একটি
হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বুয়েটে। বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে সেখানে
পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর যারা ফাহাদকে হত্যা করেছে, তারা সবাই বুয়েটের
ছাত্র- এ দেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবী শিক্ষার্থীদের কয়েকজন! আমরা ধরে নিতে পারি
দেশের সেরা মেধাবীরাই বুয়েটে পড়াশোনা করার সুযোগ পায়। কিন্তু ফাহাদ
হত্যাকাণ্ডের ঘটনা প্রমাণ করল বুয়েটে মেধাবীদের পাশাপাশি খুনিরাও পড়তে যায়!
এ ঘটনা সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে এবং ৮ অক্টোবরের
হত্যাকাণ্ডের পর দেশের সব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে।
ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অনেক প্রশ্ন সামনে এনেছে। এক. এটি একটি
পরিষ্কার ‘রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড’। কারণ ফাহাদকে খুন করা হয়েছে ফেসবুকে দেয়া
তার একটি স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে, যেখানে তিনি সম্প্রতি ভারতকে গ্যাস,
ফেনী নদীর পানি এবং মোংলা বন্দর ব্যবহার করতে দেয়ার ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে
বাংলাদেশ চুক্তি স্বাক্ষর করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। এ স্ট্যাটাসের
কারণে বুয়েটের ছাত্রলীগের ছেলেরা খুশি হতে পারেনি। এ স্ট্যাটাসের জের ধরে
তারা ফাহাদকে মারধর করে। তাতেই তিনি মারা যান। রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা কোন্
পর্যায়ে গিয়েছে, এটা তার বড় প্রমাণ। মতপ্রকাশের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের
সাংবিধানিক অধিকার। ফাহাদ একটা মতামত দিয়েছেন। তবে সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা
যাবে তিনি সরকারপ্রধান কিংবা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি। ছাত্রলীগের
নেতাকর্মীদের এতে অসন্তুষ্ট হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। এর পেছনে কাজ করেছে
ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ভিন্নমতের অনুসারীদের সহ্য না করার মানসিকতা। এ
মানসিকতা আজ সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। এটা এলার্মিং।
দুই. অভিযুক্তরা সবাই ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার নেতা ও কর্মী। খুনের মামলায় যাদের গ্রেফতর করা হয়েছে, তারা সবাই খুনের ঘটনা স্বীকারও করেছে। শুধু বুয়েটই নয়, প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই টেন্ডারবাজি, অত্যাচার, তথাকথিত ‘টর্চার সেল’- প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া যায়। ছাত্রলীগের এক সংগ্রামী ঐতিহ্য রয়েছে। এখনকার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সেই ঐতিহ্য ধারণ করেন না। সুতরাং সময় এসেছে ছাত্রলীগের ভেতরে বড় ধরনের ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালানোর। বিশেষ করে আদর্শগতভাবে তাদের কীভাবে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করা যায, সে প্রচেষ্টা চালানো উচিত।
তিন. আমাদের জাতীয় নেতারা রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা জন্ম দেয়ার জন্য দায়ী। উচ্চপর্যায় থেকে যখন বিদ্বেষ ছড়ানো হয়, তখন তা প্রান্তিক পর্যায়ে চলে আসবে এটা স্বাভাবিক। এ দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য একটি সুস্থ ধারার রাজনীতি প্রবর্তন করা জরুরি। আর এ উদ্যোগটা নিতে হবে রাজনীতিকদেরই।
