গত
১ অক্টোবর চীন তার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ৭০ বছর পার করার পর যে প্রশ্নটি
অনেকেই করার চেষ্টা করেন, তা হচ্ছে কোন পথে যাবে এখন চীন? আগামী ৩০ বছর,
অর্থাত্ ২০৪৯ সাল পর্যন্ত, যখন চীন ১০০ বছরে পা দেবে, তত দিন পর্যন্ত কি
চীন তার বর্তমান সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো নিয়ে টিকে থাকতে পারবে? এ
প্রশ্নটি যথেষ্ট যৌক্তিক ও তাত্পর্যপূর্ণ। কেননা ১৯৪৯ সালে মাও জেদং যে
চীনা রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিলেন, গত ৭০ বছরে চীনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে,
বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চীনের সাফল্য চোখে লাগার মতো। বিশ্ব আগামী
দিনে কেমন চীন দেখবে? গত ১ অক্টোবর চীনের জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষে
প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং যে ভাষণ দেন, তাতে আগামী দিনের চীন সম্পর্কে কিছু
ধারণা পাওয়া যায়। আমার কাছে প্রেসিডেন্ট শির বক্তব্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে
হয়েছে—এতে করে আগামী দিনের চীনের রাজনীতি সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে।
প্রথমত তিনি বলেছেন, কোনো শক্তি চীনের অগ্রযাত্রাকে রুখতে পারবে না।
অর্থাত্ চীন যে পথে তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এনেছে, তা ধরে রাখবে ও
বিশ্বশক্তিতে পরিণত হবে। এর ব্যাখ্যা হচ্ছে—‘চীনা ভাবধারা ও ঐতিহ্য অনুযায়ী
সমাজতন্ত্রের বিকাশ’-এর যে নীতি চীন গ্রহণ করেছে, তা অব্যাহত থাকবে। চীন
সমাজতন্ত্রের পথ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে না, এই মেসেজটিই দিলেন পার্টি
চেয়ারম্যান শি চিনপিং। অবশ্যই ‘এই সমাজতন্ত্র’ পুরোপুরি মার্ক্সীয় দর্শন
অনুসরণ করবে না। সত্তরের শেষের দিকে সমাজতন্ত্র আর বাজার অর্থনীতির মিশেলে
নতুন যে একটি ‘সমাজতান্ত্রিক ধারণা’ চীন ধারণ করেছিল, তা অব্যাহত থাকবে। আর
বাজার অর্থনীতির ধারণা চীনের ঐতিহ্যেরই অংশ, যার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়
কনফুসিয়াস দর্শনের। চীন আগামী ৩০ বছর সমাজতন্ত্রকে পুরোপুরিভাবে পরিত্যাগ
করবে না, আবার বাজার অর্থনীতিকেও পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করবে না। দ্বিতীয়ত শি
বলেছেন, চীন শান্তিপূর্ণভাবে উন্নয়নপ্রক্রিয়া নিয়ে এগিয়ে যাবে। ‘এক চীন ও
দুই নীতি’ অবলম্বন করে হংকং ও ম্যাকাওকে চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে
সংযুক্তির পথে কাজ করবে এবং এক চীন নীতি অবলম্বন করে তাইওয়ানকে মূল
ভূখণ্ডের সঙ্গে এক করার পথে তার প্রয়াস অব্যাহত রাখবে। প্রেসিডেন্ট শি এই
আহ্বানটা জানালেন এমন এক সময় যখন গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে হংকংয়ে
‘গণবিক্ষোভ’ অব্যাহত রয়েছে। সেখানে স্বাধীনতার দাবি আরো শক্তিশালী হচ্ছে।
তাইওয়ান চীনের অংশ—এই দাবি থেকেও চীন সরে আসেনি। ফলে হংকং, ম্যাকাও ও
তাইওয়ান সম্পর্কে চীনা নীতি কী হবে, তা তিনি স্পষ্ট করলেন। তৃতীয়ত, তাঁর
ভাষণে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের
সঙ্গে ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ ও দক্ষিণ চীন সাগর (South China Sea) নিয়ে চীনের এক
ধরনের দ্বন্দ্ব রয়েছে। তাঁর ভাষণে এগুলো ছিল উল্লেখযোগ্য দিক। তবে এর বাইরে
আরো বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়। এক. চেয়ারম্যান শির নেতৃত্বে পলিটব্যুরোর
সাতজন সদস্য তিয়ানানমেনের জাদুঘরে সংরক্ষিত মাও জেদংয়ের মাওসোলিয়াম
পরিদর্শন ও শ্রদ্ধা নিবেদন। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর এই প্রথম কোনো
চীনা নেতা মাওসোলিয়ামে গেলেন (সিএনবিসি নিউজ)। এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
চেয়ারম্যান শি এই প্রথমবারের মতো বিখ্যাত ‘মাও পোশাক’ পরে হাজির হলেন
(সাধারণত তিনি ‘স্যুটেড-বুটেড’ হয়ে এ ধরনের অনুষ্ঠানে আসেন)। এটাও
গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্য দিয়ে অনেক দিন পর চীনা নেতৃত্ব মাওয়ের অবদানকে স্মরণ
করলেন। দুই. মার্চপাস্টে চীন অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র (ডিএফ-৪ মিসাইল, জে-২০
ফাইটার বিমান, যা পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য) প্রদর্শন করে। এর অর্থ
পরিষ্কার—চীনকে সামরিক দিক দিয়ে দমিয়ে রাখা যাবে না। মার্চপাস্টে সাবেক
প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিনকেও দেখা গেল। ১৯৮৯ সালে চীনের তথাকথিত গণতান্ত্রিক
আন্দোলনে (তিয়ানানমেন) অপসারিত হন জিয়াং জেমিন। তিয়ানানমেনের ঘটনা
নিঃসন্দেহে চীনের সমসাময়িক রাজনীতির জন্য একটি বড় ঘটনা। একটি সমাজতান্ত্রিক
সমাজে বহুদলীয় গণতন্ত্র কতটুকু গ্রহণযোগ্য কিংবা তা আদৌ কাজ করবে কি না
(সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বলেছিলেন, তিনি জীবদ্দশায় চীনে
গণতন্ত্র দেখে যাবেন), এটা নিয়ে বিতর্ক আছে। সংস্কারের প্রয়োজন আছে। কিন্তু
বহুদলীয় গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রের পতন ঘটাবে, যেমনটি ঘটেছিল সাবেক সোভিয়েত
ইউনিয়নে। সুতরাং দেং জিয়াও পিংয়ের সিদ্ধান্ত ছিল সঠিক। ছাত্রদের চাপের মুখে
গণতন্ত্র নয়।
চীন একটি বড় দেশ। বিপুল জনগোষ্ঠীর বাস এই দেশে। ৫৫টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি রয়েছে এ দেশে। এ দেশে পশ্চিমা গণতন্ত্র কাজ করবে না। আজকের যে চীন—দেশটিকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসার মূল কর্তৃত্ব শি চিনপিংয়ের। চীনের ৭০ বছরের রাজনীতিতে যে তিনজন অদূরদর্শী নেতার কথা বলা হয়, তাঁর একজন হচ্ছেন শি চিনপিং (বাকি দুজন মাও ও দেং)। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি মাওকেও ছাড়িয়ে গেছেন। ২০১৭ সালে বিখ্যাত নিউজ ম্যাগাজিন ইকোনমিস্ট তাঁকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল (১৪ অক্টোবর)। আর ২০১৮ সালে ফোর্বস (Forbes) তাঁকে শুধু বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হিসেবেই চিহ্নিত করেনি, বরং প্রভাব বিস্তারকারী নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল (৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯)। ফোর্বস তাঁকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের চেয়েও ওপরে স্থান দিয়েছিল। ২০১২ সালের পর থেকেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন (প্রেসিডেন্ট ২০১৩ থেকে)। পার্টির দায়িত্ব নিয়ে তিনি অর্থনীতিতে আরো সংস্কার আনেন। এ সময় Laogai পদ্ধতি, অর্থাত্ Reeducation through labour—এটা তিনি বদলে ফেলেন। এক সন্তানের যে চীনা নীতি, তা-ও তিনি বদলে ফেলেন। পার্টির নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযান পরিচালনা করে তিনি ব্যাপক প্রশংসিত হন। বৈদেশিক নীতিতে বড় পরিবর্তন আনার লক্ষ্যেই তিনি ২০১৩ সালে কাজাখস্তান সফরের সময় তাঁর উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) উপস্থাপন করেন। বিআরআই (যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে এক থেকে আট ট্রিলিয়ন ডলার) প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের একটি দর্শন। এর মাধ্যমে বিশ্বের ৬৫টি দেশকে চীনের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। বিআরআই দুইভাবে কাজ করবে—প্রথমত, সড়ক ও রেলপথে মধ্য এশিয়া, পাকিস্তান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ ইউরোপ পর্যন্ত সংযুক্ত হবে।
