রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ভারতীয় নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক কার্ড



অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গিয়ে এবারের ভারতের লোকসভা নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক কার্ডটি ব্যবহৃত হচ্ছে। নির্বাচনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বিজেপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র মোদি, কিংবা বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা মুসলমান তথা বাংলাদেশ বিরোধী বক্তব্য দিয়ে আবার ভারতের মতো একটি বড় গণতান্ত্রিক দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু করেছেন। তাদের এই বক্তব্য খোদ ভারতেই, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বাংলা ভাষাভাষীদের বাংলাদেশি হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো কিংবা খুলনা থেকে সিলেট পর্যন্ত জমি ফেরত চাওয়া (সুব্রামানিয়াম স্বামী)- বিজেপি নেতাদের এই বক্তব্য 'দাঙ্গা লাগানোর ফন্দি' হিসেবেই অভিহিত করেছেন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। মমতা মোদিকে এটা স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেননি যে তিনি নিজেও বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। এটা স্পষ্ট যে মোদি 'হিন্দুত্ব' কার্ডটি ব্যবহার করছেন শুধু ভোট পাওয়ার আশায়। ইতোমধ্যে শিক্ষক হিন্দু পরিষদের নেতা প্রবীণ তোগাড়িয়ার বিরুদ্ধে এফআইআর (ঋওজ) দায়ের করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তোগাড়িয়া হিন্দু এলাকায় মুসলমানদের হিন্দু সম্পত্তি ক্রয় না করার হুমকি দিয়েছিলেন। সবকিছু মিলিয়ে বিজেপির এ সাম্প্রদায়িক কার্ড দলটির জনপ্রিয়তা খুব একটা বাড়াতে পারেনি। ৫৪৩ আসনে সরকার গঠনের জন্য সরকার ২৭২টি আসন বিজেপি বা এনডিএ জোট তা পাচ্ছে না। তবে নিঃসন্দেহে বিজেপি জোট লোকসভায় অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। একমাত্র আঞ্চলিক দলগুলো যদি বিজেপিকে সমর্থন করে, তাহলেই বিজেপির পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব। তবে এটা সত্য, বিজেপি তার নির্বাচনী ইশতেহারে বাবরী মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণ ও কাশ্মীরকে দেয়া সংবিধানে বিশেষ অধিকার খর্ব করার ঘোষণা করায় ভারতে মুসলমানরা এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে আছেন। ভারতে ১৮ কোটি মুসলমানের বাস। পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশ সর্বত্র মুসলমানরা মূল রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়। এখন স্বয়ং মোদির সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা তাদের এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেবে।
স্মরণ করা যেতে পারে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর হিন্দু উগ্রবাদীরা ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। উগ্রবাদী হিন্দুরা সেখানে তাদের কল্পিত দেবতা রামের মন্দির নির্মাণ করতে চায়। বাবরি মসজিদ ভেঙে দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতে দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন সহস্রাধিক ব্যক্তি। এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল সারা মুসলিম বিশ্বে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে এর প্রতিবাদে হরতাল হয়েছিল। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার বাবরি মসজিদ পুনর্নির্মাণের দাবি জানিয়ে এ ধরনের ঘটনাকে মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। ভারতব্যাপী এর যে প্রতিবাদ হয়েছিল, তাতে ভারত সরকার তখন আরএসএস, ভজরং, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ইসলামী সেবক সংঘ ও জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তখন ভারতে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নরসীমা রাও। তিনি বাবরি মসজিদ রক্ষা করতে পারেননি। মথুরার ঈদগা মসজিদ নিয়েও হিন্দুরা আদালতে মামলা ঠুকেছিল। আজ বিজেপি আবার রামমন্দির নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এতদিন সেখানে যে স্থিতিশীলতা বজায় ছিল, তা একটি ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিল। কাশ্মীরের প্রসঙ্গ তুলে অযথাই বিজেপি বিতর্ক সৃষ্টি করল। অনেকে মনে করতে পারেন ভারত সংযুক্তির সময় কাশ্মীরিদের একটি স্বতন্ত্র সত্তার মর্যাদা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রস্তাব কখনই কার্যকর হয়নি। ধীরে ধীরে সংবিধানের সেই ধারা (ধারা ৩৭০) সংশোধন করা হয়েছিল। এখন বিজেপি এ ধারাটিও তুলে দিতে চায়।
বিজেপির ইশতেহারে যেসব উগ্রবাদী কথাবার্তা বলা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের কাছে আপত্তি জানিয়েছে কংগ্রেস। কংগ্রেস অভিযোগ করেছে যে বিজেপি ধর্মকে ব্যবহার করছে। তারা এটা বলেছে, বিজেপি ধর্মকে ব্যবহার করে ভোট চেয়েছে, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সাংবিধানিক চরিত্রের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপি নেতাদের 'হিন্দু কার্ড' ব্যবহার করা, কিংবা বাংলাদেশ বিরোধী দু'একটি বক্তব্য বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে অনেকে ভাবতে শুরু করেছেন। একটি বিজেপি জোট যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে এ সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নত হয়, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে ইতোমধ্যে। কেননা বেশকিছু ইস্যুতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আটকে আছে। তিস্তার পানিচুক্তি ও সীমান্তচুক্তির ব্যাপারে বিজেপির অবস্থান আমরা