সাম্প্রতিক সময়গুলোতে চীন-ভারত সম্পর্ক খুব ভালো যাচ্ছে না। বিভিন্ন ইস্যুতে দেশ দুটির মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। উপরন্তু চীন দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব বাড়াচ্ছে, এটা ভারতের স্ট্র্যাটেজিস্টদের জন্য চিন্তার কারণ। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে দুই ব্যক্তি এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেনÑ একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকর, অন্যজন নিরাপত্তা উপদেষ্টা দোভাল। মোদির খুব ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা তারা দুজন। ভারত যে তার ‘মনরো ডকট্রিনের’ ভারতীয় সংস্করণ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে জয়শংকর-দোভাল জুটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এই ডকট্রিনের মূল কথা হচ্ছে ভারত মহাসাগরে ভারত অন্য কোনো দেশের ‘কর্তৃত্ব’ সহ্য করবে না। ইঙ্গিতটা স্পষ্টত চীনের দিকে। চীন ভারত মহাসাগরে তার কর্তৃত্ব বাড়াচ্ছে। প্রায়ই এ অঞ্চলে চীনের সাবমেরিন চলাচল করে। চীন শ্রীলঙ্কার হামবানতোতায় যে গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ করেছে এবং বন্দরটি পরিচালনার ভার ৯৯ বছরের জন্য পেয়েছে, সেখানে সাম্প্রতিক সময়ে চীনা সাবমেরিন ডকিং করেছিল। এটা ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। পাকিস্তানের গাওদার ও মিয়ানমারের Kyaukphyu গভীর সমুদ্রবন্দরে চীনা সাবমেরিন ডকিং করতে পারে। এ চিন্তাও ভারতের আছে। ফলে চীন ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্কটি কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সে ব্যাপারে লক্ষ থাকবে অনেকের।
চীনের প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের আগে ও পরে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, যাতে ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা যে খুশি হবেন, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রথমত, চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পেইচিং সফর করেন এবং কাশ্মীর প্রশ্নে চীনের সমর্থন আদায় করতে তিনি সমর্থ হন। কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত যে নীতি অবলম্বন করেছে (কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল) এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে ‘জিহাদ’ ঘোষণা করেছে, চীন তাকে সমর্থন করছে এবং পাকিস্তানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে দেখা যায়, মামাল্লাপুরমে দুই নেতা কাশ্মীর প্রশ্নে কোনো কথা বলেননি। অথচ ভারতের রাজনীতি, বিশেষ করে মোদির রাজনীতির জন্য কাশ্মীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এ ক্ষেত্রে মোদি ব্যর্থ হলেন চীনের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে কাশ্মীর প্রশ্নে কোনো সমর্থন আদায় করতে।
দ্বিতীয়ত, চীনা প্রেসিডেন্ট ভারত সফর শেষ করে নেপাল সফরে যান এবং নেপালের সঙ্গে দুটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা যে চীন-নেপাল সম্পর্ককে ভালো চোখে দেখবেন, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। নেপালে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় তা ভারতকে চিন্তায় ফেলে দেবে। ভারতের ওপর অতীতে নেপালের নির্ভরশীলতা এবং এই ‘নির্ভরশীলতা’ ভারত তার নিজ স্বার্থ ব্যবহার করার কারণে নেপাল ধীরে ধীরে চীনের দিকে ঝুঁকছিল। ভারত অতীতে একাধিকবার নেপালে জ¦ালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় সেখানে সংকট তৈরি করেছিল। নেপালের বিপুল অর্থনৈতিক চাহিদা নেপালকে চীন-নেপাল অর্থনৈতিক করিডর গঠনে উৎসাহিত করেছিল। এই অর্থনৈতিক করিডরের আওতায় লাসা (তিব্বত)-খাসা ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন তৈরি করা হয়েছে। এর ফলে ভারতের ওপর থেকে নেপাল তার নির্ভরশীলতা অনেক কমাতে পারবে। আরেকটি পরিকল্পনা হচ্ছে চীনের কিনঝি ( Qinghi ) প্রদেশের গলমুদের ( Golmud ) সঙ্গে তিব্বতের লাসার রেল সংযোগ স্থাপন। এতে করে তিব্বতকে চীনের অর্থনীতির আওতায় আনা সম্ভব হবে। এতে নেপালও সুবিধা পাবে। চীন নেপালের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে সহায়তা করছে এবং দেশটিকে ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তাও দিয়েছে। নেপাল চীনের ওবিওআর ( OBOR ) মহাপরিকল্পনায়ও যোগ দিয়েছে। ভুটানেও চীনের প্রভাব পড়েছে। চীনের সঙ্গে ভুটানের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। সেখানে ভারতের প্রভাব বেশি। দোকলাম নিয়ে সীমান্ত সমস্যা (ভুটানের সঙ্গে) তা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে চীন। এটা ভারতের স্ট্র্যাটেজিস্টরা খুব ভালো চোখে নেবেন না। সুতরাং একটা প্রশ্ন থাকবেই ‘চেন্নাই কানেক্ট’ দুদেশের সম্পর্ক জোরদারে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখবে কি না? নাকি শুধুই একটি ‘ফটোসেশন’?
