ভারতে ষোড়শ লোকসভা নির্বাচন যতই সমাপ্তির দিকে যাচ্ছে, ততই একটা শঙ্কা তৈরি
হচ্ছে যে, 'মোদি ম্যাজিক' কি সেখানে কোনো পরিবর্তন ডেকে আনছে? এই নির্বাচন
ভারতে সরকার পরিবর্তনের একটা সম্ভাবনা তৈরি করলেও, পুনরায় ভারতকে কি একটি
সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দিকে টেনে নিয়ে আসছে? বিজেপির প্রধানমন্ত্রী
প্রার্থী নরেন্দ্র মোদি কিংবা শীর্ষস্থানীয় বিজেপি নেতৃবৃন্দের মন্তব্য এই
আশঙ্কা তৈরি করছে যে, ভারতে পুনরায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্ম হতে যাচ্ছে!
ভারতে গত ১০ বছরে কংগ্রেস তথা ইউপিএ জোটের শাসনামলে সেখানে কোনো
সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ছিল না। এখন বিজেপি ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা
মুসলমানবিদ্বেষী বক্তব্য দিচ্ছেন। সর্বশেষ ঘটনায় পরিষদের নেতা প্রবীণ
তোগাড়িয়ার বিরুদ্ধে এফআরআই দায়ের করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তোগাড়িয়া
হিন্দু এলাকায় মুসলমানদের সম্পত্তি ক্রয় না করার হুমকি দিয়েছিলেন। বিজেপি
নেতাদের বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্যও ছাপা হয়েছে পত্র-পত্রিকায়।
সুতরাং নরেন্দ্র মোদি যদি জনমত সমীক্ষাকে 'সত্য' প্রমাণ করে ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বটি গ্রহণ করেন, তাহলে আমাদের কতটুকু আশ্বস্ত তিনি করতে পারবেন, সেই প্রশ্ন থেকেই গেল। প্রথম কয়েক দফা নির্বাচনে 'মোদি ম্যাজিক' তেমন কোনো আবেদন রাখতে পারেনি। ৭ এপ্রিল আসাম ও ত্রিপুরার ৬ আসন দিয়ে নির্বাচন শুরু হয়েছে। তবে সেখানে কোনো 'মোদি ম্যাজিক' ছিল না। ধারণা করা হচ্ছে, আসামের লোকসভার ১৪টি আসনে কংগ্রেস ভালো করবে। অন্যদিকে ত্রিপুরার নির্বাচনেও কোনো 'মোদি ঢেউ' ছিল না। এখানে সিপিআই (এম)-এর অবস্থান ভালো। তারা ভালো করবে। বাবরি মসজিদ ইস্যু ও কাশ্মীরের বিষয়টি বিজেপির ইশতেহারে থাকায় তা ভারতের মুসলমানদের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট। বিজেপির ইশতেহার সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিতে পারে। সোনিয়া গান্ধী নিজে বলেছেন, বিজেপির সম্প্রদায়িক এজেন্ডা ভারতের একতা ও অখণ্ডতার জন্য মারাত্মক হুমকিসরূপ। ওরা ভারতকে ভাগ করে ফেলতে চায়।
পুনরায় রাম মন্দিরের ইস্যু তুলে বিজেপি মুসলমানদের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ভারতে ১৮ কোটি মুসলমানের বাস। এরা এখন থাকবেন অনিশ্চয়তায়। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর হিন্দু উগ্রবাদীরা ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। উগ্রবাদী হিন্দুরা সেখানে তাদের দেবতা রামের মন্দির নির্মাণ করতে চায়। বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতে দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন সহস্রাধিক ব্যক্তি। এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল সারা মুসলিম বিশ্বে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে এর প্রতিবাদে হরতাল হয়েছিল। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার বাবরি মসজিদ পুনর্নির্মাণের দাবি জানিয়ে এ ধরনের ঘটনাকে মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। ভারতব্যাপী এর যে প্রতিবাদ হয়েছিল, তাতে করে ভারত সরকার তখন আরএসএস, বজরং, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ইসলামী সেবক সংঘ ও জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তখন ভারতে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নরসীমা রাও। তিনি বাবরি মসজিদ রক্ষা করতে পারেননি। মথুরার ঈদগাহ মসজিদ নিয়েও হিন্দুরা আদালতে মামলা ঠুকেছিল। আজ বিজেপি পুনরায় রাম মন্দির নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এতদিন সেখানে যে স্থিতিশীলতা বজায় ছিল, তা একটি ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিল। কাশ্মীরের প্রসঙ্গ তুলে অযথাই বিজেপি বিতর্ক সৃষ্টি করল। অনেকে মনে করতে পারেন, ভারত সংযুক্তির সময় কাশ্মীরিদের একটি স্বতন্ত্র সত্তার মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু সে প্রস্তাব কখনোই কার্যকর করা হয়নি। ধীরে ধীরে সংবিধানের সেই ধারা (ধারা ৩৭০) সংশোধন করা হয়েছিল। এখন বিজেপি এ ধারাটিও তুলে দিতে চায়।
