রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

যে সংবাদগুলো আমাদের আশাবাদী করে না

পঞ্চম দফা উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেসব সংবাদ ছাপা হয়েছে, তা আমাদের খুব আশাবাদী করে না। নির্বাচন বর্জন, নির্বাচনের আগেই ব্যালট পেপারে সিল, সিলমারা ব্যালট পেপার উদ্ধার, গুলিতে নিহত ২ জন, ভোটকেন্দ্র দখল, ভোটকেন্দ্রে সরকারবিরোধীদের ঢুকতে না দেওয়া ইত্যাদি সংবাদ তৃতীয় ও চতুর্থ দফা নির্বাচনেরই যেন ‘কার্বন কপি’। পঞ্চম দফা নির্বাচনেরও একটা ফলাফল পাওয়া গেছে। এর মধ্য দিয়ে পুরো ৫ দফা নির্বাচনের একটি ফলাফল পাওয়া গেল। প্রথম দফা চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল ৩৪টিতে আর বিএনপির ৪৫। জামায়াতের অবস্থান তৃতীয় ১২টি। দ্বিতীয় দফায়ও বিএনপি এগিয়ে থাকে ৫২টিতে, আওয়ামী লীগ ৪৬টিতে আর জামায়াত ৮টিতে। তৃতীয় দফা থেকেই বাড়তে থাকে সহিংসতা, বাড়তে থাকে আওয়ামী লীগের পাল্লা। আওয়ামী লীগ ৩৭ আর বিএনপি ২৬, জামায়াতের ৭। চতুর্থ দফায় আওয়ামী লীগের পাল্লা বেড়ে যায় দ্বিগুণ ৫৩টিতে আর বিএনপির ২৩। জামায়াত পেয়েছিল ৫। আর পঞ্চম দফায় একই প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের আসন ৫৩ আর বিএনপির ১২। জামায়াতের আসন ৩। দ্বিতীয় দফায় প্রাণহানি ঘটেছিল ১ জনের। তৃতীয় দফায় ৩ জনের আর চতুর্থ দফায় ৪ জনের। পঞ্চম দফায় এসে এ সংখ্যা ২ জন।প্রশ্ন হচ্ছে, এই নির্বাচন আমাদের কী দিল? বিগত বেশ কটি বছর আমরা ভোটকেন্দ্র দখল, সিলমারা সংস্কৃতি প্রত্যক্ষ করিনি। সেই পুরনো সংস্কৃতিতে এখন আমরা ফিরে এসেছি। মানুষ ভোট দিতে যাক আর নাই যাক, নির্বাচন হচ্ছে। ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে। গণতন্ত্রের এক নতুন রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করছি বাংলাদেশে! ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের যে ‘রূপ’ আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম, সেই রূপই আমরা প্রত্যক্ষ করলাম ৫ দফার উপজেলা নির্বাচনে। ভোটকেন্দ্র দখল, সরকারি প্রার্থীর পক্ষে সিল মেরে ব্যালটবাক্স ভর্তি করার যে সংস্কৃতিতে আমরা ফিরে এলাম, তা এ দেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে না।৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাই শুধু বাড়িয়ে দেয়নি, বরং গণতন্ত্র চর্চার নতুন একটি মাত্রার সুযোগ করে দিয়েছিল। কেননা গণতন্ত্রের ভিত্তি রচিত হয় তৃণমূল পর্যায়ে। তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্র যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে তা জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র চর্চাকে আরও শক্তিশালী করে। তাই যে-কোনও বিবেচনায় তৃণমূল পর্যায়ের এই নির্বাচনের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। কিন্তু ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ (বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি ও বামমনা দলগুলো) সত্ত্বেও উপজেলা নির্বাচন সুষ্ঠু হল না। ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও কর্মীদের আচরণ (জালভোট, ভোটকেন্দ্র দখল, সহিংসতা), প্রমাণ করল বাংলাদেশ গণতন্ত্রচর্চার নতুন এক ধাপে প্রবেশ করেছে। এখানে জনগণের অধিকার প্রয়োগটাই বড় কথা নয়। বরং যে-কোনও উপায়ে ক্ষমতাটা ধরে রাখাই হল আসল কথা।এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এটা আবারও প্রমাণিত হল, এ দেশে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। জাতীয় পর্যায় থেকে স্থানীয় পর্যায়ে এ দুদলের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। যদিও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনকে মেলানো যাবে না। তার পরও বাস্তবতা হচ্ছে— স্থানীয় পর্যায়ে এই দল দুটির গণভিত্তি আরও শক্তিশালী। আর এ গণভিত্তিই জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়। যেহেতু এই নির্বাচন প্রমাণ করেছে, বিএনপিকে বাদ দিয়ে কোনও নির্বাচন