ভারতে
লোকসভা নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে অনেক আগেই। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সাত
দফা নির্বাচন সম্পন্ন হবে। এরপর বাকি থাকবে ৭ ও ১২ মে। ৭ মে অনুষ্ঠিত হবে
সাত রাজ্যের ভোট, ৬৪ আসনে। আর সর্বশেষ ১২ মে তিন রাজ্যে, ৪১ আসনে। এরপর ১৬
মে জানা যাবে নয়াদিল্লির সাত নম্বর রেসকোর্স রোডে কে হতে যাচ্ছেন পরবর্তী
বাসিন্দা। প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত এই বাসভবনটিতে শেষ পর্যন্ত
একসময়ের রেলওয়ে স্টেশনগুলোতে চা বিক্রেতা নরেন্দ্র মোদিই বাসিন্দা হবেন কি
না, সে ব্যাপারটিও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। তবে ভারতের ষোড়শ লোকসভা নির্বাচন
নানা কারণে এবার আলোচিত হয়েছে। প্রথমত, এত বিপুলসংখ্যক ভোটার নিয়ে পৃথিবীর
কোথাও কোনো নির্বাচন হয় না। প্রায় ৮২ কোটি ভোটার। এর মধ্যে আবার নয়া
ভোটারের সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি। মহিলা ভোটারের সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে বেশি।
দ্বিতীয়ত, ফিল্মের নায়ক-নায়িকাদের উপস্থিতি এর আগে আর তেমনটি দেখা যায়নি।
সিনিয়র নায়িকাদের প্রায় সবাই 'ভোটযুদ্ধে' নেমেছেন। কলকাতার 'হার্টথ্রব'
নায়ক দেবও এখন তৃণমূলের প্রার্থী। প্রশ্ন হচ্ছে, লোকসভায় তাঁরা যেতে চান
বটে, কিন্তু লোকসভায় তাঁদের ভূমিকা কী হবে? তৃতীয়ত, লোকসভা নির্বাচনে এত
বিপুল অর্থ ব্যয় অতীতে কখনো হয়নি। বিজেপির নির্বাচনী বাজেট পাঁচ হাজার কোটি
রুপি। কংগ্রেসের তার চার ভাগের এক ভাগ। সব মিলিয়ে প্রধান দলগুলো সবাই মিলে
৩০ হাজার কোটি রুপির ওপরে খরচ করবে এই নির্বাচনে। এর বাইরে রয়েছে
প্রার্থীদের ব্যক্তিগত খরচ। গত পাঁচ বছরে ভারতের নির্বাচন বাবদ খরচ হয়েছে
প্রায় দেড় লাখ কোটি রুপি। এই অর্থের অর্ধেকেরও বেশি কালো টাকা। এই তথ্যটি
আমাদের দিয়েছে সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজ। চিন্তা করা যায়, ভারতের মতো একটি
দেশে যেখানে দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী, সেখানে দলগুলোই এ নির্বাচনে খরচ করছে
৩০ হাজার কোটি রুপি! আমরা সবাই জানি, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে বিপুল অর্থ
ব্যয় হয়। সিনেট নির্বাচনে প্রার্থীরা সরাসরি টাকা গ্রহণ করেন। বড় বড়
ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে প্রার্থীদের অনুদান দেয়। এটা বৈধ। ভারতের
পরিস্থিতিও অনেকটা তেমন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতে এখন শত শত 'হাজার কোটিপতি'র
জন্ম হয়েছে। তাদের বড় অংশ এখন বিজেপির পেছনে বিনিয়োগ করছে। বোঝাই যায়,
তাদের উদ্দেশ্য কী।
ভারতের
মতো একটি দেশে, যেখানে দারিদ্র্য এখনো একটি প্রধান সমস্যা, সেখানে যখন
হাজার হাজার কোটি টাকা শুধু নির্বাচনের মতো অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় করা হয়, তখন
সংগত কারণেই ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। কেননা নির্বাচনে খরচ করা
এই টাকার কোনো 'রিটার্ন' নেই। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে সামাজিক খাতে
ব্যাপক পরিবর্তন আনা যেত। কয়েকটি পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে।
পরিসংখ্যান
বলছে, ২০০৪ সালে যেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ছিল মোট জনগোষ্ঠীর ২৭.৫
শতাংশ (৪১ কোটি), ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭.০২ শতাংশে (প্রতিদিনের আয় ১
দশমিক ২৫ ডলার হিসাবে)। বিশ্বব্যাংকের ২০১৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের
দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর তিন ভাগের দুই ভাগ বাস করে ভারতে। প্রতিদিন ভারতে পাঁচ
হাজার শিশু ক্ষুধা ও অপুষ্টির শিকার হয়ে মারা যায়। ১৮ লাখ শিশু পাঁচ বছর
পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যায় (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১০)। এই
দরিদ্রতার হার বেশি মধ্য প্রদেশ ও উত্তর প্রদেশে। যেখানে শিশুমৃত্যুর হার
কেরালায় প্রতি এক হাজারে মাত্র ১৪, সেখানে মধ্য প্রদেশ ও উত্তর প্রদেশে এই
সংখ্যা যথাক্রমে ৯২ ও ৯১। অনেকে স্মরণ করতে পারেন এ দুটি রাজ্যে, বিশেষ করে
উত্তর প্রদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে নিয়েই রাজনীতি করেন মায়াবতী (বহেনজি) আর
মুলায়ম সিং যাদব। মায়াবতী নিজে দলিত। আর দলিতদের রানি তিনি। এই দলিত
শ্রেণিই তাঁর ক্ষমতার উৎস। বিশাল এক আর্থিক সাম্রাজ্য তিনি গড়ে তুলেছেন এই
দলিত শ্রেণিকে সামনে রেখে এবং তাদের ব্যবহার করে।
ভারতের বর্তমান
লোকসংখ্যা ১২০ কোটি। কিন্তু ২০৩০ সালে এই জনসংখ্যা চীনকেও ছাড়িয়ে যাবে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভারতের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো টয়লেট নেই। ২০১১
সালে একটি পরিসংখ্যান ছাপা হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, ভারতের ৫৩ শতাংশ মানুষ
মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, ৪৭ শতাংশ মানুষের টিভি আছে, আর ৯ শতাংশ মানুষের
রয়েছে কম্পিউটার। কিন্তু ৫৩ শতাংশ মানুষের কোনো টয়লেট নেই। ৩৯ শতাংশ
মানুষের নেই কোনো 'কিচেন'। আর ৫৭ শতাংশ মানুষের অভ্যন্তরীণ কোনো সূত্র থেকে
সুপেয় পানি পাওয়ার কোনো সুবন্দোবস্ত নেই। অথচ সামাজিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ না
বাড়িয়ে ভারত সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে চলছে। আবারও একটি পরিসংখ্যান
দিচ্ছি। স্পিরির গবেষণা অনুযায়ী, ভারত এখন বড় অস্ত্র ক্রেতা দেশ। ২০০৬-১০
সাল পর্যন্ত ভারতে অস্ত্র সরবরাহ বেড়েছে ৯ শতাংশ হারে। ২০১৫ সাল নাগাদ ভারত
সামরিক খাতে খরচ করবে ৮০ বিলিয়ন ডলার। অস্ত্র খাতে এত বিপুল অর্থ ব্যয়
করে, কিন্তু প্রতিটি শিশুকে স্কুলে পাঠাতে পারেনি ভারত। কন্যাশিশুরা এখনো
পরিবারের বোঝা। কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যার কাহিনী একাধিকবার বিদেশে
সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। ভারতে ৮০ কোটি মানুষের দৈনিক আয় এখনো আড়াই ডলারের
নিচে। ৭০ শতাংশ মানুষ এখনো গ্রামে থাকে। জেন্ডার সমতার দিক থেকে বিশ্বের
১৮৬ দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৩৬ (বাংলাদেশের ১৪৬)। ভারতে নারীরা এখনো
নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। গুয়াহাটির রাস্তায় অসহায় নারীর বস্ত্রহরণের কাহিনী
সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল কিছুদিন আগে। রুমি নাথ নামের এক সংসদ সদস্যের
কাহিনী কিংবা মুম্বাইয়ের এক তরুণীর বাসে গণধর্ষণের কাহিনী প্রমাণ করেছিল
নারীরা সেখানে কত অসহায়। নারীদের এই অসহায়ত্ব নিয়েই উত্তর প্রদেশে জন্ম
হয়েছিল গুলাব গ্যাঙের। ২০০৬ সালে সম্পাত পাল দেবী বুন্দেলখণ্ড গ্রামে
নারীদের সংগঠিত করে জন্ম দিয়েছিলেন গুলাব গ্যাঙের। তাঁরা সবাই গোলাপি শাড়ি
পরে নিজেরাই বিচারকাজ করতেন। তাই তাঁদের নাম হয়েছিল গুলাব গ্যাং। স্থানীয়
পুলিশ আর পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা ছিল অসহায়। তাই তারা নিজেরাই গড়ে তুলেছিল
একটি 'মহিলা রক্ষীবাহিনী'। যাঁরা সিনেমা দর্শক, তাঁরা জানেন বুন্দেলখণ্ড
গ্রামের সম্পাত পাল দেবীর কাহিনী অবলম্বনে তৈরি হয়েছে সিনেমা 'গুলাবি
গ্যাং'। মাধুরী দীক্ষিত অভিনয় করেছেন সম্পাত পাল দেবীর চরিত্রে। রাজস্থানের
মরুভূমিপ্রধান এলাকায় নারীরা এখনো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সুপেয় পানি সংগ্রহ
করেন। রাষ্ট্র এঁদের নূ্যনতম চাহিদা নিশ্চিত করতে পারেনি দীর্ঘ ৬৭ বছরেও।
তাই অমর্ত্য সেন স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন যে সামাজিক খাতে কোনো কোনো
ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের চেয়ে ভালো। ভারতের এই যে সামাজিক
অবস্থান, সেখানে কিনা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোই এবারের নির্বাচনে খরচ করছে
প্রায় ৩০ হাজার কোটি রুপি কিংবা তার চেয়েও বেশি! অথচ একজন অর্থনীতিবিদ
হিসাব করে বলতে পারেন এত বিপুল অর্থ দিয়ে কত শত সহস্র কন্যাশিশুকে স্কুলে
পাঠানো যেত, কত হাজার মানুষের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা যেত, কিংবা
গ্রামীণ দারিদ্র্য কমানো যেত।
ভারতের নির্বাচনের একটা ভালো দিক
হচ্ছে, এখানে জনগণই সরকার পরিবর্তন ঘটায়। আমাদের দেশের মতো 'ভোট ডাকাতি'
সেখানে হয় না কিংবা বড় দলকে বাদ দিয়েও সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না।
মাত্র তিনজন নির্বাচন কমিশনার এই নির্বাচন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন।
সাম্প্রতিককালে এই নির্বাচনে টাকাওয়ালাদের ভিড় বেড়েছে। শত কোটি রুপির মালিক
এমন লোকও নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন, যার সংখ্যাও শতর ওপরে। দুর্নীতির
বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে আম আদমি পার্টি ও কেজরিওয়াল আলোচনার ঝড় তুললেও তাঁর
নিজ দলের প্রার্থী তালিকায় কোটিপতির সংখ্যা অনেক। ভারতে এই নির্বাচন আজ
অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এক. কোটিপতি ব্যবসায়ীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের
মাত্রা বেড়েছে। ফলে ষোড়শ লোকসভায় করপোরেট হাউসের প্রতিনিধিদের সংখ্যা
বাড়বে। সত্যিকার অর্থে জনপ্রতিনিধিদের সংখ্যা হ্রাস পাবে। এর ফলে দুর্নীতির
মাত্রা আরো বাড়বে। দুই. শোবিজে জড়িতদের সংখ্যাও বাড়বে। এঁরা লোকসভার
সদস্যপদকে ব্যবহার করবেন তাঁদের স্বার্থে। স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন এতে
পিছিয়ে পড়বে। তিন. আঞ্চলিক দলগুলোর গুরুত্ব বাড়বে। সরকার গঠনে এদের প্রয়োজন
পড়বে। চার. দীর্ঘদিন পর 'হিন্দুত্ববাদ' আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
নির্বাচনে এর একটা প্রভাব থাকবে। পাঁচ. রাহুল গান্ধীর জন্য এই নির্বাচন
তাঁর নেতৃত্বের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। সম্ভবত সোনিয়া গান্ধীকে মনমোহন সিংয়ের
মতো বিকল্প একজন 'নেতা' খুঁজে বের করতে হবে। প্রিয়াঙ্কা গান্ধী এই
মুহূর্তে কংগ্রেসের শীর্ষ কোনো পদে নেই। এখন সম্ভবত প্রিয়াঙ্কাকেই
কংগ্রেসের হাল ধরতে হবে। প্রিয়াঙ্কাই হতে পারেন তাঁর দাদির (ইন্দিরা
গান্ধী) উত্তরসূরি। ছয়. পারিবারিক রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এই
নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পারিবারিক রাজনীতির ধারা আরো শক্তিশালী হলো। সাত.
বিজেপি 'হিন্দুত্ববাদ'কে পুঁজি করলেও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ভারতের নীতি
পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। আট. ভারতীয় গণতন্ত্র সারা বিশ্বে স্বীকৃতি
পেলেও এই গণতন্ত্র বেশি মাত্রায় পুঁজিনির্ভর হয়ে পড়েছে। কোটিপতিদের ক্লাবে
পরিণত হতে যাচ্ছে ভারতের লোকসভা।
Daily Kalerkontho
28.04.14
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment