রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

চীন-নেপাল সম্পর্ক ও ভারতের পররাষ্ট্রনীতি

Image result for chinese president's visit to Nepal


ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পররাষ্ট্রনীতির একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ পলিসি। অর্থাৎ তার পররাষ্ট্রনীতিতে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে তিনি অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন। এটা যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তা হলে দেখা যাবে বৈশ্বিক রাজনীতিতে তিনি বরাবরই পার্শ¦বর্তী দেশগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। এ তালিকায় চীন-ভারত সম্পর্কও আছে। কিন্তু গত ১৩ অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের নেপাল সফর ও নেপালের সঙ্গে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর স্পষ্টতই নরেন্দ্র মোদির ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ পলিসির ক্ষেত্রে এটা একটা ‘চপেটাঘাত’ হিসেবে চিহ্নিত হবে। কেননা ট্রেডিশনালি নেপালের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব অনেক বেশি। নেপালের রাজনীতি, অর্থনীতি বেশি মাত্রায় ভারতনির্ভর। কিন্তু এখন নেপাল বেশি মাত্রায় চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ায় নেপাল ভারতের ‘প্রভাব বলয় বিস্তারের’ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এলো কিনা, সেটাই দেখার বিষয়।
সাম্প্রতিক সময়গুলোয় দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতের নীতিনির্ধারকদের জন্য এটা একটা চিন্তার কারণ। চীন তার বহুল আলোচিত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ মহাপরিকল্পনার আওতায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় নরেন্দ্র মোদি চীনের প্রভাবকে খর্ব করতে তার ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’Ñ ‘প্রতিবেশীরাই প্রথম’ এই নীতি গ্রহণ করেছিলেন। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, নরেন্দ্র মোদি তার ২০১৫ সালে ঢাকা সফরের সময় বিবিআইএন (বাংলাদেশ-ভুটান-ইন্ডিয়া-নেপাল) নামে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু চীনের প্রসিডেন্ট শি জিনপিং নেপালকে গুরুত্ব দেওয়ায় নরেন্দ্র মোদির নীতি কিছুটা দুর্বল হতে বাধ্য। নেপালের চীনের প্রতি ঝুঁকে যাওয়ার কারণও আছে। ভারতের ওপর নেপালের ‘নির্ভরশীলতা’ এবং এই ‘নির্ভরশীলতা’ অতীতে ভারত তার নিজ স্বার্থে ব্যবহার করায় নেপালের বর্তমান বাম সরকার ধীরে ধীরে চীনের দিকে ঝুঁকছিল। ভারত অতীতে একাধিকবার নেপালে জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় সেখানে সংকট তৈরি করেছিল। নেপালের বিপুল অর্থনৈতিক চাহিদা নেপালকে চীন-নেপাল অর্থনৈতিক করিডর গঠনে উৎসাহিত করেছিল। এই অর্থনৈতিক করিডরের আওতায় লাসা (তিব্বত)-খাসা ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন তৈরি করা হয়েছে। এর ফলে ভারতের ওপর থেকে নেপাল তার নির্ভরশীলতা অনেক কমাতে পারবে। আরেকটি পরিকল্পনা হচ্ছে চীনের কিনঘি (ছরহমযর) প্রদেশের গলমুদের (এড়ষসঁফ) সঙ্গে তিব্বতের লাসার রেল সংযোগ স্থাপন। এতে করে তিব্বতকে চীনের অর্থনীতির আওতায় আনা সম্ভব হবে। এতে নেপালও সুবিধা পাবে। চীন নেপালের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে সহায়তা করছে এবং দেশটিকে ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তাও দিয়েছে। নেপাল চীনের ওবিওআর (ঙইঙজ) মহাপরিকল্পনায়ও যোগ দিয়েছে। ভুটানেও চীনের প্রভাব পড়ছে। চীনের সঙ্গে ভুটানের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। সেখানে ভারতের প্রভাব বেশি। দোকলাম নিয়ে সীমান্ত সমস্যা (ভুটানের সঙ্গে) তা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে চীন। এটা ভারতের স্ট্র্যাটেজিস্টরা খুব ভালো চোখে নেবে না। তাই একটা প্রশ্ন থাকবেই শি জিনপিংয়ের ভারত সফরের পর দুই দেশের সম্পর্ক জোরদারে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখবে কিনা? নাকি শুধুই একটি ‘ফটোসেশন’ হয়েছে মামাল্লাাপুরমে? প্রেসিডেন্ট শি নেপালে যাওয়ার আগে ভারতে গিয়েছিলেন।