বিজেপির ইশতেহারে যেসব উগ্রবাদী কথাবার্তা বলা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের কাছে আপত্তি জানিয়েছে কংগ্রেস। কংগ্রেস অভিযোগে করেছে যে, বিজেপি ধর্মকে ব্যবহার করছে। তারা এটা বলেছে যে, বিজেপি ধর্মকে ব্যবহার করে ভোট চেয়েছে, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সাংবিধানিক চরিত্রের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপি নেতৃবৃন্দের 'হিন্দু কার্ড' ব্যবহার করা কিংবা বাংলাদেশবিরোধী দু-একটি বক্তব্যে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে অনেকে ভাবতে শুরু করেছেন। বিজেপি জোট যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে এই সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে ইতিমধ্যে। কেননা বেশ কিছু ইস্যুতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আটকে আছে।
তিস্তার পানি চুক্তি ও সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারে বিজেপির অবস্থান আমরা মোটামুটি জানি। চূড়ান্ত বিচারে নরেন্দ্র মোদিকে যদি মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে সরকার গঠনের প্রশ্নে কোনো কম্প্রোমাইজ করতে হয়, তাহলে মোদি মমতার সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবেন না। এতে করে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি চলে যাবে ডিপ ফ্রিজে। আন্তঃনদী সংযোগের কথাও তিনি বলেছেন। সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারেও বিজেপির প্রচণ্ড আপত্তি রয়েছে। বিজেপির বিরোধিতার কারণেই কংগ্রেস সরকারের সময় চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। চুক্তিটি ভারতীয় মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছিল। একটি বিল লোকসভায় উপস্থাপিতও হয়েছিল। কিন্তু বিজেপির আপত্তির কারণে এটা নিয়ে আর আলোচনা হয়নি। তখন বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে_ এটা আমার মনে হয় না। এর বাইরে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং ট্রানজিট প্রশ্নে দু'দেশের মধ্যে আস্থার যে ঘাটতি রয়েছে, সে ব্যাপারে নয়া সরকার কোনো উদ্যোগ নেবে বলে মনে হয় না। আমাদের পররাষ্ট্র সচিব গত মাসের শেষের দিকে নয়াদিলি্ল গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। নির্বাচনের আগে আমাদের পররাষ্ট্র সচিব যখন নয়াদিলি্ল যান, তখন বুঝতে হবে বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতি যাচাই করছে। স্পস্টতই তিনি কোনো সুখবর নিয়ে আসতে পারেননি। এটি মোটামুটিভাবে আমরা সবাই জানি, কংগ্রেসের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ বেশ কিছু চুক্তি করেছে। ভারত গত পাঁচ বছর বাংলাদেশের কাছ থেকে বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সে অর্থে তেমন সুবিধা পায়নি। এখন নয়াদিলি্লতে সম্ভাব্য মোদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের 'সম্পর্ক' কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায় সেটা দেখার বিষয়। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট করেই বলা যায়, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ভারতের নীতির পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে খবর বের হয়েছে যে, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালনে করিডোর পেতে যাচ্ছে ভারত। অরুণাচল থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুরের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ যাবে বিহারে। একই সঙ্গে চলতি বছরেই বহুল বিতর্কিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে ভারত। প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। সুতরাং সম্ভাব্য মোদি সরকার এসব প্রকল্প বাতিল করবে_ এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ তখন তার স্বার্থ আদায়ে কতটুকু উদ্যোগ নেয়, সেটাই দেখার বিষয়। তবে চূড়ান্ত বিচারে মোদি ক্ষমতা পেলেও, অনেক কিছুই তার পক্ষে করা সম্ভব হবে না। কেননা সরকার গঠন করতে হলে তাকে আঞ্চলিক দলগুলোর সহযোগিতা নিতে হবে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক দলগুলো এক ধরনের 'চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স' হিসেবে কাজ করবে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে অনেক কথা বলতে হয়। বিজেপিও বলেছে। ভারত একটি বিশ্বশক্তি হতে চলেছে। ২০৩০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অবস্থান হবে দ্বিতীয়। ভারত জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদের সদস্য হতে চায়। ভারতের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিশ্বের জন্যই একটি মডেল। সুতরাং নরেন্দ্র মোদি ইচ্ছা করলেও অনেক কিছু করতে পারবেন না। তাই পররাষ্ট্রনীতিতে, বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ব্যাপারে ভারতের মনোভাবের পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। নানা কারণে 'মোদি ম্যাজিক' ভারতব্যাপী একটি ঢেউ তুলেছে। এই ঢেউ শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদিকে নয়াদিলি্লর ৭নং রেসকোর্স রোডে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত বাসভবনে নিয়ে যায় কি-না, সেটাই দেখার বিষয় আমাদের।
