সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বিশে^র উষ্ণতা
বৃদ্ধি নিয়ে একের পর এক সংবাদ ছাপা হচ্ছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। এই
সংবাদগুলো নিংসন্দেহে আমাদের জন্য চিন্তার কারণ। আর সংবাদগুলো ছাপা হচ্ছে
এমন এক সময় যখন সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে বিশ^ব্যাপী একটা ‘ক্লাইমেট
মার্চ’ হয়ে গেল। ১৬ বছর বয়সি সুইডেনের এক স্কুল শিক্ষার্থী গ্রেটা থানবার্গ
বিশ^ব্যাপী এই ক্লাইমেট মার্চের ডাক দিয়ে বিশ^ সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের তালিকায় ইতোমধ্যে তার নাম উঠে গেছে। বিশে^র উষ্ণতা
বৃদ্ধি যে পৃথিবী নামের গ্রহটির জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে, তা
আজ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। বিশে^র উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী করা হচ্ছে
জীবাশ্ম জ্বালানিকে। অতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলন ও এর ব্যবহারের
কারণেই বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেশি নির্গমন হচ্ছে, যাতে করে বাড়ছে
বিশে^র উষ্ণতা। তাই বিশ^ব্যাপী গাছ লাগানোর একটি উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে।
এর কারণ হচ্ছে গাছ কার্বন-ডাই-অক্সাইড ধরে রাখতে পারে। তাই বেশি বেশি করে
গাছ লাগালে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমন হবে কম।
বিশে^র
উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে সাগর মহাসাগরের পানি বৃদ্ধি পাবে, আর তাতে যেসব
সমুদ্রপারের দেশের ক্ষতি হবে, তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশে
আমরা কতটুকু সচেতনতা গড়ে তুলতে পেরেছি? সম্প্রতি কানাডার প্রধানমন্ত্রী
ট্রুডো জানিয়েছেন, দেশটি ২ বিলিয়ন গাছ লাগাবে। নরওয়ে গাছ কাটা নিষিদ্ধ
করেছে। একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে বিশে^র ২.২ বিলিয়ন একর জমিতে যদি
গাছ লাগানো যায়, তাহলে বিশে^ যে কার্বন নির্গমন হয়, তার তিন ভাগের দুই ভাগ
ধরে রাখতে পারবে। বিশে^ উষ্ণতা রোধ করার জন্য ২০১৫ সালে কপ-২১ চুক্তি
স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এ ব্যাপারে উদ্যোগটা কম।
বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলো আদৌ দায়ী
নয়। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে
উন্নয়নশীল বিশ্ব।
এতে করে বাড়ছে সাগর
মহাসাগরের জলরাশি। ডব্লিউএমও-এর সর্বশেষ রিপোর্টে ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা
হয়েছেÑ কার্বন নিঃসরণের মাত্রা অতীতের চেয়ে ২০১৫-১৯ সময়সীমায় ২০ শতাংশ হারে
বেড়েছে। ১৯৯৩ সাল থেকে যেখানে সাগরের জলসীমার উচ্চতা বেড়েছে গড়ে ৩.২
মিলিমিটার সেখানে ২০১৫-১৯ সময়সীমায় বেড়েছে ৫ মিলিমিটারের ওপর (এবিসি নিউজ
২২ সেপ্টেম্বর)। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে বারবার ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। দ্বীপাঞ্চলের
রাষ্ট্রগুলো আতঙ্কের মধ্যে আছে। এ ক্ষেত্রে বড় রাষ্ট্রগুলোর, বিশেষ করে
যুক্তরাষ্ট্রের যে দায়িত্ব পালন করার কথা; যুক্তরাষ্ট্র তা পালন করছে না।
তাতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ
সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করে। ব্যক্তি পর্যায়ে এর পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রে
৫.৩ গিগাটন, মধ্যপ্রাচ্যে ২.৭ গিগাটন, ইউরোপে ৪.৯ গিগাটন, চীনে ৯.৮ গিগাটন,
এশিয়া প্যাসিফিকে ৫.১ গিগাটন, ভারতে ২.৫ গিগাটন ইত্যাদি (বিশে^ গড় ৪.৬
গিগাটন, ২০১৭ সালের হিসাব)। বিকল্প জ্বালানির অভাব এবং না থাকার কারণে
যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ বেশিমাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল।
নিশ্চয়ই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটা উপলব্ধি করেন। তাই তিনি যখন কপ-২১ থেকে
যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন, তার বিবেচনায় এটা ছিল। তবে এটা ঠিক,
বিকল্প জ্বালানির উৎপাদন, গবেষণা ইত্যাদির দিকে তিনি নজর দিতে পারতেন।
এখন
যুক্তরাষ্ট্র কিংবা শিল্পোন্নত দেশগুলো উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে যে ক্ষতি হবে,
