রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সংঘাতময় পরিস্থিতি দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে

তা রে ক শা ম সু র রে হ মা ন
স্বাধীনতার এই মাসে দুটি বড় দল পরস্পর পরস্পরের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। ১২ মার্চ চারদলীয় জোট ঢাকায় মহাসমাবেশ করে ১০ জুন সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাদের দাবি একটাই- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্বহাল। অন্যদিকে ১৪ মার্চ সরকার সমর্থিত ১৪ দল পাল্টা একটি জনসভা করে জানিয়ে দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের আওতায়। দুই জোটের পরস্পরবিরোধী এই অবস্থান রাজনীতিতে একটি সঙ্কট তৈরি করেছে। সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়ছে। রাজনৈতিক সঙ্কট অর্থনীতিকে একটি ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন দাতাগোষ্ঠীও। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা তারা বললেও বরফ গলছে না। বরং একধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে একেকটি দিন। একটি সমঝোতার কথা বিভিন্ন মহল থেকে উচ্চারিত হলেও সেই সম্ভাবনা দিনে দিনে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের অধীনে। বিএনপির আপত্তি সেখানেই। সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত ঘোষিত হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে এটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে দলীয় সরকারের সময় যে নির্বাচন হয় সেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় না। অতীতে মাগুরা উপনির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান মহাজোট সরকারের সময় ভোলায় যে উপনির্বাচন হয়েছে, তাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আমরা গণতন্ত্র চাই বটে, কিন্তু নিজ দলীয় কর্তৃত্বের আওতায় সেই গণতন্ত্রকে দেখতে চাই। সুতরাং দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন সেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে নেই বটে, কিন্তু তারপরও একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করা সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা এ দেশে গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে হলে দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি একটি বড় দল। এ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দলটির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে এবং এই ভূমিকা আগামীতেও থাকবে। দলটিকে অবজ্ঞা করা ঠিক হবে না। তাদের নীতি ও আদর্শ নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু দলটিকে কোনো অবস্থাতেই অবজ্ঞা করা যায় না। এটা শোভন নয়। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে আগামী জুনের পর বেগম জিয়া লাগাতার হরতালের কর্মসূচি দিলে আমি অবাক হব না। এটা বিএনপি তথা চার দলের কৌশল-সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করা। বিএনপি দীর্ঘদিন হরতালের ডাক দেয়নি। এর মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হল যে বিএনপি অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতায় যেতে চায় না। আমি অবাকই হয়েছিলাম যখন বিএনপির গণমিছিলে পুলিশের গুলিতে পাঁচ জন বিএনপি কর্মী হত্যার পরও বিএনপি হরতালের মতো বড় কর্মসূচি দেয়নি। এটা একটা ভালো লক্ষণ। আওয়ামী লীগ এটা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। বিএনপির কর্মসূচি দেখে মনে হচ্ছে বিএনপি ধীরে ধীরে তাদের কর্মসূচি নিয়ে এগুতে চায়, যাতে সাধারণ মানুষের কষ্ট না হয়। বিএনপি তথা চার দল বিগত নির্বাচনে কম আসন পেয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু মাত্র ক’টি আসন দিয়ে বিএনপি তথা চার দলকে বিবেচনা করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, চার দল ৩৭ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। এই ৩৭ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারীদের বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গেই নিতে হবে। এ কথাগুলোই বলছেন আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রদূতরা। ইতোমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তাতে করে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, একটি অর্থবহ নির্বাচনের জন্য সকল দলের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। দায়িত্বটি সরকারের। কীভাবে করবে, কোনভাবে করবে এটা সরকারকেই করতে হবে। প্রয়োজনে সরকার এ ব্যাপারে একটি সংলাপও করতে পারে। কিন্তু সরকারপ্রধান ও মন্ত্রীরা যে ভাষায় কথা বলছেন, তাতে করে তারা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছেন।
এটা সত্য, এই মুহূর্তে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কোনো বিধান নেই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, ২০১৩ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যাবে না। দু’ভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যায়। এক. সরকার সংসদে ষোলতম সংশোধনী আনতে পারে, যেখানে নতুন আঙ্গিকে, নতুন কাঠামোয় তত্ত্বাবধায়ক অথবা নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে, যাদের কাজ হবে শুধু নির্বাচন পরিচালনা করা। দুই. সরকার উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করতে পারে, যেখানে বলা হয়েছিল আরও দুটো সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় পরিচালনা করা। এ ক্ষেত্রে এটা সংবিধানের কোনো অংশ হবে না। সরকারি দল বা মহাজোটের শরিক যে কেউ এ ধরনের প্রস্তাব সংসদ তুলতে পারে এবং সরকার ওই প্রস্তাবে সায় দিতে পারে। মোট কথা, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সর্বজন গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। বিএনপি তথা চারদলীয় জোট একটি শক্তিশালী জোট। এখানে এখন আরও বেশ ক’টি দল একত্রিত হয়েছে। তাদের অবজ্ঞা করা ঠিক হবে না। লাখ লাখ মানুষ এদের আদর্শ ও নীতিতে বিশ্বাসী। সংসদেও এদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। ইতোমধ্যে বেগম জিয়া অনেক ম্যাচিউরড বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি হটকারি বক্তব্য দেননি। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে করে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একটি সংঘর্ষের রাজনীতির দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ বিএনপি তথা চার দলের প্রতিটি কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে। ১৪ মার্চ আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দল সমাবেশ করেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজে দলীয় কর্মীদের মাঠে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতি সহনশীল রাজনীতির কথা বলে না। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যে সহনশীলতার কথা বলা হয়, বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে তা নেই। বরং পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে দলীয় কর্মীদের একটি সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে দুটো বড় দল। সুতরাং আগামী নির্বাচনের আগে যদি নিরপেক্ষ সরকারের ব্যাপারে কোনো ঐকমত্য না হয়, পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হবে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হোক, একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় দশম সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা যায়। এটা করা জাতির জন্যই মঙ্গল। না হলে বিএনপি তথা চারদলীয় জোটকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হলে ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না দেশে ও বিদেশে। বিশেষ করে বিএনপির নির্বাচন বয়কট দেশকে পুনরায় ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিস্থিতির দিকে পুনরায় ঠেলে দিতে পারে। আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব নাও হতে পারে। এতে করে রাজনীতিতে সংঘাত বৃদ্ধি পাবে এবং অসাংবিধানিক শক্তিগুলো এ থেকে ফায়দা নিতে পারে। দেশের চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা এক চরম ঝুঁকির মুখে থাকবে। আমাদের অর্থনীতিতে এর যে প্রভাব পড়বে, সরকারের পক্ষে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, দাতাগোষ্ঠী বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর। তারা সব সময়ই একটি সমঝোতার কথা বলে। এ ক্ষেত্রে সরকারের একগুঁয়েমি মনোভাবের কারণে দাতারা সরকারের ওপর থেকে আস্থা তুলে নিতে পারে। আগামীতে সরকার জাতীয় পার্টিকে নিয়ে একটা ‘স্বপ্ন’ দেখলেও জাতীয় পার্টি যে পক্ষ ত্যাগ করবে না, তার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। অতীতে এরশাদ আওয়ামী লীগকে নিয়ে নির্বাচন করলেও (১৯৮৬) ক্ষমতা নিয়মসিদ্ধ করতে পারেনি। আবার আসম আবদুর রবকে (১৯৮৮) বিরোধী দল নেতা বানিয়েও ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে পারেনি। বাস্তবতা হচ্ছে এ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় জাতীয়তাবাদী জোট তথা বিএনপির ভূমিকা অনেক ব্যাপক। তাই এই জোটের একটিকেও বাদ দিলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। এখন তাই তত্ত্বাবধায়ক না হোক একটি ‘নিরপেক্ষ সরকারের’ আওতায় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অনুসরণ করতে হবে উচ্চ আদালতের রায়, যার একটি অংশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়েছে, কিন্তু অপর অংশে পরবর্তী দুটো নির্বাচন একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় করার কথা বলা হয়েছে। আরও একটি কথা, রাজনৈতিক বিষয়গুলো সংসদেই আলোচিত হওয়া উচিত। দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য, সংসদ এখন অকার্যকর। সংসদ চলছে বটে, কিন্তু সংসদের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পেয়েছে মারাত্মকভাবে। সরকার বিরোধী দলকে সংসদে এসে প্রস্তাব দেওয়ার কথা বললেও সেখানে যেভাবে ব্যক্তি আক্রমণ চালানো হয় তাতে করে বিএনপি সংসদে যাবে না-এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা একটু সহনশীল হলে সমঝোতার একটি পথ উন্মুক্ত হতে পারে। রাজনীতিতে কিছু ‘কোড অব কনডাক্ট’ও থাকা উচিত। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নেতাদের ব্যক্তিপর্যায়ে আক্রমণ না করে তাদের রাজনীতির সমালোচান করাই মঙ্গল। এরই নাম গণতন্ত্র। এরই নাম গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। ব্যক্তি আক্রমণ, বিদ্বেষপ্রসূত মনোভাব, অসংলগ্ন কথাবার্তা বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকাশে আদৌ কোনো অবদান রাখবে না। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাকে আমরা গণতন্ত্র না বলে জনতাতন্ত্রই বলব। জনতাতন্ত্রে দলীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, যাতে সাধারণ জনগণের মঙ্গল নিহিত থাকে না। বাংলাদেশ যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে করে হতাশ হওয়ার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। যে সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে দেশ ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে, তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় একটাই-আর তা হচ্ছে একটি সংলাপ। অতীতে সংলাপের অভিজ্ঞতা ভালো না থাকলেও সংলাপেই যেতে হবে বড় দল দুটোকে। আর সংলাপের মধ্য দিয়ে আগামীতে সমাধানের একটা পথ যে আমরা খুঁজে পাব না, তা বলা যাবে না। তাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
লেখক : প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
http://www.shokalerkhabor.com/online/details_news.php?id=69042&&+page_id=+67

0 comments:

Post a Comment