গল্পটা 'আম্মা', 'দিদি' আর 'বহেনজি'র। এ তিন মহিলা এখন ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম নির্ধারক। ভারতে ষোড়শ লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে। শেষ হবে ১২ মে। আর ১৬ মে জানা যাবে কে হতে যাচ্ছেন দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। রাজনীতির মারপ্যাঁচে এ তিন মহিলার একজন যদি প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান, তখন অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কেননা এনডিএ 'ম্যাজিক ফিগার' ২৭২টি আসন পাবে, তা জনমত জরিপে প্রমাণিত হয়নি। তবে বিজেপি যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হবে, তা মোটামুটি স্পষ্ট হয়েছে জনমত জরিপে। অন্যদিকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হতে যাওয়া কংগ্রেস এখন এক কূটচাল চালছে। শুরু হয়েছে 'মোদি খেদাও অভিযান'। তাই দৃষ্টি এখন এ তিন মহিলার দিকে। মমতা ব্যানার্জিকে প্রধানমন্ত্রী করতেও আপত্তি নেই কংগ্রেসের। তবে বিষয়টি অত সহজ নয়। আঞ্চলিক দলগুলো একটা ফ্যাক্টর হয়ে যেতে পারে। এসব ছোট ছোট দলের সমন্বয় করেও মোদি সরকার গঠন করতে পারেন। আঞ্চলিক রাজনীতিতে সমাজবাদী পার্টি, কাজেম সমাজবাদী পার্টি, জনতা দল, তৃণমূল কংগ্রেস, ডিএমকে, সিজু জনতা দল, তেলেগু দেশম, রাষ্ট্রীয় লোকদল, আকালি দল কোথাও কোথাও বেশ শক্তিশালী। সর্বশেষ ১৫তম সংসদে এদের আসনসংখ্যা ৪ থেকে ২২-এর মধ্যে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলোর মধ্যে শিবসেনা, ডিএমডিকে, এসডিএমকে, লোক জনশক্তি, আকালি দল আবার এনডিএ জোটভুক্ত। এদের সমন্বয়ে যদি ২৭২ আসনের সমর্থন নিশ্চিত না হয়, তাহলে অন্য ছোট দলগুলোর দিকে তাকাবে বিজেপি। আর কংগ্রেসের চেষ্টা হবে তাদের বিরত রাখা। দুটো বড় জোট, একদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ, অন্যদিকে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ_ এ দুই জোটের বাইরে বাম মনারা তৃতীয় জোটের সৃষ্টি করলেও তা আদৌ কোনো আবেদন রাখতে পারেনি। তৃতীয় জোটের পক্ষে ক্ষমতার আশপাশে থাকারও কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে এ তিন মহিলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। এদের একটি অলিখিত জোটও রয়েছে।
সাধারণত জরিপ সত্য বলেই প্রমাণিত হয়। কিন্তু একটা বিষয় এখন স্পষ্ট_ বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের জনসমর্থন বেড়েছে। এর পেছনে কি হিন্দুত্ববাদ, ব্যক্তি মোদির অর্থনীতিবিষয়ক কর্মকা- নাকি ইউপিএ সরকারের আমলে ব্যাপক দুর্নীতি কাজ করছে, তা এ মুহূর্তে স্পষ্ট নয়। এ নিয়ে ভারতীয় পত্রপত্রিকায় নানা বিশ্লেষণধর্মী মতামত প্রতিদিনই ছাপা হচ্ছে। তবে কংগ্রেস যে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে, এটা নিয়ে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই।
এখন নির্বাচন ঘিরে অনেক 'কিন্তু' এবং 'যদি'র জন্ম হয়েছে। বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ যদি 'ম্যাজিক ফিগার' ২৭২টি আসন পায় (মোট আসন ৫৪৩), তাহলে এ জোট এককভাবেই সরকার গঠন করবে। এ ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি হতে যাচ্ছেন ভারতের ১৫তম প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু যদি এনডিএ এর চেয়ে কম আসন পায়, তখন? এখানে অনেক সম্ভাবনা আছে। এক. নরেন্দ্র মোদি মমতা ব্যানার্জির সহযোগিতা চাইতে পারেন। কেননা লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের আসন সংখ্যা ৪২। এ ক্ষেত্রে জনমত জরিপ অনুযায়ী তৃণমূল কংগ্রেস ২৮টি আসন পেতে পারে। সরকার গঠনের জন্য মমতা ব্যানার্জি তখন একটি ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন। নির্বাচনী প্রচারণায় মমতা একদিকে কংগ্রেসকে যেমনি সমালোচনা করেছেন, তেমনি বিজেপিরও সমালোচনা করেছেন। কয়েকটি আঞ্চলিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে অলিখিত চতুর্থ জোট 'ফেডারেলিস্ট ফ্রন্ট'। অতীতে মমতা বিজেপির সঙ্গেই ছিলেন। আবার বিজেপি সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে আলাদা অবস্থান নিয়েছিলেন। পরে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ থেকেও মন্ত্রী হয়েছিলেন। সেখান থেকেও পদত্যাগ করেন। এই হচ্ছেন মমতা। যেখানে স্বার্থ বেশি, সেখানে তিনি থাকেন। ফলে পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিনিময়ে তিনি এনডিএ-তে যোগ না দিয়েও মোদিকে সরকার গঠনে সাহায্য করতে পারেন। তাই ভারতের রাজনীতিতে এ মুহূর্তে তিন মহিলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। 