দ্বিতীয়ত, সমুদ্রপথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা হয়ে সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত তা সংযুক্ত হবে। এর মধ্য দিয়ে চীনা পণ্য অতি দ্রুততার সঙ্গে ও সহজলভ্যে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে। চীন বিআরআইয়ের অধীন দেশগুলোকে অবকাঠামো খাতে ঋণ দেবে। তবে এই চীনা ঋণ নিয়ে এরই মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে, ঋণ দিয়ে চীন ‘ঋণের ফাঁদে’ ফেলছে দেশগুলোকে। তবে বিআরআই নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন, বিআরআই যে চীনকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ হিসেবে পরিচিত করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এটি সফল হলে পৃথিবীর জনসংখ্যার তিন ভাগের দুই ভাগ মানুষ চীনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। বাংলাদেশও বিআরআইয়ের আওতায় চীন থেকে ঋণ নিচ্ছে। একজন গবেষক এলিজাবেথ ইকোনমি লিখেছেন, ‘Under XI, China now actively seeks international norms and institutions, and forcefully asserts its presence on the global stage।’ মিথ্যা বলেননি এলিজাবেথ ইকোনমি। চীনের আর্থিক ভিত্তি চীনকে যথেষ্ট শক্তিশালী করেছে এবং চীনকে বিশ্বশক্তিতে পরিণত করেছে। বিআরআই পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আরো একটি উদ্দেশ্য কাজ করছে—তা হচ্ছে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান মার্কিনি আগ্রাসনের মুখে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্র তার ‘ Pivot to Asia’ পরিকল্পনায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তার সামরিক প্রভাব বাড়াচ্ছে। এর বিপরীতেই মার্কিনি প্রভাব কমাতে চীন তার বিআরআই পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে আগামী দিনে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব এই অঞ্চলে স্নায়ুযুদ্ধ-২-এর জন্ম দিতে পারে।
চীন এখন পরিপূর্ণভাবে বদলে গেছে। চীন-ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় (১৯৭৮) সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছিল, চীনা সৈন্যরা কোথাও কোথাও খালি পায়ে (বুট ছাড়া) যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। সেই চীন এখন বদলে গেছে। যে চীনের নাগরিকরা একসময় তাদের ঘরে একটি সেলাই মেশিন থাকলে তা নিয়ে গর্ব করত, সেই চীন এখন বিশ্বের ধনী দেশগুলোর একটি। ২০১৯ সালের অভিক্ষণ অনুযায়ী বিশ্বে জিডিপিতে শীর্ষে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র (২১৪৮২.৪১ বিলিয়ন ডলার)। এর পরের অবস্থান চীনের, ১৪১৭২.২০ বিলিয়ন ডলার (STATICS TIMES, IMF, April 2018), কিন্তু ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে শীর্ষে থাকবে চীন (২৭৪৪৯.০৫ বিলিয়ন ডলার), যুক্তরাষ্ট্র নিচে নেমে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে (২১৪৮২.৪১ বিলিয়ন ডলার)। পরিসংখ্যানই বলে দেয়, বিশ্বরাজনীতির নিয়ন্ত্রণ এখন চীনের হাতে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন, উনবিংশ শতাব্দী ছিল ব্রিটেনের হাতে