সুতরাং নরেন্দ্র মোদি যদি জনমত সমীক্ষাকে 'সত্য' প্রমাণ করে ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বটি গ্রহণ করেন, তাহলে আমাদের কতটুকু আশ্বস্ত তিনি করতে পারবেন, সেই প্রশ্ন থেকেই গেল। প্রথম কয়েক দফা নির্বাচনে 'মোদি ম্যাজিক' তেমন কোনো আবেদন রাখতে পারেনি। ৭ এপ্রিল আসাম ও ত্রিপুরার ৬ আসন দিয়ে নির্বাচন শুরু হয়েছে। তবে সেখানে কোনো 'মোদি ম্যাজিক' ছিল না। ধারণা করা হচ্ছে, আসামের লোকসভার ১৪টি আসনে কংগ্রেস ভালো করবে। অন্যদিকে ত্রিপুরার নির্বাচনেও কোনো 'মোদি ঢেউ' ছিল না। এখানে সিপিআই (এম)-এর অবস্থান ভালো। তারা ভালো করবে। বাবরি মসজিদ ইস্যু ও কাশ্মীরের বিষয়টি বিজেপির ইশতেহারে থাকায় তা ভারতের মুসলমানদের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট। বিজেপির ইশতেহার সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিতে পারে। সোনিয়া গান্ধী নিজে বলেছেন, বিজেপির সম্প্রদায়িক এজেন্ডা ভারতের একতা ও অখণ্ডতার জন্য মারাত্মক হুমকিসরূপ। ওরা ভারতকে ভাগ করে ফেলতে চায়।
পুনরায় রাম মন্দিরের ইস্যু তুলে বিজেপি মুসলমানদের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ভারতে ১৮ কোটি মুসলমানের বাস। এরা এখন থাকবেন অনিশ্চয়তায়। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর হিন্দু উগ্রবাদীরা ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। উগ্রবাদী হিন্দুরা সেখানে তাদের দেবতা রামের মন্দির নির্মাণ করতে চায়। বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতে দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন সহস্রাধিক ব্যক্তি। এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল সারা মুসলিম বিশ্বে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে এর প্রতিবাদে হরতাল হয়েছিল। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার বাবরি মসজিদ পুনর্নির্মাণের দাবি জানিয়ে এ ধরনের ঘটনাকে মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। ভারতব্যাপী এর যে প্রতিবাদ হয়েছিল, তাতে করে ভারত সরকার তখন আরএসএস, বজরং, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ইসলামী সেবক সংঘ ও জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তখন ভারতে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নরসীমা রাও। তিনি বাবরি মসজিদ রক্ষা করতে পারেননি। মথুরার ঈদগাহ মসজিদ নিয়েও হিন্দুরা আদালতে মামলা ঠুকেছিল। আজ বিজেপি পুনরায় রাম মন্দির নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এতদিন সেখানে যে স্থিতিশীলতা বজায় ছিল, তা একটি ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিল। কাশ্মীরের প্রসঙ্গ তুলে অযথাই বিজেপি বিতর্ক সৃষ্টি করল। অনেকে মনে করতে পারেন, ভারত সংযুক্তির সময় কাশ্মীরিদের একটি স্বতন্ত্র সত্তার মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু সে প্রস্তাব কখনোই কার্যকর করা হয়নি। ধীরে ধীরে সংবিধানের সেই ধারা (ধারা ৩৭০) সংশোধন করা হয়েছিল। এখন বিজেপি এ ধারাটিও তুলে দিতে চায়।
বিজেপির ইশতেহারে যেসব উগ্রবাদী কথাবার্তা বলা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের কাছে আপত্তি জানিয়েছে কংগ্রেস। কংগ্রেস অভিযোগে করেছে যে, বিজেপি ধর্মকে ব্যবহার করছে। তারা এটা বলেছে যে, বিজেপি ধর্মকে ব্যবহার করে ভোট চেয়েছে, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সাংবিধানিক চরিত্রের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপি নেতৃবৃন্দের 'হিন্দু কার্ড' ব্যবহার করা কিংবা বাংলাদেশবিরোধী দু-একটি বক্তব্যে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে অনেকে ভাবতে শুরু করেছেন। বিজেপি জোট যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে এই সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে ইতিমধ্যে। কেননা বেশ কিছু ইস্যুতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আটকে আছে।