'আম্মা' (জয়ললিতা), 'বহেনজি' (মায়াবতী), 'দিদি' (মমতা ব্যানার্জি)। জনমত সমীক্ষায় দেখা গেছে, তৃণমূলের পাশাপাশি এডিএমকে পেতে পারে ২১ আর পিএসপি ১৮ আসন। এর বাইরে আছে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের দল বিজেডি। তারা ১৭ আসন পেতে পারে। ফলে সরকার গঠনে এসব আঞ্চলিক দল একটি ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে। এ ক্ষেত্রে মোদিকে ঠেকাতে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ এ তিন মহিলার একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমর্থন করতে পারে। তবে বিষয়টা খুব সহজ নয়। মমতা, মায়াবতী কিংবা জয়ললিতার (তিনজনই অবিবাহিত) মধ্য থেকে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা একটা সমস্যা তৈরি করতে পারে।
একটি 'ঝুলন্ত পার্লামেন্ট'-এর জন্ম হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। ১৯৯৬ সালের বাজপেয়ির (বিজেপি) ১৩ দিনের (১১তম সংসদ) প্রধানমন্ত্রিত্বের কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। কিংবা ১৯৯৭ সালে জনতা দলের দেবগৌড়া সরকার (১১তম সংসদ, ৩২৮ দিন), আই কে গুজরালের (১৯৯৮) ৩৩২ দিনের সরকারকে কংগ্রেস সমর্থন করেছিল। আমরা আরো একটু পেছনের দিকে যেতে পারি। মোরারজি দেশাই (১৯৭৭) তার টার্ম পূরণ করতে পারেননি। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ২ বছর ১২৬ দিন (ষষ্ঠ সংসদ)। চরণ সিং ক্ষমতায় ছিলেন (১৯৭৯) মাত্র ১৭০ দিন (ষষ্ঠ সংসদ)। সেই ইতিহাসেরই কি পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে এবার? তবে জনমত জরিপ এটা স্পষ্ট করেছে যে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএর ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সমসাময়িক ভারতীয় রাজনীতির জন্য এটা হবে একটা বড় চমক। আরো দুঃখজনক হচ্ছে, রাহুল গান্ধী যে প্রত্যাশা নিয়ে এসেছিলেন, সে প্রত্যাশা তিনি পূরণ করতে পারেননি। যেখানে জনমতে দেখা গেছে মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান ৫৪ শতাংশ মানুষ, সেখানে রাহুল গান্ধীকে চান মাত্র ১৮ ভাগ মানুষ। নেহেরু পরিবারের প্রতি এটা একটা অসম্মান। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নয় বছর ৩১৫ দিনের ইউপিএ সরকারের বিদায় অনিবার্য হয়ে উঠছে। বিগত ১৪ ও ১৫ তম সংসদে কংগ্রেস বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। মনমোহন সিং এর আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকবেন না। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, রাহুল হচ্ছেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। এখন দেখা গেল মনমোহন সিংয়ের এ আশা অধরাই থেকে যাবে। সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস বিজয়ী হয়েছিল ২০১টি আসনে, আর বিজেপি ১১২টিতে। এর বাইরে সমাজবাদী পার্টি (মুলায়ম সিং যাদব) ২২, বহুজন সমাজবাদী ২১, জনতা দল ১৯, তৃণমূল ১৮, ডিএমকে ১৬, সিপিএম ১৬, সিজু জনতা দল ১৪, শিবসেনা ১০, ওআইএডিএমকে ৯, জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস ৮, তেলেগু দেশম ৬টি আসন পেয়েছিল। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোটে (ইউপিএ) রয়েছে ডিএমকে, জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস, জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর ন্যাশনাল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ। এ জোটের জন্ম হয়েছিল ২০০৪ সালে। অন্যদিকে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ-তে রয়েছে (জন্ম ১৯৯৮) শিবসেনা, ডিএমডিকে, এমডিএমকে, লোক জনশক্তি, আকালি দল প্রভৃতি।
