এটা তো ঠিক- শতবর্ষ ধরেই এই দুই অঞ্চলের মানুষ দুই দেশের মধ্যে আসা-যাওয়া করেছে। ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে অনেক বাঙালি পরিবার কলকাতায় বসতি গড়েছে। তাদের সন্তানরা এখন ভারতের মূল ধারায় শরিক হয়েছে। এদের আর বাংলাদেশি বাঙালি বলা যাবে না। ঠিক তেমনি আসামের সঙ্গে সিলেটের একটা যোগসূত্র আছে। পারিবারিকভাবেও এই দুই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। এখন বাঙালি বলে কাউকে কাউকে যদি ফেরত পাঠানো হয়, তাহলে তা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে বাধ্য। তিস্তার পানি চুক্তি ও সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারে বিজেপির অবস্থান আমরা মোটামুটি জানি। চূড়ান্ত বিচারে নরেন্দ্র মোদিকে যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সরকার গঠনের প্রশ্নে কোনো 'কমপ্রোমাইজ' করতে হয়, তাহলে মোদি মমতার সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবেন না। এতে করে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি চলে যাবে 'ডিপ ফ্রিজে'। সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারেও বিজেপির প্রচণ্ড আপত্তি রয়েছে। বিজেপির বিরোধিতার কারণেই কংগ্রেস সরকারের সময় চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। চুক্তিটি ভারতীয় মন্ত্রিসভায়ও অনুমোদিত হয়েছিল। একটি বিল লোকসভায় উপস্থাপিতও হয়েছিল। কিন্তু বিজেপির আপত্তির কারণে এটা নিয়ে আর আলোচনা হয়নি। তখন বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে- এটা আমার মনে হয় না। এর বাইরে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং ট্রানজিট প্রশ্নে দুই দেশের মধ্যে আস্থার যে ঘাটতি রয়েছে, সে ব্যাপারে নয়া সরকার কোনো উদ্যোগ নেবে বলে মনে হয় না। আমাদের পররাষ্ট্রসচিব গেল মাসের শেষের দিকে নয়াদিল্লি গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। নির্বাচনের আগে আমাদের পররাষ্ট্রসচিব যখন নয়াদিল্লি যান, তখন বুঝতে হবে, বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতি যাচাই করছে। স্পষ্টতই তিনি কোনো সুখবর নিয়ে আসতে পারেননি। এটা মোটামুটিভাবে আমরা সবাই জানি, কংগ্রেসের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ বেশ কিছু চুক্তি করেছে। ভারত গেল পাঁচ বছর বাংলাদেশের কাছ থেকে বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সে অর্থে তেমন সুবিধা পায়নি। এখন নয়াদিল্লিতে সম্ভাব্য মোদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের 'সম্পর্ক' কী হবে, এ ব্যাপারে এখনই একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। সরকারের উচিত হবে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি 'ভারতীয় ডেস্ক' সৃষ্টি করা ও একটি টিম গঠন করা, যারা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেবে। এটা এখন মোটামুটিভাবে ধরে নেওয়া যায়, যদি নয়াদিল্লিতে বিজেপির নেতৃত্বাধীন একটি সরকার গঠিত হয়, তাহলে তিস্তা ও সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই বাংলাদেশকে প্রস্তুতিটা এখনই নিতে হবে।
সম্ভবত ভারতের মানুষ একটি পরিবর্তন চাচ্ছে। কংগ্রেসের দীর্ঘ শাসনে ভারতে দুর্নীতি বেড়েছে। এটাকেই ইস্যু করেছে বিজেপি। এরই মধ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির বৈরিতা বেড়েছে। মোদি নিজে সোনিয়া গান্ধীর নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একজন সংসদ সদস্য সোনিয়া ও রাহুলকে ইতালিতে ফেরত পাঠানোরও হুমকি দিয়েছেন। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদিকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো দরকার- এমন মন্তব্যও করেছেন কেউ কেউ। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদি অভিযুক্ত হয়েছিলেন, যে দাঙ্গায় কয়েক হাজার মুসলমান নাগরিক প্রাণ হারিয়েছিল। এখন সেই মোদিই চলে আসছেন কেন্দ্রীয় চরিত্রে। যে মোদিকে একসময় যুক্তরাষ্ট্র সরকার তার দেশে প্রবেশের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, সেই মোদি এখন হতে যাচ্ছের ভারতের প্রধানমন্ত্রী! এর চেয়ে লজ্জার আর কী থাকতে পারে!