তিস্তার পানি চুক্তি ও সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারে বিজেপির অবস্থান আমরা মোটামুটি জানি। চূড়ান্ত বিচারে নরেন্দ্র মোদিকে যদি মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে সরকার গঠনের প্রশ্নে কোনো কম্প্রোমাইজ করতে হয়, তাহলে মোদি মমতার সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবেন না। এতে করে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি চলে যাবে ডিপ ফ্রিজে। আন্তঃনদী সংযোগের কথাও তিনি বলেছেন। সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারেও বিজেপির প্রচণ্ড আপত্তি রয়েছে। বিজেপির বিরোধিতার কারণেই কংগ্রেস সরকারের সময় চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। চুক্তিটি ভারতীয় মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছিল। একটি বিল লোকসভায় উপস্থাপিতও হয়েছিল। কিন্তু বিজেপির আপত্তির কারণে এটা নিয়ে আর আলোচনা হয়নি। তখন বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে_ এটা আমার মনে হয় না। এর বাইরে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং ট্রানজিট প্রশ্নে দু'দেশের মধ্যে আস্থার যে ঘাটতি রয়েছে, সে ব্যাপারে নয়া সরকার কোনো উদ্যোগ নেবে বলে মনে হয় না। আমাদের পররাষ্ট্র সচিব গত মাসের শেষের দিকে নয়াদিলি্ল গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। নির্বাচনের আগে আমাদের পররাষ্ট্র সচিব যখন নয়াদিলি্ল যান, তখন বুঝতে হবে বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতি যাচাই করছে। স্পস্টতই তিনি কোনো সুখবর নিয়ে আসতে পারেননি। এটি মোটামুটিভাবে আমরা সবাই জানি, কংগ্রেসের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ বেশ কিছু চুক্তি করেছে। ভারত গত পাঁচ বছর বাংলাদেশের কাছ থেকে বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সে অর্থে তেমন সুবিধা পায়নি। এখন নয়াদিলি্লতে সম্ভাব্য মোদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের 'সম্পর্ক' কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায় সেটা দেখার বিষয়। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট করেই বলা যায়, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ভারতের নীতির পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে খবর বের হয়েছে যে, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালনে করিডোর পেতে যাচ্ছে ভারত। অরুণাচল থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুরের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ যাবে বিহারে। একই সঙ্গে চলতি বছরেই বহুল বিতর্কিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে ভারত। প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। সুতরাং সম্ভাব্য মোদি সরকার এসব প্রকল্প বাতিল করবে_ এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ তখন তার স্বার্থ আদায়ে কতটুকু উদ্যোগ নেয়, সেটাই দেখার বিষয়। তবে চূড়ান্ত বিচারে মোদি ক্ষমতা পেলেও, অনেক কিছুই তার পক্ষে করা সম্ভব হবে না। কেননা সরকার গঠন করতে হলে তাকে আঞ্চলিক দলগুলোর সহযোগিতা নিতে হবে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক দলগুলো এক ধরনের 'চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স' হিসেবে কাজ করবে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে অনেক কথা বলতে হয়। বিজেপিও বলেছে। ভারত একটি বিশ্বশক্তি হতে চলেছে। ২০৩০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অবস্থান হবে দ্বিতীয়। ভারত জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদের সদস্য হতে চায়। ভারতের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিশ্বের জন্যই একটি মডেল। সুতরাং নরেন্দ্র মোদি ইচ্ছা করলেও অনেক কিছু করতে পারবেন না। তাই পররাষ্ট্রনীতিতে, বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ব্যাপারে ভারতের মনোভাবের পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। নানা কারণে 'মোদি ম্যাজিক' ভারতব্যাপী একটি ঢেউ তুলেছে। এই ঢেউ শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদিকে নয়াদিলি্লর ৭নং রেসকোর্স রোডে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত বাসভবনে নিয়ে যায় কি-না, সেটাই দেখার বিষয় আমাদের।
0 comments:
Post a Comment