আরও বেশ কয়েকটি বিষয় রয়েছে, যেখানে চীন ও ভারতের অবস্থান পরস্পরবিরোধী। ভারত চীনের বিরুদ্ধে ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি সামরিক জোটে যোগ দিয়েছে, যা চীনা স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। ছটঅউ এমন একটি জোট (জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া তার সঙ্গী), যা চীনের প্রতিপক্ষ হিসেবে এবং ভারতের পক্ষে আগামীতে কাজ করতে পারে। চীন জিবুতিতে তার প্রথম সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। ভারত মৌরিতুস ও সিসিলিজে নৌঘাঁটি স্থাপনের পক্ষে এগিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ভারত মালাবার ২০১৯ নৌ-সামুদ্রিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সঙ্গে। এ ধরনের মহড়া ভারত মহাসাগরে চীনের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। অরুণাচল প্রদেশ নিয়েও ভারত-চীন বৈরিতা লক্ষ করা যায়। অরুণাচল ভারতের একটি রাজ্য হলেও চীন এই রাজ্যের কর্তৃত্ব দাবি করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত মৈত্রীও চীনের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করছে। ফলে চীন-ভারত দ্বন্দ্ব কোন দিকে যায়, সেদিকে লক্ষ আছে অনেকের। বলতে দ্বিধা নেই, বেশ কিছু ইস্যুতে চীনের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্বের কোনো সমাধান হয়নি। ২০১৭ সালের দোকলাম ঘটনায় ওই দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। যদিও পরবর্তী সময়ে এই উত্তেজনা কিছুটা হ্রাস পায়। অরুণাচল প্রদেশের ওপর থেকে চীন তার দাবি পরিপূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেনি। কাশ্মীরের লাদাল নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে চীনের অবস্থান। ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদের অন্যতম দাবিদার। কিন্তু চীনের এখানে আপত্তি রয়েছে। ভারত পারমাণবিক শক্তি ও পারমাণবিক সাপ্লায়ার্স গ্রুপের সদস্য হতে চায়। এখানেও আপত্তি চীনের। ভারত-চীন বাণিজ্য সাম্প্রতিককালে অনেক বেড়েছে, কিন্তু তা ভারতের প্রতিকূলে। অর্থাৎ চীন ভারতে রপ্তানি করে বেশি, ভারত থেকে আমদানি করে কম (চীনে ভারতের রপ্তানি ১৬ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন ডলার, আর চীন থেকে আমদানি ৬৮ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১৭)। দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান চীনের প্রভাব ভারতের জন্য চিন্তার কারণ। শ্রীলংকায় (হাসবানতোতা গভীর সমুদ্রবন্দরে চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতি) কিংবা মালদ্বীপে চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ভারত তার নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। এ কারণেই একজন বিশ্লেষক সুধীর ভৌমিক লিখেছেন (হাতি ও ড্রাগনের নাচ : শি-মোদি সম্মেলন কি শুধুই প্রদর্শনী, সাউথ এশিয়া মনিটর, অক্টোবর ১৫), যে, ‘শি সন্ত্রাস নিয়ে ভারতের উদ্বেগের সঙ্গে একমত হওয়ায় এবং কাশ্মীর ইস্যুকে সেভাবে উপস্থাপন না করায় মোদি ও তার টিম এটা নিয়ে খুশি হয়েছে।’ সুধীর ভৌমিক বিবিসির বাংলা বিভাগের সাবেক সাংবাদিক এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির ব্যাপারে যথেষ্ট অভিজ্ঞ। সুধীর ভৌমিক আরও লিখেছেনÑ ‘দুই শীর্ষ নেতা সম্পর্কের নেতিবাচক দিকগুলোকে চাপা দিয়ে এটাকে আবার স্বাভাবিক গতিতে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছেন।’ এটি একটি ইতিবাচক মন্তব্য। কিন্তু এশিয়ার এই দুটি বড় দেশের মধ্যকার সম্পর্ক আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা তথা ভারত মহাসাগরের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৭ সালে চীনের উহানে দুই নেতা অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় মিলিত হয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় মামাল্লাপুরমে (তামিলনাড়–) দ্বিতীয় অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হলো। আগামী বছর হবে চীনে পরবর্তী আলোচনা। ফলে দেশ দুটি নিজেদের মধ্যকার বিরোধ কিংবা এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব বৃদ্ধিতে ভারতের যে আশঙ্কা, তা কতটুকু কমিয়ে আনতে পারবে, সেটাই দেখার বিষয়। যারা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেন তাদের কাছে ঈযরহফরধ শব্দটি অপরিচিত নয়। চীন ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক বোঝাতে এ শব্দটি অনেক বিশ্লেষক ব্যবহার করেন। ভারত ও চীন বিশ্বের দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির দুটি দেশ। এদের মধ্যকার সম্পর্ক ও বৈরিতা আগামী দিনের বিশ্ব রাজনীতির দিকনিদের্শনা দেবে। বিশ্লেষকরা লক্ষ করেছেন, এ দেশ দুটি যদি ন্যূনতম ইস্যুতে এক হয়, তা হলে শুধু এ অঞ্চলই নয়, বরং বিশ্বের রাজনৈতিক দৃশ্যপটও বদলে যাবে। অংরধহ পড়হঃঁৎু-র যে কথা বলা হচ্ছে, তা বিকশিত হবে এই দেশ দুটির মধ্যকার সম্পর্কের ওপর। ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) দেশ দুটির মোট জিডিপি ৩৫ দশমিক ৬২৪ ট্রিলিয়ন ডলার। আর সাধারণ নিয়মে এর পরিমাণ ১৬ দশমিক ১৫ ট্রিলিয়ন ডলার। দুটি দেশ নিয়ে আয়তন হচ্ছে ১ কোটি ২৯ লাখ ২৮ হাজার ৬১ বর্গকিলোমিটার। চিন্তা করা যায়, কী বিশাল এলাকা নিয়ে দেশ দুটি বিশ্ব মানচিত্রে অবস্থান করছে। প্রায় একই সময় দেশ দুটি স্বাধীন হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিগত ৭০ বছরে চীন তার সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কারণে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে পেরেছে। কিন্তু ভারত তা পারেনি। ভারতের দারিদ্র্য প্রবল। অতীতে দেশ দুটির মধ্যে অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল। পঞ্চাশের দশকে ‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই’ সেøাগান উন্নয়নশীল বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। অর্থাৎ এই দেশ দুটির মধ্যকার সম্পর্ক যে উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য একটি ‘মডেল’ হতে পারে, তা তারা প্রমাণও করেছিলেন। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন কিংবা ‘পঞ্চশীলা’ মুভমেন্টে (যা ন্যামের জন্ম দিয়েছিল) জড়িত থেকে ঈযরহফরধ ধারণা বিশ্বে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এই সম্পর্ক আর টিকে থাকেনি। ১৯৬২ সালে দেশ দুটি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। একটা আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস দেশ দুটোর মাঝে আছে।
এখন এই অক্টোবরেই শি জিনপিং ভারত সফর করলেন। এর পর নেপালে গেলেন। একজন চীনা প্রেসিডেন্ট ১৯৯৬ সালের পর এই প্রথম নেপাল সফর করলেন। একাধিক চুক্তি স্বাক্ষর করলেন। নেপাল-চীন সম্পর্ক চীনের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনই নেপালের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এখন দেখার পালা চীন-নেপাল সম্পর্ককে ভারত কীভাবে দেখে? ভারত যদি এটাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে, তা হলে তা নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে আরও উন্নত করবে। এতে ভারতের লাভ। কিন্তু মালদ্বীপের পরিস্থিতি প্রমাণ করে, এ অঞ্চলে চীনের অব্যাহত প্রভাবের ব্যাপারে ভারত সন্দিহান।
Daily Amader Somoy
28.10.2019

0 comments:

Post a Comment