জয়-পরাজয় নির্ধারিত হওয়ার আগেই মোদির উপদেষ্টারা যখন প্রতিবেশী দেশ চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগ্রাসী মনোভাব ব্যক্ত করেন, তখন এটা বোঝাই যায়, ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আসছে। নির্বাচনী প্রচারণায় চীনকে তার সম্প্রসারণবাদী মনোভাবের লাগাম টেনে ধরতে বলেছেন মোদি। অনেকেই জানেন, ভারতের অরুণাচল রাজ্য নিয়ে চীনের সঙ্গে ভারতের বিরোধ রয়েছে। গত ৯ বছরের ইউপিএ সরকারের জমানায় চীন-ভারত সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হলেও, চীন কখনোই অরুণাচল রাজ্যের ওপর তাদের দাবি পরিত্যাগ করেনি। এমনকি নয়া চীনা প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফরের সময়ও চীনা প্রধানমন্ত্রী অরুণাচলে তাঁদের অধিকারের প্রসঙ্গটি লুকিয়ে রাখেননি। গত মাসে মোদি অরুণাচলে এক জনসভায় বলেছিলেন, 'মাটির নামে শপথ করছি, দেশ রক্ষা করব।' স্পষ্টতই মোদি একটা ইঙ্গিত দিলেন যে অরুণাচলের ব্যাপারে ভারত তার অবস্থান থেকে সরে আসবে না। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যে পরিবর্তন আসছে, তাতে ভারতের চীনের প্রয়োজন রয়েছে। দেশ দুটো অর্থনৈতিক সংস্থা 'ব্রিকস'-এর সদস্য। 'ব্রিকস' হচ্ছে আগামী দশকের অন্যতম অর্থনৈতিক জোট। এই অর্থনীতি ভবিষ্যতে বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এই মুহূর্তে চীন বিশ্বের দুই নম্বর অর্থনীতির দেশ। আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে চীন-ভারত সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতিসম্প্রতি ক্রিমিয়া ইস্যুতে রাশিয়ার ভূমিকাকে সমর্থন করেছে চীন ও ভারত। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটিতে (ক্রিমিয়া প্রশ্নে) চীন ও ভারত (বাংলাদেশও) ভোটদানে বিরত থাকে। এর অর্থ- পরোক্ষভাবে রাশিয়ার ভূমিকাকে সমর্থন করেছে চীন ও ভারত। বলা ভালো, রাশিয়াও 'ব্রিকস'-এর সদস্য। সুতরাং মুখে বললেও বাস্তব ক্ষেত্রে মোদি কতটুকু চীনবিরোধিতায় নামবেন, এটা একটা প্রশ্ন। তবে পাকিস্তান প্রশ্নে মোদি কঠোর হতে পারেন। ভারত ও পাকিস্তান তিন-তিনবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। ২০০১ সালেও চতুর্থবারের মতো আরেকটি যুদ্ধের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। তবে সেই যুদ্ধ হয়নি। এবং বেশ কয়েক বছর ধরে দুই দেশের সীমান্তে শান্তি বজায় রয়েছে। এখন মোদির যেকোনো সিদ্ধান্ত সীমান্তে উত্তেজনা বাড়াবে মাত্র। মোদি তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় ভারতের ভেতরে জঙ্গি তৎপরতা চালানোর অভিযোগ এনেছেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। সুতরাং পাকিস্তান থাকবে এক ধরনের অনিশ্চয়তায়।
বিশ্ব আসরে ভারত একটি ভূমিকা পালন করছে। ২০১৪-পরবর্তী আফগানিস্তানে ভারত পালন করবে একটি বড় ভূমিকা। সেখানে ভারতের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। এমনকি ভারতের বিমানবাহিনীর একটি ঘাঁটিও রয়েছে আফগানিস্তানে। এ অবস্থান মোদি ধরে রাখবেন। তবে তিনি অর্থনীতির ওপর গুরুত্ব দেবেন। অর্থনৈতিক কূটনীতি প্রাধান্য পাবে। এবং ধারণা করছি, মনমোহন সিংয়ের সময় রচিত অর্থনৈতিক কূটনীতিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবেন মোদি। বিশাল এক কর্মকাণ্ড নিয়ে ৭ এপ্রিল শুরু হয়েছে ষোড়শ লোকসভার নির্বাচন। পৃথিবীতে আর কোথাও এত বড় নির্বাচনযজ্ঞ হয়নি। ৮১ কোটি ৪৫ লাখ ভোটার মোট ৯ দফায় ভোট দেবেন। ফলাফল জানা যাবে ১৬ মে। তাই বিতর্কিত ও গুজরাট দাঙ্গার (২০০২) সঙ্গে জড়িত ও অভিযুক্ত নরেন্দ্র মোদি যদি ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হন, তাতে ভারতের বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কী পরিবর্তন আসে, সে ব্যাপারে লক্ষ থাকবে অনেকের।
Daily KALERKONTHO
16.04.14
0 comments:
Post a Comment