দুই. অভিযুক্তরা সবাই ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার নেতা ও কর্মী। খুনের মামলায় যাদের গ্রেফতর করা হয়েছে, তারা সবাই খুনের ঘটনা স্বীকারও করেছে। শুধু বুয়েটই নয়, প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই টেন্ডারবাজি, অত্যাচার, তথাকথিত ‘টর্চার সেল’- প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া যায়। ছাত্রলীগের এক সংগ্রামী ঐতিহ্য রয়েছে। এখনকার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সেই ঐতিহ্য ধারণ করেন না। সুতরাং সময় এসেছে ছাত্রলীগের ভেতরে বড় ধরনের ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালানোর। বিশেষ করে আদর্শগতভাবে তাদের কীভাবে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করা যায, সে প্রচেষ্টা চালানো উচিত।
তিন. আমাদের জাতীয় নেতারা রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা জন্ম দেয়ার জন্য দায়ী। উচ্চপর্যায় থেকে যখন বিদ্বেষ ছড়ানো হয়, তখন তা প্রান্তিক পর্যায়ে চলে আসবে এটা স্বাভাবিক। এ দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য একটি সুস্থ ধারার রাজনীতি প্রবর্তন করা জরুরি। আর এ উদ্যোগটা নিতে হবে রাজনীতিকদেরই।
পাঁচ. ফাহাদ হত্যাকাণ্ড এ যুক্তিকেই জোরালো করল যে, লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। কোনো ক্যাম্পাসে দলীয় ছাত্র রাজনীতি থাকবে না। ছাত্র রাজনীতি থাকতে পারে; কিন্তু তা হতে হবে শুধু ছাত্রদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কিত। ছাত্ররা জাতীয় রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাবে না। জাতীয় রাজনীতির বিষয়টি ছেড়ে দিতে হবে জাতীয় নেতাদের কাছে। কোনো দল কোনো ক্যাম্পাসে তাদের ছাত্রসংগঠনকে স্বীকৃতি দেবে না। জাতীয় দলগুলোর সমর্থক থাকতেই পারে; কিন্তু ক্যাম্পাসে তা প্রকাশ করার কোনো সুযোগ থাকবে না। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করে তা সংসদে পাস করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে এমন একটি আইন প্রণয়ন করা জরুরি। যেখানে দলীয় ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকবে।
ছয়. ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর সারা দেশে যে প্রতিক্রিয়া দেখলাম, তা আমাদের একটা মেসেজ দেয়, আর তা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের মাঝে অসন্তোষ আর হতাশা বিরাজ করছে। নানা কারণে মানুষের মাঝে এ হতাশা আছে। এ হতাশা থেকে কী করে বেরিয়ে আসা যায়, তা এখন দেখতে হবে। সরকারপ্রধানের দিকে তাকিয়ে আছে মানুষ। সাধারণ মানুষের ভরসা তার কাছেই।
সাত. ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ৩৬ ঘণ্টা পর বুয়েটের ভিসি ক্যাম্পাসে যান। ফলে তার প্রতি শিক্ষার্থীদের যে ক্ষোভ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। একজন ভিসি কি এমনটি পারেন? তিনি তো ছাত্রদের অভিভাবক। একজন ‘পিতা’। একটা ছেলে খুন হল, তিনি এলেন না, জানাজায়ও অংশ নিলেন না। কেমন ভিসি তিনি? এটা অন্যায়, অপরাধও। তার জন্য বোধকরি পদত্যাগ করাই শ্রেয়! এ ঘটনা আবারও প্রমাণ করল শিক্ষা মন্ত্রণালয় যাদেরকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়, তাদের সেই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ত্রুটি আছে। গত ১০ বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয় যাদেরই ভিসি বানিয়েছে, তারা সবাই দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় ভিসি নিয়োগ দিলে তা উচ্চশিক্ষা ও ছাত্রদের স্বার্থ যে দেখে না, বুয়েটের ভিসি এর সর্বশেষ উদাহরণ।