মায়াবতী দলিতদের পুঁজি করে উত্তরপ্রদেশে বিশাল এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। নিজে দলিত, অর্থাৎ নিম্নবর্ণের মানুষ হলেও মাস্টার্স ডিগ্রিধারী এবং কোনো দিন সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করেননি। রাজনীতি করে বিশাল এক আর্থিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। মমতা আর সাবেক অভিনেত্রী জয়ললিতাও এ থেকে পৃথক নন। এদের মধ্যে আবার অদ্ভুত এক মিলও রয়েছে। এরা সবাই চিরকুমারী। এ তিনজন মহিলা তিনটি রাজ্যের বর্তমান ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং সেখানকার সাধারণ মানুষকে পুঁজি করে রাজনীতি করলেও তারা স্ব স্ব রাজ্যের বৈষম্য, নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করতে পারেননি।
মায়াবতীর উত্তরপ্রদেশের কথাই বলা যেতে পারে। এ রাজ্যের বুন্দেলখ- গ্রামের গুলাব গ্যাংয়ের কথা বাংলাদেশের মানুষ পত্রপত্রিকা পড়ে জেনেছেন এতদিনে। অন্যায়ের প্রতিবাদে, নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে সাধারণ এক নারী সম্পাত পাল দেবী সংগঠিত করেছিলেন গ্রামের নারীদের। গোলাপি শাড়ি সবাই পরতেন যার কারণে এ বাহিনীর নামকরণ হলো গুলাব গ্যাং। লাঠি হাতে তাদের মিছিলের ছবি ও তাদের ওপর এক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল লন্ডনের গার্ডিয়ানে। সম্প্রতি গুলাব গ্যাংয়ের কাহিনী নিয়ে মুম্বাইয়ে একটি ছবিও হয়েছে। মাধুরী দীক্ষিত অভিনয় করেছেন সম্পাত পাল দেবীর ভূমিকায়। এটা একটা বাস্তব কাহিনী। মায়াবতীরা সাধারণ নারীদের বিরুদ্ধে অন্যায়কে পুঁজি করেই বহুজন সমাজবাদী পার্টিকে সংগঠিত করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। এখন অবশ্য তিনি আর মুখ্যমন্ত্রী নন। কিন্তু তিনি নিজে দলিত হয়েও দলিতদের নূ্যনতম অধিকার নিশ্চিত করতে পারেননি। ভারতের গণতন্ত্রের এটাই বড় সমস্যা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষে মানুষে বৈষম্য অনেক বেশি। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেনের ধারণা এখানে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তার নিজ দেশেই তার তত্ত্ব খাটেনি (যে দেশে গণতন্ত্র রয়েছে, সে দেশে দারিদ্র্য নেই!)। একটা পরিসংখ্যান দিই। ২০০৪ সালে ভারতে ৪১ কোটি লোক দরিদ্র ছিল, জনসংখ্যার মোট ২৭ দশমিক ৫ ভাগ। আর ২০১০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭ দশমিক ০২ ভাগ। যারা জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত প্রতিদিন ১ দশমিক ২৫ ডলার আয় করেন, সেই হিসাবে দরিদ্রের এ সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিদিন ৫ হাজার শিশু ক্ষুধা ও অপুষ্টির শিকার হয়ে মারা যায়। প্রায় ১৯ লাখ শিশু পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যায় (প্রতি বছর)। বিশ্বের দরিদ্রতম মানুষের ৩ ভাগের ২ ভাগ বাস করে ভারতে। ভারতের 'গণতন্ত্র' এ দারিদ্র্য দূর করতে পারেনি। এখনো নারীরা সেখানে নিরাপদ নন, ধর্ষিত হন প্রকাশ্যেই। ভারতের গণতন্ত্রের এটা একটা কালো দিক। ৭ এপ্রিল ছিল ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দিন।
পর্যায়ক্রমে মোট নয় দফায় এ নির্বাচন শেষ হবে। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মায়াবতীরা আরো ক্ষমতাবান হবেন। নয়া দিলি্লতে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হবে। তাতে করে 'গুলাব গ্যাং'-দের খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। রাষ্ট্র নারীদের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। স্পষ্টতই একটি বড় পরিবর্তন আসছে ভারতীয় রাজনীতিতে। কংগ্রেসের ভরাডুবি হতে যাচ্ছে। ১৬ মে আমরা জানতে পারব কে হতে যাচ্ছেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।Daily JAI JAI DIN10.04.14
0 comments:
Post a Comment