানীং শোনা যাচ্ছে যে, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় বাপেক্স যে ৪.৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (সম্ভাব্য মজুদ) গ্যাস আবিষ্কার করেছে, তা যদি উত্তোলনের ব্যবস্থা করা যায় তা হলে বিদ্যুত্ সঙ্কটের একটা সমাধান সম্ভব। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে এই মজুদও বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে, যদিও এখন পর্যন্ত সরকার বিষয়টি খোলাসা করেনি।
যেহেতু গ্যাসের একটি সঙ্কট আছে, তা হলে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান আমরা কীভাবে করব? গ্যাসের বিকল্প হতে পারে কয়লা। এ পর্যন্ত দেশে পাঁচটি কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন। এ কয়লাসম্পদ ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য। তবে উত্তোলনযোগ্য কয়লার পরিমাণ ২০ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য ধরা যেতে পারে, যা ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কয়লা উত্তোলন নিয়েও বাংলাদেশে একটি বড় বিতর্ক রয়েছে। কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলা হবে, নাকি আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তোলা হবে-এটা নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনন করলে ছয় হাজার হেক্টর কৃষিজমি নষ্ট হবে এবং অনেককে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিপক্ষে। অথচ উন্মুক্ত পদ্ধতির একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে এই পদ্ধতিতে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা যাবে। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তুললে তোলা যাবে মাত্র ১০ শতাংশ কয়লা। বড়পুকুরিয়া কয়লাক্ষেত্রের বেলায় দেখা যাচ্ছে শতকরা ১০ ভাগ কয়লাও তোলা সম্ভব হচ্ছে না। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ অভিমত দিয়েছেন যে বড়পুকুরিয়া থেকে ১০০ মিলিয়ন টনের বেশি কয়লা তোলা সম্ভব হবে না। পক্ষান্তরে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ৬০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন টন কয়লা তোলা সম্ভব, যা বাংলাদেশের ৪০ থেকে ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দেবে।
জ্বালানি খাতে কয়লা একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি করলেও তাতে এখন রাজনীতি ঢুকে গেছে। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ীর কয়লাখনি উত্তোলনের বিরোধিতাকারী স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। তাতে মারা যান ছয় জন। এরা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। সেই থেকে ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলনের বিষয়টি ঝুলে আছে। এ ব্যাপারে সরকার এখন পর্যন্ত কোনো কয়লানীতিও গ্রহণ করতে পারেনি, যদিও ২০০৭ সালের ১১ জুন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুয়েটের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোমিন পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটি ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি সরকারের কাছে তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছিল। তাতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন, রফতানির সুযোগ না রাখা, দেশের চাহিদা পূরণের জন্য ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, খনির মুখে একটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার বিধান রাখা হয়েছিল। কিন্তু ওই রিপোর্ট গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি বর্তমান সরকার কোনো কয়লানীতিও গ্রহণ করেনি। ফলে একটি সম্ভাবনাময় সেক্টর আমাদের কোনো কাজে আসছে না। এখানে বলা ভালো, বিশ্বের ৪০ শতাংশ বিদ্যুত্ উত্পন্ন হয় কয়লা থেকে। বিশ্বের কয়েকটি দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের পরিমাণ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া ৭৯, চীন ৭৮, জার্মানি ৪৯, ভারত ৬৯, দক্ষিণ আফ্রিকা ৯২ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০ শতংশ। এখানে আরও একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ কয়লা মজুদ থাকা সত্ত্বেও সরকার খুলনা ও চট্টগ্রামে দুটি বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করছে আমদানিকৃত (ভারত) কয়লার ওপর নির্ভর করে। এই সেক্টরটিও আমরা ভারতের হাতে তুলে দিয়েছি।
অতীতে বিদ্যুত্ ঘাটতিতে সরকারি দলের সদস্যরাই অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। গত ৩ আগস্ট (২০১১) বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভায় বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়েছিল। কমিটির সভায় সরকারের দেওয়া বিদ্যুত্ উত্পাদনের পরিসংখ্যানও প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। সরকারি দলের এমপিরা যখন খোদ প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন, তখন বুঝতে কারও বাকি থাকে না পরিস্থিতি আদৌ ভালো নয়। এই যখন পরিস্থিতি, তখন আমাদের অর্থমন্ত্রী গত ১ জানুয়ারি বিদ্যুত্ ভবনে বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে এর আওতাধীন কোম্পানি ও সংস্থাগুলোর চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেছিলেন আগামী তিন বছর বিদ্যুতের দাম বাড়তে থাকবে। যেখানে বিদ্যুত্ সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, সেখানে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যুক্তিহীন। সাধারণ মানুষের এতে খুশি না হওয়ারই কথা। বিদ্যুত্ আমাদের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। সরকার যদি বিদ্যুতের এই চাহিদা পূরণ করতে না পারে, সেই সরকার অজনপ্রিয় হতে বাধ্য। বিদ্যুতের অভাব জনসাধারণের মাঝে ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই আগামী গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেই সঙ্গে আরও যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে বিদ্যুতের অপচয় রোধ করার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।
লেখক : প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tareque.rahman(a)yahoo.com
[সূত্রঃ সকালের খবর, ০৬/০৩/১২]
বিদ্যুত্ নিয়ে সঙ্কট আছে। চাহিদা বাড়ছে অস্বাভাবিকভাবে। কিন্তু সেভাবে উত্পাদন হচ্ছে না। হাজার হাজার ফ্ল্যাট এই ঢাকা শহরেই তৈরি হচ্ছে। এসব ফ্ল্যাটে কি আদৌ পূর্ণ বিদ্যুত্ সরবরাহ করা সম্ভব হবে? যদি না হয়, তা হলে যারা বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে নির্মীয়মান এই ফ্ল্যাটগুলো ক্রয় করেছেন, তারা এখন কী করবেন? আবাসন শিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েক লাখ মানুষ। তাদের আয় রোজগারের কী হবে? ডেভেলপাররা যদি ক্রেতাদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে না পারেন, তা হলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার কর্মী বেকার হয়ে যাবেন। সরকারের জন্য আদৌ তা কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না।
বিদ্যুৎ উত্পাদিত হয় প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে। এই গ্যাস এখন ফুরিয়ে আসছে। চলমান গ্যাস সঙ্কট মোকাবেলায় সরকার ২০০৯ সালে ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রোগ্রাম’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এর অধীনে অতি দ্রুত নতুন গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাপেক্সের হাতে থাকা ৩, ৬, ৮ ও ১১ নম্বর ব্লকের মোট ৩ হাজার ১০০ লাইন কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক (টু-ডি) সিসমিক জরিপের কাজ তিন বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে যে, স্থলভাগের ২৩টি ও অগভীর সমুদ্রের ৮টি ব্লককে পিএসসির আওতায় বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে কনোকো ফিলিপস একটির দায়িত্ব পেয়েছে। একই সঙ্গে রাশিয়ার তেল গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাসপ্রম এবং অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি সান্তোসও শিগগিরই কাজ পাচ্ছে। এমন অভিযোগও উঠেছে যে স্থলভাবে সুনেত্রার মতো বিশাল মজুদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে। কনোকো ফিলিপস যে দায়িত্বটি পেয়েছে, সেটা নিয়ে বাংলাদেশে বড় ধরনের বিতর্ক হচ্ছে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতারা এই চুক্তির বিরোধিতা করে দেশেব্যাপী প্রচুর গণসংযোগ করেছেন। তাদের যুক্তি একটাই-কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশের গ্যাস রফতানি করা যাবে না। গভীর সমুদ্রে গ্যাস পাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। কেননা মিয়ানমার এবং ভারত গভীর সমুদ্রে গ্যাস পেয়েছে। মািয়ানমারের গভীর সমুদ্রে প্রাপ্ত গ্যাস আগামী বছর যাবে থাইল্যান্ডে। চীনও এই গ্যাস কিনছে। এ ক্ষেত্রে যদি গ্যাস পাওয়া যায়, তা উত্তোলন ও জাতীয় গ্রিডে দিতে ন্যূনতম আরও পাঁচ থেকে ছয় বছর সময় প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারের কাছে বিকল্প কী, এটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। যদিও একটা কথা ইদানীং শোনা যাচ্ছে যে, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় বাপেক্স যে ৪.৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (সম্ভাব্য মজুদ) গ্যাস আবিষ্কার করেছে, তা যদি উত্তোলনের ব্যবস্থা করা যায় তা হলে বিদ্যুত্ সঙ্কটের একটা সমাধান সম্ভব। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে এই মজুদও বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে, যদিও এখন পর্যন্ত সরকার বিষয়টি খোলাসা করেনি।