আট. বুয়েটের ছাত্ররা কিছু দাবি-দাওয়া উত্থাপন করেছে। এগুলো নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। যেমন বলা হয়েছে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, প্রয়োজনে বুয়েট এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সুতরাং বুয়েটের সিন্ডিকেট, এ সিদ্ধান্তটি নিতে পারে। বুয়েট কর্তৃপক্ষ শিক্ষক সমিতিরও পরামর্শ নিতে পারে। সীমিত সময়ের জন্য হলেও ছাত্র রাজনীতি এবং র্যাগের নামে মানসিক নির্যাতন বন্ধ হোক। অভিযুক্ত ছাত্রদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেয়া যায়, সে ব্যাপারে আইনি পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আইনেই ছাত্রত্ব বাতিল করা যায়। মামলা চালানো ও ফাহাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধানও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে আছে। সিন্ডিকেট সব সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নেয়া যায় কিনা, তা বুয়েট কর্তৃপক্ষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে দেখতে পারে। ইতিমধ্যে শেরেবাংলা হলের প্রভোস্ট পদত্যাগ করেছেন। অর্থাৎ ছাত্রদের অনেক দাবি-দাওয়া মেনে নেয়া যায়। ছাত্রদের ১০ দফার মধ্যে বুয়েটের ভিসির পদত্যাগের দাবি নেই। ভিসি নিজেও জানিয়েছেন, তিনি পদত্যাগ করবেন না। ফলে এ দাবিটি মুখ্য হচ্ছে না। যদিও বুয়েট অ্যালামনাই দাবি করেছে ভিসির পদত্যাগের।
নয়. যে ছাত্রের রুমে (শেরেবাংলা হল, রুম নং ২০১১) ফাহাদকে অত্যাচার করে হত্যা করা হয়, সেই রুমের বাসিন্দা ছাত্রলীগের (বুয়েট) উপ-আইন সম্পাদক। এ লেখা যখন লিখছি তখন পর্যন্ত তাকে মামলার এজাহারে যুক্ত করা হয়নি এবং ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কারও করা হয়নি। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠেছে। একজন নিরীহ ছাত্র যাতে হয়রানির স্বীকার না হন, এবং যে দোষী সেও যাতে মাফ না পায়, দুটি বিষয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিশ্চয়ই হত্যাকাণ্ডে তার সংশ্লিষ্টতা পুলিশ খতিয়ে দেখবে।
ফাহাদ হত্যাকাণ্ড আমাদের ছাত্র রাজনীতির জন্য একটি ‘ক্ষত’ সৃষ্টি করেছে। ছাত্র রাজনীতি আজ এ পর্যায়ে কেন এলো, তা ভেবে দেখা দরকার। সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের বেপরোয়া আচরণের আবারও প্রকাশ ঘটল, যখন ছাত্রলীগের ছেলেরা জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদকারী ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়েছে। এটা ভালো নয় এবং এতে করে ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে না। ছাত্রলীগের এ বেপরোয়া আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগ কিংবা মিছিল-মিটিংয়ে যোগ দিতে ছাত্রলীগের ছেলেরা সাধারণ ছাত্রদের বাধ্য করে। সাধারণ ছাত্রদের কোনো উপায় থাকে না, হলে থাকার স্বার্থেই তারা বাধ্য হয় মিটিং-মিছিলে যোগ দিতে। কিন্তু এতে করে ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা বাড়বে না। সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থে কাজ করলেই জনপ্রিয়তা বাড়বে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এ ব্যাপারে একটি কঠোর নিদের্শনা দিতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও প্রয়োজনে কিছু নির্দেশনা দিতে পারে। ছাত্রনেতারা টেন্ডারবাজি প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। খোঁজ নিলে জানা যাবে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের সিনিয়র নেতারা এ টেন্ডারবাজি করে ছাত্র অবস্থাতেই গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছে। এ ব্যাপারে শীর্ষ পর্যায় থেকে কঠোর নির্দেশনা থাকা উচিত।
একজন বাবা হিসেবে ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে আমি ব্যথিত। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি ক্ষমাপ্রার্থী- বুয়েটের শিক্ষকরা ফাহাদকে বাঁচাতে পারেননি। এতে ছাত্রদের যে ক্ষোভ ও দুঃখ, তাতে কোনো অন্যায় আমি দেখি না। তবে বুয়েটের একটা সম্মান আছে, মর্যাদা আছে। অপরাজনীতির কারণে দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি আরও নষ্ট হোক- আমরা তা কেউই চাইব না। ফাহাদ আর আমাদের মাঝে কোনোদিন ফিরে আসবেন না। কিন্তু তার ‘মৃত্যু’ যদি আমাদের কিছু ‘শিক্ষা’ দিয়ে যায়- সেটাই হবে আমাদের বড় পাওয়া
Daily Jugantor
12.10.2019
0 comments:
Post a Comment