মোটামুটি জানি। চূড়ান্ত বিচারে নরেন্দ্র মোদিকে যদি মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে সরকার গঠনের প্রশ্নে কোনো 'কমপ্রোমাইজ' করতে হয়, তাহলে মোদি মমতার সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবেন না। এতে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি চলে যাবে 'ডিপ ফ্রিজে'। আন্তঃনদী সংযোগের কথাও তিনি বলেছেন। সীমান্তচুক্তির ব্যাপারেও বিজেপির প্রচ- আপত্তি রয়েছে। বিজেপির বিরোধিতার কারণেই কংগ্রেস সরকারের সময় চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। চুক্তিটি ভারতীয় মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছিল। একটি বিল লোকসভায় উপস্থাপিতও হয়েছিল। কিন্তু বিজেপির আপত্তির কারণে এটা নিয়ে আর আলোচনা হয়নি। তখন বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে, এটা আমার মনে হয় না। এর বাইরে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং ট্রানজিট প্রশ্নে দু'দেশের মধ্যে আস্থার যে ঘাটতি রয়েছে, সে ব্যাপারে নয়া সরকার কোনো উদ্যোগ নেবে বলে মনে হয় না। আমাদের পররাষ্ট্র সচিব মার্চের শেষের দিকে নয়া দিলি্ল গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। নির্বাচনের আগে আমাদের পররাষ্ট্র সচিব যখন নয়া দিলি্ল যান, তখন বুঝতে হবে বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতি যাচাই করছে। স্পষ্টই তিনি কোনো সুখবর নিয়ে আসতে পারেননি। এটা মোটামুটিভাবে আমরা সবাই জানি কংগ্রেসের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ বেশকিছু চুক্তি করেছে। ভারত গেল পাঁচ বছর বাংলাদেশের কাছ থেকে বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সে অর্থে তেমন সুবিধা পায়নি। তখন নয়া দিলি্লতে সম্ভাব্য একটি মোদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের 'সম্পর্ক' কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়_ তা দেখার বিষয়। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট করেই বলা যায় জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ভারতের নীতির পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না। ইতোমধ্যে খবর বের হয়েছে যে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করিডোর পেতে যাচ্ছে ভারত। অরুণাচল থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুরের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ যাবে বিহারে। একই সঙ্গে চলতি বছরেই বহুল বিতর্কিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করবে ভারত। প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। সুতরাং সম্ভাব্য একটি মোদি সরকার এসব প্রকল্প বাতিল করবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ এখন তার স্বার্থ আদায়ে কতটুকু উদ্যোগ নেয়, সেটাই দেখার বিষয়। তবে চূড়ান্ত বিচারে মোদি ক্ষমতা পেলেও, অনেক কিছুই তার পক্ষে করা সম্ভব হবে না। কেননা সরকার গঠন করতে হলে তাকে আঞ্চলিক দলগুলোর সহযোগিতা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক দলগুলো এক ধরনের 'চেকস অ্যান্ড ব্যালান্স' হিসেবে কাজ করবে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে অনেক কথা বলতে হয়। বিজেপিও বলেছে। ভারত একটি বিশ্বশক্তি হতে চলেছে। ২০৩০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অবস্থান হবে দ্বিতীয়। ভারত জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদের সদস্য হতে চায়।
ভারতের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিশ্বের জন্যই একটি মডেল। সুতরাং নরেন্দ্র মোদি ইচ্ছা করলেও অনেক কিছু করতে পারবেন না। তাই ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে, বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ব্যাপারে ভারতের মনোভাবের পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। নানা কারণে মোদি ম্যাজিক ভারতব্যাপী একটি ঢেউ তুলেছে। এই ঢেউ শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদিকে নয়া দিলি্লর ৭ নাম্বার রেসকোর্স রোডে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত বাসভবনে নিয়ে যায় কিনা, তাই দেখার বিষয় আমাদের। কিন্তু বিজেপির সাম্প্রদায়িক কার্ড আমাদের জন্য নতুন করে একটা শঙ্কা তৈরি করল।
গত প্রায় ১৫-১৬ বছর আমরা পুশব্যাকের ঘটনার সঙ্গে পরিচিত নই। অর্থাৎ তথাকথিত বাংলা ভাষীদের বাংলাদেশে পুশব্যাক করার ঘটনা ঘটেনি। এখন নয়া দিলি্লতে একটি নয়া সরকার দায়িত্ব নিলে এ পুশব্যাকের প্রবণতা বাড়তে পারে। সুতরাং বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
ভারতের নির্বাচন প্রক্রিয়া এখন শেষ পর্যায়ে চলছে। সর্বশেষ আজ (১২ মে) শেষ দফার নির্বাচন। আজ উত্তরপ্রদেশে ভোটগ্রহণ হবে। লোকসভা নির্বাচনের জন্য উত্তরপ্রদেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর। এখানে ৮০টি আসন। নরেন্দ্র মোদি এ উত্তরপ্রদেশের বারানসিতে প্রথমবারের মতো প্রার্থী হয়েছেন। বোঝাই যায় হিন্দু মন্দির আর ধর্মীয় স্থানে তার প্রার্থী হওয়ার অর্থ তিনি 'হিন্দু কার্ড' তার স্বার্থে ব্যবহার করতে চান। যদিও ধারণা করা হচ্ছে তার আসনে আম আদমি নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল প্রার্থী হওয়ায় তার বিজয় তত সহজ হবে না। গেল নির্বাচনে বিজেপি উত্তরপ্রদেশে মাত্র ১১টি আসন পেয়েছিল। ১৬ মে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হবে। তখনই বোঝা যাবে কে সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন সেখানে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে 'সাম্প্রদায়িক কার্ড' ভোটারদের কতটুকু প্রভাবিত করতে পারবে, তাই দেখার বিষয়। 

0 comments:

Post a Comment