যেহেতু গ্যাসের একটি সঙ্কট আছে, তা হলে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান আমরা কীভাবে করব? গ্যাসের বিকল্প হতে পারে কয়লা। এ পর্যন্ত দেশে পাঁচটি কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন। এ কয়লাসম্পদ ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য। তবে উত্তোলনযোগ্য কয়লার পরিমাণ ২০ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য ধরা যেতে পারে, যা ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কয়লা উত্তোলন নিয়েও বাংলাদেশে একটি বড় বিতর্ক রয়েছে। কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলা হবে, নাকি আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তোলা হবে-এটা নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনন করলে ছয় হাজার হেক্টর কৃষিজমি নষ্ট হবে এবং অনেককে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিপক্ষে। অথচ উন্মুক্ত পদ্ধতির একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে এই পদ্ধতিতে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা যাবে। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তুললে তোলা যাবে মাত্র ১০ শতাংশ কয়লা। বড়পুকুরিয়া কয়লাক্ষেত্রের বেলায় দেখা যাচ্ছে শতকরা ১০ ভাগ কয়লাও তোলা সম্ভব হচ্ছে না। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ অভিমত দিয়েছেন যে বড়পুকুরিয়া থেকে ১০০ মিলিয়ন টনের বেশি কয়লা তোলা সম্ভব হবে না। পক্ষান্তরে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ৬০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন টন কয়লা তোলা সম্ভব, যা বাংলাদেশের ৪০ থেকে ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দেবে।
জ্বালানি খাতে কয়লা একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি করলেও তাতে এখন রাজনীতি ঢুকে গেছে। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ীর কয়লাখনি উত্তোলনের বিরোধিতাকারী স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। তাতে মারা যান ছয় জন। এরা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। সেই থেকে ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলনের বিষয়টি ঝুলে আছে। এ ব্যাপারে সরকার এখন পর্যন্ত কোনো কয়লানীতিও গ্রহণ করতে পারেনি, যদিও ২০০৭ সালের ১১ জুন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুয়েটের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোমিন পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটি ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি সরকারের কাছে তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছিল। তাতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন, রফতানির সুযোগ না রাখা, দেশের চাহিদা পূরণের জন্য ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, খনির মুখে একটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার বিধান রাখা হয়েছিল। কিন্তু ওই রিপোর্ট গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি বর্তমান সরকার কোনো কয়লানীতিও গ্রহণ করেনি। ফলে একটি সম্ভাবনাময় সেক্টর আমাদের কোনো কাজে আসছে না। এখানে বলা ভালো, বিশ্বের ৪০ শতাংশ বিদ্যুত্ উত্পন্ন হয় কয়লা থেকে। বিশ্বের কয়েকটি দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের পরিমাণ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া ৭৯, চীন ৭৮, জার্মানি ৪৯, ভারত ৬৯, দক্ষিণ আফ্রিকা ৯২ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০ শতংশ। এখানে আরও একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ কয়লা মজুদ থাকা সত্ত্বেও সরকার খুলনা ও চট্টগ্রামে দুটি বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করছে আমদানিকৃত (ভারত) কয়লার ওপর নির্ভর করে। এই সেক্টরটিও আমরা ভারতের হাতে তুলে দিয়েছি।
অতীতে বিদ্যুত্ ঘাটতিতে সরকারি দলের সদস্যরাই অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। গত ৩ আগস্ট (২০১১) বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভায় বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়েছিল। কমিটির সভায় সরকারের দেওয়া বিদ্যুত্ উত্পাদনের পরিসংখ্যানও প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। সরকারি দলের এমপিরা যখন খোদ প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন, তখন বুঝতে কারও বাকি থাকে না পরিস্থিতি আদৌ ভালো নয়। এই যখন পরিস্থিতি, তখন আমাদের অর্থমন্ত্রী গত ১ জানুয়ারি বিদ্যুত্ ভবনে বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে এর আওতাধীন কোম্পানি ও সংস্থাগুলোর চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেছিলেন আগামী তিন বছর বিদ্যুতের দাম বাড়তে থাকবে। যেখানে বিদ্যুত্ সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, সেখানে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যুক্তিহীন। সাধারণ মানুষের এতে খুশি না হওয়ারই কথা। বিদ্যুত্ আমাদের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। সরকার যদি বিদ্যুতের এই চাহিদা পূরণ করতে না পারে, সেই সরকার অজনপ্রিয় হতে বাধ্য। বিদ্যুতের অভাব জনসাধারণের মাঝে ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই আগামী গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেই সঙ্গে আরও যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে বিদ্যুতের অপচয় রোধ করার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।
লেখক : প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tareque.rahman(a)yahoo.com
[সূত্রঃ সকালের খবর, ০৬/০৩/১২]
0 comments:
Post a Comment