(Pax Britanica), বিংশ শতাব্দী ছিল যুক্তরাষ্ট্রের হাতে (American century)| আর একুশ শতক হবে চীনের, চীনা ভাষায়
(Pinyin), যার আভিধানিক অর্থ The Chinese century। এই Chinese century-B বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করবে একুশ শতকে। এ ক্ষেত্রে গত ৭০ বছরে চীনের যে অগ্রগতি, সে ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। চীন ছিল একটি কৃষিভিত্তিক সমাজ, কৃষিতে উত্পাদনের পরিমাণ যেখানে (১৯৪৯) ছিল ১১৩.১৮ মিলিয়ন টন, তা ২০১৮ সালে বেড়েছে ৬৫৭.৮৯ মিলিয়ন টন। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে চীন এখন ‘বিশ্ব উত্পাদন কারখানায়’ পরিণত হয়েছে।
মাথাপিছু আয় ছিল (১৯৫২) মাত্র ৫৪ ডলার, তা এখন ৯ হাজার ৭৩২ ডলার, অর্থাত্ ১৮০ গুণ বেশি বেড়েছে। জিডিপির পরিমাণ ছিল মাত্র ৬৭.৯ বিলিয়ন ইউয়ান (১৯৫২), তা এখন বেড়েছে ৯০ হাজার ৩১ বিলিয়ন ইউয়ানে)। রিজার্ভ ছিল মাত্র ১০৮ মিলিয়ন ডলার (১৯৫২), ২০১৮ সালে এর পরিমাণ ৩০ লাখ ৭২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ডলার। চীন এখন রপ্তানি করে চার হাজার ৬০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা ছিল মাত্র ১.১৩ বিলিয়ন ডলার ১৯৫০ সালে। প্রায় ৭৫০ বিলিয়ন মানুষকে (৭৫ কোটি) চীন দারিদ্র্যসীমা থেকে বের করে আনতে পেরেছে। চীন এখন ১৪.১৭ ট্রিলিয়ন (১৩৬১০০০০ মিলিয়ন) ডলারের অর্থনীতি। যা বিশ্বের দ্বিতীয় (কিন্তু পিপিপির হিসাবে প্রথম)। চীনের অর্থনীতির ৬০ শতাংশ এখন নিয়ন্ত্রণ করে ব্যক্তিগত খাত। আর ৮০ শতাংশ চাকরি হচ্ছে ব্যক্তিগত খাতে। সুতরাং এই যে চীন, এই চীনকে অস্বীকার করা যাবে না। সুতরাং কেমন হবে আগামী দিনের চীন? চীনে একদলীয় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বহাল থাকবে, যা ধ্রুপদি মার্কসবাদ অনুসরণ করবে না। সেনাবাহিনী পার্টির প্রতি এখনো অনুগত। এখানে পশ্চিমা মডেলের কিংবা জাপানি মডেলের গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। অনেকটা ‘সিঙ্গাপুর মডেলে’ একদলীয় শাসন, কঠোর দুর্নীতিমুক্ত একটি শাসনব্যবস্থা ধীরে ধীরে চীনে বিকশিত হবে। তবে ‘সিঙ্গাপুর মডেলের’ সঙ্গে পার্থক্য এখানে যে ‘সিঙ্গাপুর মডেল’ পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি কিছুটা ধারণ করে। আর চীনে সমাজতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির সমন্বয়ে একটি সমাজব্যবস্থা বিকশিত হচ্ছে, যেখানে সিঙ্গাপুরের মতো দু-একটি বিরোধী দলের উপস্থিতি এখন অবধি লক্ষ করা যাচ্ছে না।
Daily Kalerkontho
14.10.2019
চীন একটি বড় দেশ। বিপুল জনগোষ্ঠীর বাস এই দেশে। ৫৫টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি রয়েছে এ দেশে। এ দেশে পশ্চিমা গণতন্ত্র কাজ করবে না। আজকের যে চীন—দেশটিকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসার মূল কর্তৃত্ব শি চিনপিংয়ের। চীনের ৭০ বছরের রাজনীতিতে যে তিনজন অদূরদর্শী নেতার কথা বলা হয়, তাঁর একজন হচ্ছেন শি চিনপিং (বাকি দুজন মাও ও দেং)। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি মাওকেও ছাড়িয়ে গেছেন। ২০১৭ সালে বিখ্যাত নিউজ ম্যাগাজিন ইকোনমিস্ট তাঁকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল (১৪ অক্টোবর)। আর ২০১৮ সালে ফোর্বস (Forbes) তাঁকে শুধু বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হিসেবেই চিহ্নিত করেনি, বরং প্রভাব বিস্তারকারী নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল (৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯)। ফোর্বস তাঁকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের চেয়েও ওপরে স্থান দিয়েছিল। ২০১২ সালের পর থেকেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন (প্রেসিডেন্ট ২০১৩ থেকে)। পার্টির দায়িত্ব নিয়ে তিনি অর্থনীতিতে আরো সংস্কার আনেন। এ সময় Laogai পদ্ধতি, অর্থাত্ Reeducation through labour—এটা তিনি বদলে ফেলেন। এক সন্তানের যে চীনা নীতি, তা-ও তিনি বদলে ফেলেন। পার্টির নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযান পরিচালনা করে তিনি ব্যাপক প্রশংসিত হন। বৈদেশিক নীতিতে বড় পরিবর্তন আনার লক্ষ্যেই তিনি ২০১৩ সালে কাজাখস্তান সফরের সময় তাঁর উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) উপস্থাপন করেন। বিআরআই (যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে এক থেকে আট ট্রিলিয়ন ডলার) প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের একটি দর্শন। এর মাধ্যমে বিশ্বের ৬৫টি দেশকে চীনের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। বিআরআই দুইভাবে কাজ করবে—প্রথমত, সড়ক ও রেলপথে মধ্য এশিয়া, পাকিস্তান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ ইউরোপ পর্যন্ত সংযুক্ত হবে।
দ্বিতীয়ত, সমুদ্রপথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা হয়ে সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত তা সংযুক্ত হবে। এর মধ্য দিয়ে চীনা পণ্য অতি দ্রুততার সঙ্গে ও সহজলভ্যে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে। চীন বিআরআইয়ের অধীন দেশগুলোকে অবকাঠামো খাতে ঋণ দেবে। তবে এই চীনা ঋণ নিয়ে এরই মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে, ঋণ দিয়ে চীন ‘ঋণের ফাঁদে’ ফেলছে দেশগুলোকে। তবে বিআরআই নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন, বিআরআই যে চীনকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ হিসেবে পরিচিত করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এটি সফল হলে পৃথিবীর জনসংখ্যার তিন ভাগের দুই ভাগ মানুষ চীনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। বাংলাদেশও বিআরআইয়ের আওতায় চীন থেকে ঋণ নিচ্ছে। একজন গবেষক এলিজাবেথ ইকোনমি লিখেছেন, ‘Under XI, China now actively seeks international norms and institutions, and forcefully asserts its presence on the global stage।’ মিথ্যা বলেননি এলিজাবেথ ইকোনমি। চীনের আর্থিক ভিত্তি চীনকে যথেষ্ট শক্তিশালী করেছে এবং চীনকে বিশ্বশক্তিতে পরিণত করেছে। বিআরআই পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আরো একটি উদ্দেশ্য কাজ করছে—তা হচ্ছে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান মার্কিনি আগ্রাসনের মুখে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্র তার ‘ Pivot to Asia’ পরিকল্পনায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তার সামরিক প্রভাব বাড়াচ্ছে। এর বিপরীতেই মার্কিনি প্রভাব কমাতে চীন তার বিআরআই পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে আগামী দিনে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব এই অঞ্চলে স্নায়ুযুদ্ধ-২-এর জন্ম দিতে পারে।
চীন এখন পরিপূর্ণভাবে বদলে গেছে। চীন-ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় (১৯৭৮) সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছিল, চীনা সৈন্যরা কোথাও কোথাও খালি পায়ে (বুট ছাড়া) যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। সেই চীন এখন বদলে গেছে। যে চীনের নাগরিকরা একসময় তাদের ঘরে একটি সেলাই মেশিন থাকলে তা নিয়ে গর্ব করত, সেই চীন এখন বিশ্বের ধনী দেশগুলোর একটি। ২০১৯ সালের অভিক্ষণ অনুযায়ী বিশ্বে জিডিপিতে শীর্ষে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র (২১৪৮২.৪১ বিলিয়ন ডলার)। এর পরের অবস্থান চীনের, ১৪১৭২.২০ বিলিয়ন ডলার (STATICS TIMES, IMF, April 2018), কিন্তু ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে শীর্ষে থাকবে চীন (২৭৪৪৯.০৫ বিলিয়ন ডলার), যুক্তরাষ্ট্র নিচে নেমে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে (২১৪৮২.৪১ বিলিয়ন ডলার)। পরিসংখ্যানই বলে দেয়, বিশ্বরাজনীতির নিয়ন্ত্রণ এখন চীনের হাতে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন, উনবিংশ শতাব্দী ছিল ব্রিটেনের হাতে
(Pax Britanica), বিংশ শতাব্দী ছিল যুক্তরাষ্ট্রের হাতে (American century)| আর একুশ শতক হবে চীনের, চীনা ভাষায়
(Pinyin), যার আভিধানিক অর্থ The Chinese century। এই Chinese century-B বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করবে একুশ শতকে। এ ক্ষেত্রে গত ৭০ বছরে চীনের যে অগ্রগতি, সে ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। চীন ছিল একটি কৃষিভিত্তিক সমাজ, কৃষিতে উত্পাদনের পরিমাণ যেখানে (১৯৪৯) ছিল ১১৩.১৮ মিলিয়ন টন, তা ২০১৮ সালে বেড়েছে ৬৫৭.৮৯ মিলিয়ন টন। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে চীন এখন ‘বিশ্ব উত্পাদন কারখানায়’ পরিণত হয়েছে।
মাথাপিছু আয় ছিল (১৯৫২) মাত্র ৫৪ ডলার, তা এখন ৯ হাজার ৭৩২ ডলার, অর্থাত্ ১৮০ গুণ বেশি বেড়েছে। জিডিপির পরিমাণ ছিল মাত্র ৬৭.৯ বিলিয়ন ইউয়ান (১৯৫২), তা এখন বেড়েছে ৯০ হাজার ৩১ বিলিয়ন ইউয়ানে)। রিজার্ভ ছিল মাত্র ১০৮ মিলিয়ন ডলার (১৯৫২), ২০১৮ সালে এর পরিমাণ ৩০ লাখ ৭২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ডলার। চীন এখন রপ্তানি করে চার হাজার ৬০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা ছিল মাত্র ১.১৩ বিলিয়ন ডলার ১৯৫০ সালে। প্রায় ৭৫০ বিলিয়ন মানুষকে (৭৫ কোটি) চীন দারিদ্র্যসীমা থেকে বের করে আনতে পেরেছে। চীন এখন ১৪.১৭ ট্রিলিয়ন (১৩৬১০০০০ মিলিয়ন) ডলারের অর্থনীতি। যা বিশ্বের দ্বিতীয় (কিন্তু পিপিপির হিসাবে প্রথম)। চীনের অর্থনীতির ৬০ শতাংশ এখন নিয়ন্ত্রণ করে ব্যক্তিগত খাত। আর ৮০ শতাংশ চাকরি হচ্ছে ব্যক্তিগত খাতে। সুতরাং এই যে চীন, এই চীনকে অস্বীকার করা যাবে না। সুতরাং কেমন হবে আগামী দিনের চীন? চীনে একদলীয় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বহাল থাকবে, যা ধ্রুপদি মার্কসবাদ অনুসরণ করবে না। সেনাবাহিনী পার্টির প্রতি এখনো অনুগত। এখানে পশ্চিমা মডেলের কিংবা জাপানি মডেলের গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। অনেকটা ‘সিঙ্গাপুর মডেলে’ একদলীয় শাসন, কঠোর দুর্নীতিমুক্ত একটি শাসনব্যবস্থা ধীরে ধীরে চীনে বিকশিত হবে। তবে ‘সিঙ্গাপুর মডেলের’ সঙ্গে পার্থক্য এখানে যে ‘সিঙ্গাপুর মডেল’ পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি কিছুটা ধারণ করে। আর চীনে সমাজতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির সমন্বয়ে একটি সমাজব্যবস্থা বিকশিত হচ্ছে, যেখানে সিঙ্গাপুরের মতো দু-একটি বিরোধী দলের উপস্থিতি এখন অবধি লক্ষ করা যাচ্ছে না।
Daily Kalerkontho
14.10.2019
0 comments:
Post a Comment