
ভিসিদের ‘নানা কাহিনি’ থেকে যেন
আমরা বের হয়ে আসতে পারছি না। উপাচার্যদের নানা কাহিনি প্রায় প্রতিদিনই
সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে। গোপালগঞ্জ বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি আন্দোলনের মুখে
পদত্যাগ করেছেন সে খবর পুরনো। এখন আরেক ভিসি একটি বিতর্কিত মন্তব্য করে
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। তিনি জগন্নাথ
বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মীজানুর রহমান। তিনি বলেছেন, তাকে যুবলীগের
সভাপতি করা হলে তিনি উপাচার্য পদটি ছেড়ে দেবেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এটা
নিয়ে ঝড় বইছে।
সমালোচনার পাল্লাটা যেন একটু বেশিই। তার এই মন্তব্যের অনেকগুলো দিক আছে। এক. তিনি একটি রাজনৈতিক পদ চান এবং খুব লীগের মাঝে সংকট চলছে, তা থেকে তিনি সংগঠনটিকে বের করে আনতে চান। আমি এতে অবাক হইনি। কেননা উপাচার্য হবার পরও তিনি যুবলীগের প্রেসিডিয়ামের এক নম্বর সদস্য। তিনি সেখান থেকে পদত্যাগ করেননি। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি কুমিল্লা উত্তর থেকে কাউন্সিলর হয়েছিলেন। কাউন্সিলদের ট্যাগ লাগানো ছবি তিনি নিজের ফেসবুকে ‘আপলোড’ করেছিলেন। সুতরাং একজন ‘রাজনৈতিক ব্যক্তি’ একটি সংগঠনের দায়িত্ব নেবেন তাতে অবাক হবার কিছু নেই। তবে প্রশ্নটি নৈতিকতার। তিনি উপাচার্য হয়ে সরাসরি দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারেন কি না? এটা ঠিক রাজনৈতিক বিবেচনায় ও দলীয় আনুগত্যের প্রতি যারা ‘কমিটেড’, তারাই ভিসি হন এবং হয়ে আসছেন। তখন আর সিনিয়রিটি মানা হয় না। অনেকে ভিসি হয়েছেন, অধ্যাপক হিসেবে ‘সিলেকশন গ্রেড’ও পাননি। এবং কোনো কোনো ভিসি আবার একই সঙ্গে ‘এনজিও ব্যবসাও’ করেন। বিদেশ থেকে টাকা এনে এনজিও চালান, আবার সপ্তাহে দু’দিনের জন্য ভিসির দায়িত্ব পালন করেন। এ ক্ষেত্রে অধ্যাপক মীজানের দোষ কোথায়? তবে তিনি যদি প্রেসিডিয়ামের পদ থেকে পদত্যাগ করতেন, তাহলে তিনি ভালো করতেন। দুই. রাজনীতিতে ‘মেরিওটোক্র্যাসি’ দরকার। তিনি যুবলীগের চেয়ারম্যান হলে বরং ভালোই হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে চিনি। তিনি যোগ্য ব্যক্তি নিঃসন্দেহে। তবে যেহেতু এই মুহূর্তে বিতর্ক উঠেছে, সেহেতু তিনি ভিসি হিসেবে পদত্যাগ করে পূর্ণকালীন রাজনীতিতে নিজেকে জড়িত করুন। তাতে ভিসি পদের সম্মান বাড়বে। সম্প্রতি ১৪ জন ভিসির বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে ইউজিসি (জাগো নিউজ, ২২ সেপ্টেম্বর)। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কী দেখে এদের মানোন্নয়ন দিয়ে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়েছিল? এদের আয় সম্পত্তির হিসাব কি এনবিআর খতিয়ে দেখবে? যুবলীগ নেতাদের যদি আমলনামা নেওয়া হয়, যদি তাদের ব্যাংক হিসাব চাওয়া হয়, তাহলে অভিযুক্ত ভিসিদের ব্যাংক হিসাব চাওয়া হবে না কেন? দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে গেছেন প্রধানমন্ত্রী। কাউকে তিনি ছাড় দেবেন না। একজন প্রধানমন্ত্রী কত সাহসী হলে নিজ অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে র্যাবকে নির্দেশ দেন। অন্যায় আর দুর্নীতি, যারা যারা করবে তাদের কারও মাফ নেই। এই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সর্বত্র পরিচালিত হোক। যারা ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে, দলের নাম ভাঙিয়ে দিব্যি আরাম-আয়াসে দিন কাটাচ্ছে তাদেরও আনা হোক আইনের আওতায়। আওয়ামী লীগ এসব দুর্নীতিবাজদের ধারণ করতে পারে না। ব্যাংকার, ব্যাবসায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সবাই আজ অভিযোগের কাঠগড়ায়। ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে মালয়েশিয়ায় ‘দ্বিতীয় হোম’ বানাবেন, ঢাকার বাইরে প্রতিষ্ঠিত বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি হয়ে ঢাকায় বসে গার্মেন্টস ব্যবসা করবেন, এনজিও চালাবেন, সকালের ফ্লাইটে ক্যাম্পাসে গিয়ে বিকালের ফ্লাইটে ঢাকায় ফিরে আসবেনÑ এগুলোও অন্যায়। বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এ ধরনের অন্যায় করবেন, এটা সত্যিই দুঃখজনক। রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ দিলে, এরা এভাবেই পার পেয়ে যান। দুঃখ লাগে যখন দেখি দুয়েকটি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছাড়া অধিকাংশ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই উপাচার্যদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তেমন একটা সোচ্চার নন। শিক্ষকরা পদোন্নতির নীতিমালা নিয়ে যতটুকু সোচ্চার হয়েছেন, উপাচার্যদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারা তেমন সোচ্চার হননি। শিক্ষকরা জাতীয় আদর্শ। তারা যদি তাদের সহকর্মীদের (উপাচার্যরা তো তাদের সহকর্মীই) বিরুদ্ধে এখনই সোচ্চার না হন, তাহলে আগামীতে তারা আর কোনো সম্মান নিয়ে সমাজে বাস করতে পারবেন না। দেশে বিশ^বিদ্যালয়ের (পাবলিক) সংখ্যা এখন ৪৫টি। শিক্ষামন্ত্রী তার নিজ জেলা চাঁদপুরেও একটি বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছেন। মন্ত্রিসভায় তা অনুমোদিতও হয়েছে। আমার নিজের জেলা পিরোজপুরেও একটি বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন জেলার মন্ত্রী। এসব বিশ^বিদ্যালয় আদৌ শিক্ষার মান ধরে রাখতে পারবে কি না, এটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। তবে ভয়টা হচ্ছে বিশ^বিদ্যালয়ে নিয়োগ এবং নির্মাণ কাজে যে দুর্নীতি হয়, তা আমরা বন্ধ করব কীভাবে? বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে এখন শত কোটি নয়, হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে। সরকার এ ক্ষেত্রে উদার। সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। কিন্তু বিশ^বিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষক ও বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য হিসেবে আমি কিছু সুপারিশ রাখতে চাই, যা বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে দুর্নীতি কমাতে সাহায্য করবে। ১. রাজনৈতিক বিবেচনায় ও দলীয় কর্মকাণ্ডে যিনি সম্পৃক্ত তাদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ না দিয়ে নিরপেক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকদের মধ্যে থেকে উপাচার্য নিয়োগ। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি উপাচার্য প্যানেল তৈরি করবে। সেখান থেকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হবে। উপাচার্যরা হবেন শুধু এক টার্মের জন্য। ২. নিজ বিশ^বিদ্যালয় থেকে উপাচার্য নিয়োগের অলিখিত বিধান বদলাতে হবে। নিজ বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতি করেই শিক্ষকরা উপাচার্য হন। ফলে শিক্ষক রাজনীতি করতে গিয়ে তারা একটা ‘বলয়’ তৈরি করেন। আর ওই বলয়ের কারণেই উপাচার্য ‘বিশেষ গোষ্ঠীর’ কাছে ‘জিম্মি’ হয়ে যান এবং ওই সুবিধাভোগীদের স্বার্থে কাজ করেন। ৩. শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পিএসসির মতো একটি কমিশন গঠন করতে হবে। তিন পর্বের নিয়োগ প্রক্রিয়া সমর্থনযোগ্য। নিয়োগ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা বোর্ড গঠন করতে হবে। ওই বোর্ডে একাধিক বিশেষজ্ঞ থাকবেন। এই কমিশন ইউজিসির বাইরে কাজ করবে। অথবা ইউজিসির অংশ হিসেবে কাজ করতে পারে। ৪. বিশ^বিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ই-টেন্ডারে যেতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় কোনোভাবেই বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিনিধি থাকতে পারবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি থাকা মানেই হচ্ছে একটি স্বার্থান্বেষী গ্রুপের পক্ষ হয়ে কাজ করা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় থেকে আমরা কিছু শিখতে পারি। ৫. পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের কিছু কিছু শিক্ষক বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে, কোনো কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এবং টিভিতে ‘পূর্বকালীন’ কাজ করেন। পৃথিবীর কোথাও এমনটি চিন্তা করা যায় না। বিশ^বিদ্যালয় আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে তারা এ কাজটি করেন। জাবির উপাচার্য সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন বিশ^বিদ্যালয়ের একজন উপ-উপাচার্য বিশ^বিদ্যালয়ের গাড়ি ও জ্বালানি ব্যবহার করে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে ক্লাস নেন। এটা তিনি পারেন না। এটা নৈতিকতার প্রশ্ন। এটা তদন্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিশ^বিদ্যালয়গুলো এক ধরনের ‘সংকটের’ মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশ^বিদ্যালয়গুলোর অনিয়ম ও ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে সরকার একটি কমিশন গঠন করতে পারে, যারা সরকারকে সুপারিশ করবে। ইউজিসির পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রপতি সব বিশ^বিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। তিনি একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারেন। একজন সাবেক বিচারপতি এর নেতৃত্ব দেবেন। সাবেক উপাচার্য অথবা মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানরা এর সদস্য হতে পারেন। শিক্ষামন্ত্রীর একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে, তাতে তিনি সততা ও নৈতিকতা নিয়ে কাজ করার জন্য উপাচার্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। উপাচার্যদের বিরুদ্ধে এ ধরনের নানা অভিযোগে উপাচার্য নামক প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। ১৭ অক্টোবর ইউজিসির একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী তাদের কঠোরভাবে বিশ^বিদ্যালয়গুলো তদারকি করতে বলেন। সমস্যা হয়েছে এখানেই এই তদারকিটি হচ্ছে না। ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান ও কোনো কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। ফলে প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশ কতটুকু কার্যকরী হবে, সেটা নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই। অধ্যাপক মীজানের বক্তব্যটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বড় ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করলেও, এর একটি নেতিবাচক দিক আছে। তার ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ বিশ^বিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা তৈরি করতে পারে। দলীয়ভাবে বিশ^বিদ্যালয়গুলো যে পরিচালিত হচ্ছে, এ ধারণা আরও শক্তিশালী হবে। Daily Shomoyer Alo 27.10.2019 |
0 comments:
Post a Comment