প্রক্রিয়া চিন্তা করা যাবে না, সেহেতু এ উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলকে ধারণ করে একাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে। উপজেলা নির্বাচন বিএনপি বয়কট করেনি। এর অর্থ পরিষ্কার। বিএনপি নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় থাকতে চায়। অর্থাত্ জাতীয় পর্যায়ের যে সংসদ নির্বাচন, সে ব্যাপারে বিএনপি একটি মেসেজ দিল যে, তারা এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারেও সিরিয়াস। এ নির্বাচন প্রমাণ করল স্থানীয় পর্যায়ে জামায়াতে ইসলামীরও একটা অবস্থান রয়েছে। জামায়াতের প্রার্থীরা একদিকে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে বিএনপি তথা অন্য দলের সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়েছে। সব ধরনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেও জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়কে এখন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। একই সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের ভরাডুবি প্রমাণ করল জাতীয় পার্টির সাম্প্রতিক ভূমিকায় স্থানীয় পর্যায়ের ভোটাররা অসন্তুষ্ট। এটা জাতীয় পার্টির জন্য একটি মেসেজও বটে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় একটি শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টি বিকশিত হয়েছিল। ১৯৯১ সালের পর থেকে ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের ফলাফল যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে এ সত্যটাই প্রমাণ করবে যে, জাতীয় পার্টি বাংলাদেশে তৃতীয় পার্টি। যদিও এর প্রায় পুরোটারই কৃতিত্ব ব্যক্তি এরশাদের। বাহ্যত বৃহত্তর উত্তরবঙ্গকেন্দ্রিক এ দলটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্যক্তি এরশাদের কারণে। এর বাইরে অন্তত জাতীয় পার্টি কিছুটা হলেও তার প্রভাব বাড়িয়েছিল, এটা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যা ঘটল, তা পার্টির জন্য কোনও ‘শুভ’ সংবাদ বয়ে আনেনি। একদিকে সরকারে থাকা, আবার বিরোধী দলেও থাকা, এই যে ‘রাজনীতি’, এই রাজনীতি মানুষ গ্রহণ করেনি।উপজেলা নির্বাচন এর বড় প্রমাণ। উপজেলা নির্বাচনেও সহিংস ঘটনা ঘটেছে। তবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এত ব্যাপকতা ছিল না। এখানে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা ছিল চোখে লাগার মতো। নির্বাচন কমিশন সহিংসতা রোধের ব্যাপারে কোনও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যেসব জায়গায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় সহিংসতা হয়েছে, সেসব জায়গায়ই উপজেলা নির্বাচনের সময় সহিংসতা বেশি হয়েছে। সুতরাং নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল নির্বাচনের আগে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তা তারা করেনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ব্লেমগেম’ অর্থাত্ পরস্পরকে দোষারোপ করার যে ‘রাজনীতি’ তা উপজেলা নির্বাচনেও প্রতিফলিত হয়েছে। ৫ দফা নির্বাচনের পর-পরই বিএনপির মুখপাত্র বিভিন্ন কেন্দ্রে জালভোট দেওয়া, কেন্দ্রদখল ইত্যাদি ঘটনার জন্য সরকারি দল তথা প্রশাসনযন্ত্রকে দায়ী করেছেন। ঠিক তেমনি প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টাও অভিযোগ করেছিলেন, ‘বিএনপি মিথ্যা কথার জাল বুনছে।’ বিএনপির অভিযোগের পেছনে সত্যতা যে নেই, তা কিন্তু বলা যাবে না। এর আগে ২০ ফেব্রুয়ারি একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় একটি ছবি ছাপা হয়েছিল। তাতে দেখা গেছে, নির্বাচনের দায়িত্বে নিযুক্ত একজন কর্মকর্তা ব্যালট পেপারে সিল মারছেন। এর কোনও ব্যাখ্যা নির্বাচন কমিশন থেকে দেওয়া হয়নি। একই ধরনের ছবি ছাপা হয়েছিল ১৬ মার্চের পত্রিকায়। সংবাদপত্রের ভাষায়— ‘উনি পোলিং ভোটার’ (আমাদের সময়)। যুগান্তরের প্রথম পাতায় আছে ছবি— ছিনতাইয়ের পর পরিত্যক্ত ব্যালট পেপার কুড়াচ্ছে আনসার সদস্যরা। শেরেবাংলা নগরের নির্বাচন কমিশনের কর্তাব্যক্তিদের কাছে এসব ছবির গুরুত্ব কত আমি জানি না। কিন্তু আমাকে যা শঙ্কায় ফেলে দেয়, তা হচ্ছে আমরা কী সামনের দিকে এগোচ্ছি? নাকি পেছনের দিকে হাঁটছি? ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচন, সবাই মিলে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়া, তত্কালীন বিরোধী আওয়ামী লীগের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন— সবই ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। এবং ২০০৯ সালের নির্বাচন পর্যন্ত আমরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করতে পেরেছিলাম। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনী আমাদের সব অর্জনকে পেছনে ফেলে দিল।এই নির্বাচন আমাদের অনেকগুলো মেসেজ দিয়ে গেল। এক. সরকার উপজেলা নির্বাচন যেন হাতছাড়া হয়ে না যায়, সে চেষ্টাই করেছে। নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থীদের ব্যাপক অনিয়ম প্রমাণ করল সরকার এই নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ হতে চাইছে; দুই. শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন না থাকলে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তা উপজেলা নির্বাচনে আরও একবার প্রমাণিত হল; তিন. ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিভিন্ন বক্তব্য প্রমাণ করে, তিনি সরকারের প্রভাব বলয়ের বাইরে নন; চার. দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তা আবারও প্রমাণিত হল। বলা ভালো— ১৯৮২ সালে এরশাদীয় জমানায় দেশে উপজেলা অধ্যাদেশবলে এই উপজেলা পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। এরশাদের আমলে দুবার উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। একবার ১৯৮৫ সালে আর দ্বিতীয়বার ১৯৯০ সালে। ১৯৯১ সালে বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করার দীর্ঘদিন পর, এমনকী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকারের সময়ও (১৯৯৬-২০০১) উপজেলা নির্বাচন আর অনুষ্ঠিত হয়নি। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (ডিসেম্বর) এক মাসের মাথায় শেষবারের মতো উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, যে প্রত্যাশা নিয়ে উপজেলা আইন সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। নানা কারণে ওই উপজেলা পরিষদ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। একটা প্রধান সমস্যা ছিল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্যের দ্বন্দ্ব। দুজনই জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়ায়, কার ক্ষমতা কতটুকু, এই দ্বন্দ্ব রয়ে গিয়েছিল। ফলে সত্যিকার অর্থে উপজেলা পরিষদ কোনও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। আইনে নির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান থাকলেও বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেছে তার ক্ষমতা নির্ধারিত নেই এবং তিনি নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছেন না। ফলে কাগজ-কলমে উপজেলা পরিষদ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য একটা ভিত্তি হলেও এই সংস্কৃতি বিকশিত হয়নি। উপজেলা থেকে নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। এবং ভবিষ্যতেও হবে কি না— সে প্রশ্নও রয়ে গেল। কেননা উপজেলা চেয়ারম্যানদের সরকারি অর্থে পাজেরো গাড়ি কিনে দেওয়া এবং মাসে মাসে জ্বালানি ও বেতন-ভাতা দিয়ে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির যে ভিত্তি তা গড়ে তোলা যায়নি। নতুন করে এই সত্যটাই আবার প্রমাণিত হল। উপজেলা নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে বৈরিতা, সরকারি দলের প্রার্থীদের নগ্ন সহিংসতা আমাদের অতীতের সব অর্জনকে নষ্ট করে দিল। আমরা কিছু ব্যক্তিকে শুধু সরকারি পাজেরো গাড়ি ব্যবহার করার সুযোগ করে দিলাম মাত্র। Daily Ajker Kagoz 02.04.14

0 comments:

Post a Comment