তা হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারবে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার সোলার বা বায়ু
এনার্জির প্রসার ঘাটিয়ে তারা এনার্জি চাহিদা পূরণ করতে পারবে। কিন্তু
বাংলাদেশসহ সাগরপারের দেশগুলো? অনেক দেশ এখন ঝুঁকির মধ্যে আছে। প্যারিস কপ
সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, উন্নত দেশগুলো পরিবেশ রক্ষায় উন্নয়নশীল,
বিশেষ করে সাগরপারের দেশগুলোকে সাহায্য করবে। কিন্তু তারা তাদের
প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি গত চার বছরেও। বলা ভালো, উন্নত বিশে^র নিয়ন্ত্রণে
রয়েছে বিশ^ জিডিপির ৭৫ শতাংশ আর তারা কার্বন নিংসরণ করে ৬৭.৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ এসব উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে
না। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে।
গত
২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি
বেড়ে যাওয়ায় দীপাঞ্চলের মানুষ ঢাকায় আসতে বাধ্য হচ্ছে। গবেষকরা বলছেন,
ভবিষ্যতে প্রতি ৭ জনে একজন মানুষ উদ্ধাস্তুতে পরিণত হবে। বাংলাদেশ
কোপেনহেগেন কপ সম্মেলন (২০০৯) এসব উদ্ধাস্ত মানুষকে ইউনিভার্সাল ন্যাচারাল
পারসন হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু এ দাবি গ্রহণযোগ্য হয়নি।
বাংলাদেশ জাতিসংঘে এ দাবি আবারও উত্থাপন করেছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত
সমস্যা মোকাবেলায় যে বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা
নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম
অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে এই উষ্ণতা
বৃদ্ধির বিষয়টিও। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে বিশে^র উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ে তার
উৎকণ্ঠার কথা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ অর্থায়নের ওপর
বেশি গুরুত্ব দিলেও, অভ্যন্তরীণভাবে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে
কম। প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেককে তিনটি করে গাছ লাগানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু এ
ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগটা কম। বন অধিদফতরের কোনো উদ্যোগও আমার চোখে
পড়ছে না। পরিবেশ মন্ত্রণালয় একটি সমন্বিত পরিকল্পনার আওতায় দেশের সব
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের একটি কাজে জড়িত হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারত। কিন্তু
পরিবেশ কিংবা বন মন্ত্রণালয়, কারও কোনো উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
উষ্ণতা রোধকল্পে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে স্কুল শিক্ষার্থীরাসহ সবাই এক দিনে ২২ কোটি গাছ লাগিয়েছে। অর্থাৎ উত্তর প্রদেশের মোট বাসিন্দা ২২ কোটি। সবাই একটি করে গাছ লাগিয়েছে ১৪,৩০,৩৮১টি জায়গায়, যার মাঝে আছে ৬০ হাজার গ্রাম, আর ৮৩ হাজার জঙ্গলের চিহ্নিত এলাকা। এই তথ্যটি দিয়েছেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যানাথ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
সবাইকে ৩টি করে গাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বিশ^
অর্থনৈতিক ফোরামের বৈঠকে উল্লেখ করেছিলেনÑ জলবায়ু পরিবর্তন একটি নিরাপত্তা
ঝুঁকি। এখনই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শেখ হাসিনা সম্মেলনে বলেছিলেন, Climate change is a security threat. We must act now. The time to act on climate changes, even slightly, I invite you to visit Bangladesh. I am ready to walk with you to show how climate change silently impacts the lives of million ( WEFORUM.ORG, 26 March 2019)। সুতরাং গাছের প্রয়োজনীয়তা যে
কতটুকু তা যদি প্রধানমন্ত্রী অনুধাবন করে থাকতে পারেন, তাহলে
পরিবেশমন্ত্রী, বনমন্ত্রী কিংবা অতি ক্ষমতাধর আমলারা তা অনুধাবন করছেন না
কেন? পরিবেশ মন্ত্রণালয় না অধিদফতরের কর্তাব্যক্তিরা বিদেশ সফর পছন্দ করেন।
কপ সম্মেলনে তারা যান বারবার।
Daily Shomoyer Alo
06.10.2019
|
সংবাদগুলো আমাদের কোনো বার্তা দেয় কি না
19:10
No comments
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment