রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সংলাপ এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

গত ২২ এপ্রিল ঢাকায় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় নিরাপত্তা সংলাপ শুরু হয়েছে। এই সংলাপে আঞ্চলিক কৌশলগত সম্পর্ক, সামরিক সহযোগিতা, বৈশ্বিক নিরাপত্তা, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম, সন্ত্রাসবাদ দমন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হয়। যে সময় এই নিরাপত্তা সংলাপটি অনুষ্ঠিত হলো, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ভারতে নির্বাচন হচ্ছে। মে মাসের শেষদিকে সেখানে একটি নয়া সরকার গঠিত হবে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতায় পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা বেশি। যদি বিজেপির নেতৃত্বাধীন একটি জোট ক্ষমতায় আসে, তাহলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয় কিংবা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ব্যাপারে ভারতের মনোভাবের পরিবর্তন হয় কিনা, এটা জানা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য জরুরি। দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানে হামিদ কারজাইয়ের যুগ শেষ হতে চলেছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে কারজাই আর তৃতীয় বারের মতো প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হতে পারেননি। সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচন দ্বিতীয় পর্যায়ে গড়িয়েছে। সুতরাং যিনি আগামীতে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব বহন করুন না কেন, তার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, এ বিষয়টাও জরুরি। কেননা, এ বছরের শেষ নাগাদ আফগানিস্তান থেকে সব বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। কিন্তু তারপরও কিছু মার্কিন সৈন্য সেখানে থাকার কথা। নয়া আফগান প্রেসিডেন্ট বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন, সেই বিষয়টিও জরুরি। উপরন্তু রয়েছে ভারত মহাসাগর এলাকায় মার্কিন নৌবাহিনীর সম্প্রসারিত ভূমিকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলেও দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরের ব্যাপারে নতুন করে তাদের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। তাদের আগ্রহের মূল কেন্দ্রবিন্দু এখন মিয়ানমার, যেখানে রয়েছে প্রচুর জ্বালানি সম্পদ; এবং বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা। এই স্ট্র্যাটেজির আলোকে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের সঙ্গেও একটি কৌশলগত সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। সুতরাং আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারই শেষ কথা নয়। বরং নতুন আঙ্গিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আমরা প্রত্যক্ষ করব এ অঞ্চলে। পাকিস্তানে একটি নয়া সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরও মার্কিন ড্রোন বিমান হামলা বন্ধ হয়নি। আগামীতে আফগানিস্তানে একজন মার্কিন সৈন্য না থাকলেও ড্রোন বিমান হামলা বন্ধ হবে না। এ অঞ্চলের কোনো একটি জায়গায় মার্কিন ঘাঁটি বসবে, যেখান থেকে ড্রোন হামলা পরিচালিত হবে। যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরে তাদের যুদ্ধজাহাজ বাড়ানোর সিদ্ধান্তই শুধু নেয়নি, বরং চলতি সালের মাঝামাঝি সময়ে একটি নৌ মহড়ার আয়োজন করছে, যাতে ভারতের নৌবাহিনী অংশ নিতে পারে। মালদ্বীপের সঙ্গেও একটি ঝঙঋঅ চুক্তি করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। ন্যাটো ২০১০ সালে তার লিসবন সম্মেলনে ন্যাটোর সম্প্রসারিত ভূমিকা সম্পর্কে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ন্যাটোর ঝঃৎধঃবমরপ ঈড়হপবঢ়ঃ সম্পর্কে যারা ধারণা রাখেন, তারা জানেন, এই ধারণাপত্রের মূল বিষয়টি হচ্ছে ন্যাটোর সম্প্রসারিত ভূমিকা। ন্যাটোর কর্মকা- এখন আর শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা দক্ষিণ এশিয়ায় সম্প্রসারিত হয়েছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র তার নৌবাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কর্মকা- ভারত মহাসাগর এলাকায় সম্প্রসারিত করেছে। আগামীতে মার্কিন ষষ্ঠ ফ্লিটের বেশ কয়েকটি জাহাজ দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্রসীমায় মোতায়েন করা হবে। এ কারণে বাংলাদেশে সম্ভাব্য মার্কিনি ভূমিকা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে গেল। অনেকেরই জানার কথা, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইতোমধ্যে একটি অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই তথাকথিত 'অংশীদারিত্ব সংলাপ' চুক্তির আওতায় দৃশ্যত বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদ দমন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ, শ্রমমান, পণ্যের শুল্ক ইত্যাদি বিষয়ে মতবিনিময় করলেও মূল বিষয় একটাই_ যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত নীতির ব্যাপারে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করা। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় যৌথ কর্মসূচি গ্রহণের আড়ালে এ অঞ্চলে আগামীতে মার্কিন সেনা মোতায়েনের বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। বলা ভালো, প্রতি বছর একবার 'অংশিদারিত্ব সংলাপ চুক্তি'র আওতায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র মিলিত হবে। প্রথম সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকায় ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে। আর দ্বিতীয় পরবর্তী সংলাপ হয় ওয়াশিংটনে ২০১৩ সালের ৩ এপ্রিল। সংলাপ শেষে একটি ব্রিফিং করা হয় বটে, কিন্তু ভেতরের অনেক কথাই জানানো হয় না। বাংলাদেশ এর আগে ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। তাই গুজবের ডালপালা বেড়েছে এবং আগামীতে তা আরো ছড়াবে। ২০১২ সালের ১৮ জুন ইউরোপের দেশ ক্রোয়েশিয়ায় একটি ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ন্যাটোর ২৫টি সদস্য দেশের বাইরেও মোট ৫৫টি দেশ অংশ নিয়েছিল। ওই সম্মেলনকে তারা বলছে ঝঃৎধঃবমরপ গরষরঃধৎু চধৎঃহবৎংযরঢ় ঈড়হভবৎবহপব। যারা সরাসরি ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র নয়, তারাও এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল। ন্যাটোর সঙ্গে কাজ করতে পারে, এমন দেশগুলোকে ন্যাটোর নীতিনির্ধারকরা মোট ৪ ভাগে ভাগ করেছেন_ যারা ন্যাটোর সদস্য নয়, তবে ন্যাটোর সহযোগী। যেমন, ইউরোপের ১২টি দেশ নিয়ে গঠিত হয়েছে ঞযব চধৎঃহবৎংযরঢ় ভড়ৎ চবধপব। ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত আলজেরিয়া-তিউনিসিয়ার মতো দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত হয়েছে গবফরঃবৎৎরধহ উরধষড়মঁব গবসনবৎং। সৌদি আরব কিংবা ওমানের মতো দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত হয়েছে ওংঃধহনঁষ ঈড়-ড়ঢ়বৎধঃরড়হ ওহরঃরধঃরাব। অস্ট্রেলিয়া কিংবা জাপানের মতো দেশগুলোকেও ন্যাটো 'চধৎঃহবৎং অপপৎড়ংং ঃযব এষড়নব'-এর ব্যানারে একত্রিত করেছে। আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানও এই ব্যানারে রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে ন্যাটোর কোনো কর্মকা- নেই। এখন এল সালভাদর এবং কলম্বিয়ার মতো দেশও ন্যাটোর সঙ্গে জড়িত হতে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার, ইউরোপে ন্যাটোর কমান্ডার অ্যাডমিরাল স্টাভরিভিস গেল বছর বলেছিলেন, তারা ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশকে নিয়ে ভাবছেন; এবং আশা করছেন, এই দেশ দুটি চধৎঃহবৎং অপপড়ৎংং ঃযব এষড়নব-এর ব্যানারে আগামীতে ন্যাটোর কর্মকা-ে শরিক হবে। ২০১০ সালে ন্যাটো লিসবন সম্মেলনে ন্যাটোর ঝঃৎধঃবমরপ ঈড়হপবঢ়ঃ গ্রহণ করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রোয়েশিয়ান সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এর মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়ে গেল, একুশ শতকে ন্যাটো নতুন এক কৌশলগত ধারণা নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। ন্যাটোর ওই ভূমিকা, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক শিক্ষকের মতো কর্তৃত্ব করার প্রবণতা নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে প্রভাববলয়কে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের। আর ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে সেই স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটেছিল। আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ওয়ারশ সামরিক জোট ভেঙে দেয়া হয়নি। বরং এর সম্প্রসারণ ঘটেছিল। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে ন্যাটো এবং ওয়ারশ জোটের মধ্যে সামরিক প্রতিযোগিতা এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছিল যে, ইউরোপে একাধিকবার 'পারমাণবিক যুদ্ধ'-এর সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই 'যুদ্ধ' হয়নি বটে, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর পুরোটা সময় এই দুই শক্তির মাঝে প্রতিযোগিতা বজায় ছিল। দুই পরাশক্তিই ইউরোপে পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরই এই স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে। এর প্রধান কারণ ছিল একটি_ রাশিয়া এখন আর ইউরোপের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি নয়। দুটি আদর্শের (সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদ) মাঝে যে দ্বন্দ্ব ছিল, সেই দ্বন্দ্বেরও অবসান ঘটে, যখন রাশিয়া আদর্শ হিসেবে মুক্তবাজার ও পুঁজিবাদকে গ্রহণ করে। উপরন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার অনেক আগেই ১৯৮৮ সালে গরবাচেভ 'ওয়ারশ' সামরিক জোট ভেঙে দিয়েছিলেন। এ কারণে ইউরোপে রাশিয়ার উত্থান যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি নয়। আর তাই নতুন করে এ অঞ্চলে স্নায়ুযুদ্ধ সৃষ্টির সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এখন ভারত মহাসাগর হচ্ছে সম্ভাব্য ক্ষেত্র, যেখানে নতুন করে স্নাযুযুদ্ধের জন্ম হতে যাচ্ছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে চীন। চীনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভয় ও শঙ্কা এখন অনেক বেশি। প্রথমত, তত্ত্বগতভাবে চীন এখন আর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। কিন্তু একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীন এখন বিশ্বকে কর্তৃত্ব করছে। চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হওয়ায় তা এখন মার্কিন স্বার্থকে আঘাত করছে। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে নিজের অভ্যন্তরীণ বাজারকে সচল রাখছে। এটা মার্কিন নীতিনির্ধারকদের অনেকেরই অপছন্দের। গত ৮ জুন (২০১৩) নয়া চীনা প্রেসিডেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। এই সফরে ওবামার সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক হয়েছে। কিন্তু তারপরও বেশ কিছু ইস্যুতে বিরোধ রয়েছে। তৃতীয়ত, দক্ষিণ এশিয়া তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়ছে। এটা মার্কিনিদের চিন্তার কারণ। বিশেষ করে ভারত মহাসাগর ও আফগানিস্তানের ব্যাপারে তাদের আশঙ্কার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য এবং সেই সঙ্গে সব বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে না। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। এ কারণেই তথাকথিত 'অংশীদারিত্ব চুক্তি' করছে যুক্তরাষ্ট্র; এবং ন্যাটোকে ব্যবহার করে এ অঞ্চলে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। আর ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম এক ধরনের কর্মসূচি, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার উপস্থিতিকে নিশ্চিত করতে চায়। তাই যুক্তিসঙ্গত কারণেই ভারতকে প্রয়োজন রয়েছে ওবামা প্রশাসনের। স্মরণ করা প্রয়োজন, জাতিসংঘের সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলনে (২০১৩) যোগ দেয়া যে কয়জন সরকারপ্রধানকে ওবামা হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ভারত। গত ২৭ সেপ্টেম্বর মনমোহন সিং হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। ভুলে গেলে চলবে না, যুক্তরাষ্ট্রকে তার স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে হলে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন। ভারত উঠতি শক্তি। সামরিক তো বটেই, অর্থনৈতিক শক্তিও বটে। মার্কিন স্বার্থ বিঘি্নত হবে, যদি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র সেটা কখনোই চাইবে না। বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কখনো একক কোনো নীতি গ্রহণ করেনি। এ ব্যাপারে মার্কিনি নীতি ভারতীয় মনোভাব দ্বারা প্রভাবান্বিত। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটা মতভিন্নতা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র এখন অনেকটাই বর্তমান সরকারকে স্বীকার করে নিয়েছে। এ কারণে বর্তমান সংসদ নূ্যনতম দুই-তিন বছর থাকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে হঠাৎ করে জঙ্গিবাদের উত্থান, জেএমবি সদস্যদের পুলিশের হাত থেকে পলায়ন কিংবা আল-জাওয়াহিরির তথাকথিত অডিওবার্তা যে ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকদের এতটুকুও বিচলিত করবে না, তা বলা যায় না। এর ওপর গত ২ মার্চ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে তথাকথিত ৯টি জঙ্গি সংগঠন 'স্বাধীন বাংলাদেশ কমিটি' নামে একটি কমিটির ব্যানারে সংগঠিত হয়েছে। এই সংবাদটির ব্যাপারে সত্যতা যা-ই থাকুক না কেন, ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকরা সংবাদটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেবেন বলেই আমার ধারণা। সুতরাং পুরো ২০১৪ সালটি বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যে বেগম জিয়া ঘোষণা করেছেন, উপজেলা নির্বাচনের পরপরই তিনি আন্দোলনের কর্মসূচি দেবেন। ফলে রাজনীতি আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠলে বাংলাদেশের জঙ্গিরা এটা থেকে সুবিধা নিতে পারে। বিষয়টি বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদেরও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রতিটি 'ডেভেলপমেন্ট'-এর একটির সঙ্গে অপরটির একটি যোগসূত্র আছে। বাংলাদেশের জঙ্গিদের সঙ্গে আরব বিশ্বের ইসলামী জঙ্গিদের কতটুকু যোগসূত্রে আছে, তা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ভালো বলতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে এসব জঙ্গির যে একটা যোগাযোগ থাকতে পারে বা ভবিষ্যতে হতে পারে, তা আশঙ্কা করা যায়। সুতরাং মার্কিন সৈন্যদের আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারে যে 'শূন্যতার' সৃষ্টি হবে (ভ্যাকুয়াম থিওরি), তার সুযোগ নিতে পারে জঙ্গিরা। আর জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে রাখা, চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষাপটে ভারত মহাসাগরে যখন মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি বাড়বে, সঙ্গত কারণেই এর 'প্রতিবাদে' জঙ্গিদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এ ক্ষেত্রে এ অঞ্চলকে ঘিরে (বিশেষ করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার) নতুন এক 'সামরিক সমীকরণের' জন্ম হতে পারে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা এখন ব্যবহৃত হতে পারে মিয়ানমার সরকারের ওপর 'চাপ' প্রয়োগ করার স্বার্থে। তাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় নিরাপত্তা সংলাপের গুরুত্ব অনেক বেশি। Daily JAI JAI DIN 28.04.14

0 comments:

Post a Comment