তৃতীয়ত, আরও বেশ কয়েকটি বিষয় রয়েছে, যেখানে দুদেশের অবস্থান পরস্পরবিরোধী। ভারত চীনের বিরুদ্ধে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলগুলোর সমন্বয়ে একটি সামরিক জোট গড়ে তুলছে, যা চীনা স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। ( QUAD ) এমন একটি জোট (জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া তার সঙ্গী), যা চীনের প্রতিপক্ষ হিসেবে এবং ভারতের পক্ষে আগামীতে কাজ করতে পারে। চীন জিবুতিতে তার প্রথম সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। ভারত মৌরিতুস ও সিসিলিজে নৌঘাঁটি স্থাপনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ভারত মালাবার ২০১৯ নৌ-সামুদ্রিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সঙ্গে। এ ধরনের মহড়া ভারত মহাসাগরে চীনের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। অরুণাচল প্রদেশ নিয়েও ভারত-চীন বৈরিতা লক্ষ করা যায়। অরুণাচল ভারতের একটি রাজ্য হলেও চীন এই রাজ্যের কর্তৃত্ব দাবি করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত মৈত্রী চীনের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করছে। ফলে চীন-ভারত যুদ্ধ কোনদিকে যায়, সেদিকে লক্ষ আছে অনেকের। বলতে দ্বিধা নেই, বেশ কিছু ইস্যুতে চীনের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্বের কোনো সমাধান হয়নি। ২০১৭ সালে দোকলাম ঘটনায় এই দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। যদিও পরে এই উত্তেজনা কিছুটা হ্রাস পায়। অরুণাচল প্রদেশের ওপর থেকে চীন তার দাবি পরিপূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেনি। কাশ্মীরের লাদাখ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে চীনের অবস্থান। ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের অন্যতম দাবিদার। কিন্তু চীনের এখানে আপত্তি রয়েছে। ভারত পারমাণবিক শক্তি ও পারমাণবিক সাপ্লায়ার্স গ্রুপের সদস্য হতে চায়। এখানেও আপত্তি চীনের। ভারত চীন-বাণিজ্য সাম্প্রতিককালে অনেক বেড়েছে, কিন্তু তা ভারতের প্রতিকূলে। অর্থাৎ চীন ভারতে রপ্তানি করে বেশি, ভারত থেকে আমদানি করে কম (চীন ভারতের রপ্তানি ১৬ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার আর চীন থেকে আমদানি ৬৮ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১৭)। দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান চীনের প্রশ্নে ভারতের জন্য চিন্তার কারণ। শ্রীলঙ্কায় (হামবানতোতা গভীর সমুদ্রবন্দরে চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতি) কিংবা মালদ্বীপে চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ভারত তার নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। এ কারণেই একজন বিশ্লেষক সুবীর ভৌমিক যখন লেখেন, ‘হাতি ও ড্রাগনের নাচ : শি-মোদি সম্মেলন কি শুধুই প্রদর্শনী (সাউথ এশিয়া মনিটর, অক্টোবর ১৫), তখন একটা প্রশ্ন থাকলই ‘চেন্নাই কানেক্ট’ আদৌ কোনো শুভ ফল বয়ে আনবে কি না? চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং মামাল্লাপুরম শীর্ষ সম্মেলনকে আখ্যায়িত করেছেন এভাবে ‘নতুন যুগ শুরু হলো দুদেশের সম্পর্কে’। তার এই বক্তব্যে আন্তরিকতার সুর আছে। কিন্তু ভারতে কট্টরপন্থিরা এখন ক্ষমতায়। তাদের ‘আগ্রাসী’ নীতি দুদেশের সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে কি না, সে প্রশ্ন থাকবেই। একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধিশালী দক্ষিণ এশিয়ার জন্য চীন ও ভারতের মধ্যে একটি আস্থাশীল সম্পর্ক বজায় থাকা অত্যন্ত জরুরি। না হলে যেকোনো বৈরিতা এ অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
Daily Desh Rupantor
21.10.2019
0 comments:
Post a Comment