ইউক্রেন সংকটকে কোনো কোনো পর্যবেক্ষক স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে এক 'ধরনের' প্রক্সিওয়ার' হিসেবে অভিহিত করেছেন। ক্রিমিয়ায় গণভোট (১৬ মার্চ) কিংবা রাশিয়ার সঙ্গে ক্রিমিয়ার সংযুক্তির পর ধারণা করা হয়েছিল, ইউক্রেন সংকটের সাময়িক অবসান হয়েছে। কিন্তু ইউক্রেনের পূর্ব সীমান্তে একই ঘটনা ঘটল। রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পূর্বাঞ্চলের বেশ ক'টি শহর দখল করে নিয়েছিল। এরপর বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। ইউক্রেনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উৎখাতের জন্য সেখানে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়া সীমান্তে হাজার হাজার সেনাবাহিনী পাঠিয়েছে ও সীমান্তে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শুরু করেছে। আর যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর নিরাপত্তার স্বার্থে পোল্যান্ড ও বাল্টিক দেশগুলোতে ৬০০ সেনা পাঠিয়েছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে আগামী ২৫ মে ইউক্রেনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
ইউক্রেনের পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিল হচ্ছে। নতুন করে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছে, যাকে অভিহিত করা হয়েছে স্নায়ুযুদ্ধ-২ হিসেবে। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে এই অঞ্চলে এক ধরনের উত্তেজনার জন্ম হয়েছে। বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণ, বিশেষ করে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে ন্যাটোর সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত এবং রাশিয়াকে ঘিরে ফেলার সুদূরপ্রসারী মার্কিন চক্রান্তের কারণে এ অঞ্চলে উত্তেজনার জন্ম হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই চাচ্ছে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ জর্জিয়া ও ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিক। ২০০৮ সালে রাশিয়ার সঙ্গে জর্জিয়ার সীমিত যুদ্ধের (ওসেটিয়া প্রশ্নে) কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। 'ব্লাক সি'র অপর পাশের দেশগুলো (বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড, রুমানিয়া) ইতিমধ্যে ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে। তুরস্ক ও গ্রিস আগে থেকেই ন্যাটোর সদস্য। জর্জিয়া ও ইউক্রেন এখনও ন্যাটোর সদস্য নয়। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, ইউক্রেন সংকটের জন্ম হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচের উৎখাতের মধ্য দিয়ে। গণঅভ্যুত্থানে তিনি উৎখাত হলেও অভিযোগ আছে, তার উৎখাতের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছিল। রুশপন্থি এই নেতা ২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। তারপর ঘটল ক্রিমিয়ার ঘটনা। ক্রিমিয়ার ঘটনায় রাশিয়াকে জি-৮ থেকে বহিষ্কার ও দেশটির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু যে প্রশ্নের সমাধান এখনও হয়নি, তা হচ্ছে রাশিয়াকে বয়কট করে পশ্চিম ইউরোপ রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা কাটাবে কীভাবে? সেনাবাহিনী পাঠিয়ে, ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে বটে, কিন্তু পুরো ইউরোপের জ্বালানি নিরাপত্তা যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত করবে কীভাবে? কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি গ্যাস আমদানি করার। কিন্তু বাস্তবতা কি তা বলে? পাঠক মাত্রেই জানেন, পশ্চিম ইউরোপ থেকে শুরু করে সমগ্র পূর্ব ইউরোপ, যে দেশগুলো এক সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক প্রভাবে ছিল, তারা এখন স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও তারা পরিপূর্ণভাবে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্যাসের রিজার্ভ হচ্ছে রাশিয়ায়। মূলত তিনটি পথে এই গ্যাস যায় ইউরোপে। সাবেক পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো, যারা এক সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্লকে ছিল, তারাও এখন জ্বালানি খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি। তিনটি পাইপলাইন, নর্ড স্টিম পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয় বছরে ৫৫ বিলিয়ন কিউসেক মিটার (বিসিএম), বেলারুশ লাইনে সরবরাহ করা হয় ৩৬ বিসিএম, আর ইউক্রেন লাইনে সরবরাহ করা হয় ১০৭ বিসিএম। এখন ইইউর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে রাশিয়া যদি এই সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে এক বড় ধরনের জ্বালানি সংকটে পড়বে ইউরোপ। যদিও রাশিয়ার বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে এই গ্যাস বিক্রি। এটা সত্য, রাশিয়া অত্যন্ত সস্তায় বেলারুশ ও ইউক্রেনে গ্যাস সরবরাহ করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই দেশ দুটি আবার রাশিয়ার গ্যাসের রিজার্ভ গড়ে তুলে সরাসরি পশ্চিম ইউরোপে তা বিক্রি করে কিছু আলাদা অর্থ আয় করে। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, ২০০৯ সালে ইউক্রেন ও বেলারুশের সঙ্গে রাশিয়ার এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছিল, যাকে বলা হয়েছিল 'গ্যাসওয়ার' অর্থাৎ গ্যাসযুদ্ধ। ইউক্রেনে অত্যন্ত সহজ মূল্যে গ্যাস সরবরাহ করত রাশিয়া। কিন্তু ইউক্রেন অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল, যা ইউরোপে একটি সংকট তৈরি করে। শুধু গ্যাস নয়, রাশিয়া বেলারুশকে সস্তা দামে তেলও দেয়। ওই তেল আবার বেলারুশ অধিক মূল্যে ইউরোপে বিক্রি করে। Druzhba অথবা Friendship পাইপলাইনের মাধ্যমে এই গ্যাস ও তেল সরবরাহ করা হতো।
বেলারুশের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা হয়েছিল। তারা অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল। রাশিয়া পাইপলাইনে গ্যাস ও তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। এখন আবার নতুন আঙ্গিকে এই গ্যাসওয়ার শুরু হওয়ার একটি সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ সংস্থা 'গ্রাসপ্রোম' ইউক্রেনের কাছে পাবে ২ বিলিয়ন ডলার। এই টাকা ইউক্রেন পরিশোধ করতে পারছে না। অন্যদিকে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের নামে আইএমএফের কাছ থেকে যে বিলিয়ন ডলার অর্থ পাওয়ার কথা ছিল, তাতে সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে রাশিয়া যদি ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে এক মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে সমগ্র ইউরোপে (সমগ্র ইইউর গ্যাসের চাহিদার ৩০ ভাগ জোগান দেয় রাশিয়া। আর জার্মানির দেয় ৪০ ভাগ)। স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের ২২ বছর পর নতুন করে আবার দুই পরাশক্তি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। রাশিয়া চায় এ অঞ্চলের ওপর তার যে পরোক্ষ প্রভাব তা বজায় রাখতে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে রাশিয়ার এই প্রভাব কমাতে। ফলে নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে। নতুন করে একটি প্রশ্ন উঠেছে, রাশিয়াকে বাদ দিয়ে ইউরোপের নিরাপত্তা অর্থহীন। রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়েই ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এটা বিবেচনায় নিয়েই রাশিয়ার সঙ্গে ১৯৯৭ সালে ন্যাটোর একটি চুক্তি হয়েছিল। ওই চুক্তিতে ন্যাটোতে রাশিয়ার পরামর্শকের ভূমিকা দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ২৭ মে প্যারিসে এ সংক্রান্ত একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন বরিস ইয়েলৎসিন (রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট) ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। সেই সঙ্গে ন্যাটো সদস্যভুক্ত অন্যান্য দেশের সরকারপ্রধানরাও। কিন্তু তা সত্ত্বেও ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ রাশিয়াকে একটি নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। অনেকটা সেই 'কনটেইনমেন্ট থিউরি'র মতো রাশিয়াকে ঘিরে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে ন্যাটো। ক্রিমিয়ার পার্শ্ববর্তী কৃষ্ণসাগর বা ব্লাক সির পশ্চিমে রুমানিয়ার মিখাইল কোগালনাইসেআনুতে রয়েছে ন্যাটোর বিমান ঘাঁটি। আফগানিস্তানে সেনা ও রসদ সরবরাহের জন্য এই বিমান ঘাঁটিটি ব্যবহৃত হয়। গত বছর কৃষ্ণসাগরে ন্যাটো ও জর্জিয়ার নৌবাহিনী যৌথভাবে একটি সামরিক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিল, যা রাশিয়া খুব সহজভাবে নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন ধরেই চাইছে জর্জিয়া ন্যাটোতে যোগ দিক। এটা যদি হয় তাহলে রাশিয়ার সীমান্তে উপস্থিত থাকবে মার্কিন সেনাবাহিনী। রাশিয়ার সমরনায়করা এটা মানবেন না। আজকে ইউক্রেনের পরিস্থিতি, যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ, এ অঞ্চলে সেনা মোতায়েন সবকিছুতে ক্রমশই মার্কিনি স্বার্থ স্পষ্ট হচ্ছে।
এদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলকৃত পূর্বাঞ্চলে ইউক্রেন সামরিক অভিযান অব্যাহত রেখেছে। রাশিয়ার প্রবল আপত্তির মুখে এই অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে পুরো পূর্বাঞ্চলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। গত ৭ এপ্রিল সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শুধু পূর্বাঞ্চলীয় শহর ওডেসায় কমপক্ষে ৩৬ জন নিহত হয়েছে। পূর্বাঞ্চলের আরেকটি শহর ক্রামাটোরস্কে ঘরে ঘরে লড়াই চলছিল। এই 'গৃহযুদ্ধ' শুধু যে ইউক্রেনের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তা বলা যাবে না। এই পরিস্থিতিতে সীমান্ত অতিক্রম করে রাশিয়ার ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সব মিলিয়ে ইউক্রেনের পরিস্থিতি দীর্ঘদিন পর রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটা প্রক্সিওয়ারের জন্ম দিয়েছে। এই যুদ্ধে কোন পক্ষ জয়ী হবে, এটা আশা করাও ঠিক হবে না। বরং এই উত্তেজনা বিশ্বের অন্য দেশগুলোও আক্রান্ত হতে পারে।
Daily SOMOKAL
08.05.14
0 comments:
Post a Comment