রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

'ইটলস'-এ বিজয় ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

তারেক শামসুর রেহমান সমুদ্র আইনবিষয়ক আদালত (ইটলস) ১৪ মার্চ মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বিরোধে যে রায় দিয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের বড় 'বিজয়' অর্জিত হলেও, বাংলাদেশকে এখন মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা বাংলাদেশের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার প্রশ্নে মিয়ানমার একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যেমনি সীমান্ত রয়েছে, ঠিক তেমনি সীমান্ত রয়েছে মিয়ানমারের সঙ্গেও। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারতকে আমরা যত বেশি গুরুত্ব দিয়েছি, মিয়ানমারকে সেভাবে গুরুত্ব দিইনি। শুধু তা-ই নয়, ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট-সংক্রান্ত সমঝোতায় গেলেও মিয়ানমার রয়ে গেছে উপেক্ষিত। আমাদের নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশের উন্নয়নে মিয়ানমারের সম্ভাবনাকে কখনোই যাচাই করে দেখেননি। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক খুব ভালো, তা-ও বলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে ভারতের দৃষ্টান্ত আমরা অনুসরণ করতে পারতাম; কিন্তু তা-ও আমরা করিনি। মিয়ানমারে প্রচুর গ্যাস রিজার্ভও রয়েছে। মিয়ানমার সমুদ্রের তিনটি ব্লক ছাড়া স্থলভাগে দেশটির আরো ১৯টি ব্লক রয়েছে। সমুদ্রের তিনটি ব্লকে ১৮ দশমিক ০১২ টিসিএফ এবং অপর ১৯টি ব্লকে ৮৯ দশমিক ৭২২ টিসিএফ গ্যাস মজুদ আছে। এই গ্যাসের ব্যাপারে আগ্রহ এখন অনেক দেশের। থাইল্যান্ডের সঙ্গে গ্যাস রপ্তানির ব্যাপারে ইতিমধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চীনের সঙ্গেও মিয়ানমার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তি অনুযায়ী পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশে মিয়ানমারের গ্যাস যাবে। এর আগে ভারতও মিয়ানমারের গ্যাসের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়। ভারত চেয়েছিল বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস নিতে। এটা নিয়ে জোট সরকারের আমলে বড় ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি হয় এবং একপর্যায়ে জোট সরকার ভারতের ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। পরবর্তী সময়ে ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চল দিয়ে গ্যাস নিতে চাইলেও, পরে ওই সিদ্ধান্ত পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু তার পরও ভারত মিয়ানমারের গ্যাসের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ অব্যাহত রেখেছে। প্রতিযোগিতায় এবং গ্যাসের মূল্য নির্ধারণে ভারত চীনের কাছে হেরে গেলেও সমুদ্রে গ্যাসপ্রাপ্তিসাপেক্ষে মিয়ানমার ভারতকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আমরা এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারিনি। অথচ আমাদের জন্য সুযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশকেই এখন এগিয়ে আসতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্রুত মিয়ানমার সফর করে 'সম্পর্কের নতুন এক অধ্যায়ের' সূচনা করতে পারেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা অত্যন্ত জরুরি। দ্বিতীয়ত, চীনের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের ব্যাপারে (কুনমিং-মুসে-ঘুমধুম) বাংলাদেশ আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় তিনি কুনমিং গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ওই সড়কটির ব্যাপারে আগ্রহ দেখান। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সম্মতি ছাড়া এই সড়কটি নির্মাণ করা যাবে না। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই তাই মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক আরো উন্নত করা প্রয়োজন। এই সড়কটি যদি ভবিষ্যতে নির্মিত হয়, তাহলে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের চিত্র পুরোপুরি বদলে যাবে। তৃতীয়ত, চীন ২০০১ সালে চীনের ইউনান প্রদেশ, মিয়ানমার, ভারতের পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্য ও থাইল্যান্ডকে নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রস্তাব করেছিল, যা 'কুনমিং উদ্যোগ' নামে পরিচিত। বাংলাদেশ যে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির সূচনা করেছিল, তার সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করে এই 'কুনমিং উদ্যোগ'-এর ওপর। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিগত জোট সরকারের সময় বাংলাদেশ 'কুনমিং উদ্যোগ'-এর প্রতি সমর্থন জানালেও বর্তমান মহাজোট সরকারের বৈদেশিক নীতিতে এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। মহাজোট সরকার তার বৈদেশিক নীতিতে যেসব বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছে, তার মধ্যে 'কুনমিং উদ্যোগ' কিংবা পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির বিষয়টি নেই। বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য ছিল একটাই_তা হচ্ছে আসিয়ান বাজারে প্রবেশ করা। কিন্তু গত তিন বছরে এ ব্যাপারে তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। চতুর্থত, আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করা, বিশেষ করে আসিয়ানের 'ডায়লগ পার্টনার'-এর মর্যাদা পেতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে হবে। বাংলাদেশ বর্তমানে ২৬ সদস্যবিশিষ্ট আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামের (এআরএফ) সদস্য। এর পরের ধাপ 'ডায়লগ পার্টনার'। 'ডায়লগ পার্টনার'-এর মর্যাদা পেলে আসিয়ানের পূর্ণ সদস্যপদ পেতে সহজ হয়। ভারত ইতিমধ্যে 'ডায়লগ পার্টনার'-এর মর্যাদা পেয়েছে। বর্তমানে ১০টি দেশ এর সদস্য। পঞ্চমত, মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে চট্টগ্রামে মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক ব্যাপক শিল্প-কারখানা স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিনির্ভর মিয়ানমারে বাংলাদেশি সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন চট্টগ্রাম এলাকায় দ্রুত বেশ কিছু সার কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ মিয়ানমারে সার রপ্তানি করতে পারে। মিয়ানমারের আকিয়াব ও মংডুর আশপাশের অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এসব কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজশিল্প বিকশিত হতে পারে। মিয়ানমারের মাইআউংমিয়া দ্বীপে প্রায় ৪০ মিলিয়নের বেশি টন চুনাপাথর রয়েছে। ষষ্ঠত, মিয়ানমারে প্রচুর জমি অনাবাদি রয়েছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের ভূমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। অতীতে জমি লিজ দেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার আগ্রহ দেখিয়েছিল; কিন্তু এ ব্যাপারে তেমন অগ্রগতি হয়নি। এটা কার্যকর করা গেলে ইরাবতীর দুই কূলজুড়ে উর্বর শস্যক্ষেত্র বাংলাদেশি কৃষকরা সোনার ফসলে ভরে দিতে পারবেন। মিয়ানমারের সেগুন কাঠ পৃথিবীখ্যাত। আমাদের বিকাশমান ফার্নিচার শিল্পের প্রয়োজনে আমরা মিয়ানমার থেকে সহজে মূল্যবান কাঠ আমদানি করতে পারি, যা কিনা আমরা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে রপ্তানি করতে পারব। চাল, ডাল, ছোলা, আদা, পেঁয়াজ, রসুনসহ নানা জাতের মসলা মিয়ানমার থেকে আরো সহজে আমদানি করা যাবে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হলে। সপ্তমত, ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুর হয়ে হাজার হাজার পর্যটক মান্দালয়, কাস্পেইন ও ইয়াঙ্গুন ভ্রমণ শেষে মায়োহং আসেন। বর্তমানে এই পর্যটকরা মায়োহং থেকে পুনরায় ইয়াঙ্গুনে ফিরে যেতে বাধ্য হন। মায়োহং থেকে তাঁদের কঙ্বাজার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ভ্রমণের ব্যবস্থা করা যায়। কেননা অনেক পর্যটকই আর একই পথে ইয়াঙ্গুনে ফিরে যেতে চান না। অষ্টমত, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে অদূর ভবিষ্যতে ভারত-মিয়ানমার গ্যাস পাইপলাইন প্রজেক্টের সম্ভাবনা উজ্জ্বল, যা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতে গ্যাস রপ্তানির পরিকল্পনা নির্দেশ করে। এই পাইপলাইন প্রজেক্টের মাধ্যমে বাংলাদেশে মিয়ানমারের গ্যাস রপ্তানিও সম্ভব (মোহনা হোল্ডিংস এ ধরনের একটি প্রস্তাব করেছিল ১৯৯৬ সালে)। মিয়ানমারের কালাদান মাল্টিমুডাল রিভার প্রজেক্ট থেকেও বাংলাদেশ উপকৃত হতে পারে।
হামবুর্গে 'ইটলস'-এ বাংলাদেশের বিজয় বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। বাংলাদেশকেই এখন উদ্যোগী হতে হবে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সড়কটি দ্রুত শেষ করাও জরুরি। 'ইটলস'-এর এই রায়ের একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়ে যাবেই। বাংলাদেশ এই রায়কে নিজেদের স্বার্থে কতটুকু এবং কিভাবে ব্যবহার করবে, সেটাই দেখার বিষয় এখন।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
KALER KANTHO, 22.03.2012

0 comments:

Post a Comment