ভারতে
সদ্যসমাপ্ত ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের বিজয়
নেহরু সাম্রাজ্যে বড় ধরনের ধস নামিয়েছে। ইতোমধ্যে নির্বাচনে পরাজয়ের দায়ভার
স্বীকার করেছেন রাহুল গান্ধি, যিনি কংগ্রেসের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান।
তিনি পদত্যাগের ইঙ্গিত দিয়েছেন। এমনকী কংগ্রেস চেয়ারপারসন সোনিয়া গান্ধিও
পদত্যাগ করতে পারেন। তবে কংগ্রেসের এই যে বিপর্যয়, এটা যে এবারই প্রথম ঘটল,
তা নয়। অতীতেও কংগ্রেস ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। আবার ক্ষমতায় ফিরেও
এসেছে। বরাবর কংগ্রেস নেহরু গান্ধি পরিবারের দিকে তাকিয়েছে। তবে এ পরিবারের
বাইরে নরসিমা রাও কিংবা সর্বশেষ মনমোহন সিং কংগ্রেসের পক্ষ থেকে
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ক্ষেত্রে একটা পার্থক্য রয়েছে।
মনমোহন সিং সনাতন রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তিনি ছিলেন টেকনোক্র্যাট।
টেকনোক্র্যাট কোটায় তিনি নরসিমা রাওয়ের মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব
নিয়েছিলেন। তিনি নিজে কখনও লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হননি। অর্থাৎ তার
নিজস্ব কোনও নির্বাচনি এলাকা নেই। আসাম থেকে তিনি রাজ্যসভার সদস্য। সেখানে
এখনও তার একটি ভাড়া করা বাড়ি আছে, যেখানে একদিনের জন্যও তিনি থাকেননি।
রাজ্যসভায় তার আসন আরও কিছুদিনের জন্য থাকবে।
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে
প্রথম লোকসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫২ সালে। আর সর্বশেষ ষোড়শ
লোকসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এপ্রিল-মে মাসে। প্রথম প্রধানমন্ত্রী
ছিলেন জওহরলাল নেহরু। সে হিসেবে আগামী ২১ মের পর ভারতের ১৫তম প্রধানমন্ত্রী
হিসেবে দায়িত্ব নেবেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। যদিও ১৯৪৭ সালের আগস্টে
পাক-ভারত বিভক্তি ও ভারত তার আলাদা অস্তিত্ব বজায় রাখলে, প্রথম
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন নেহরু। নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস
লোকসভার প্রথম (১৯৫২), দ্বিতীয় (১৯৫৭) ও তৃতীয় (১৯৬২) নির্বাচনে বিজয়ী
হয়েছিলেন। নেহরু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৬ বছর ২৮৬ দিন।
তার মৃত্যুর পর (১৯৬৪) দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাত্র ১৩ দিন দায়িত্ব
পালন করেন গুজরালি লাল নন্দা (২৭ মে থেকে ৯ জুন পর্যন্ত)। এরপর লাল বাহাদুর
শাস্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১ বছর ২১৬ দিন
(৯ জুন ১৯৬৪ থেকে ১১ জানুয়ারি ১৯৬৬)। তাসখন্দে শাস্ত্রীর মৃত্যু হলে আবারও
সাময়িকভাবে দায়িত্বটি পড়ে গুজরালি লাল নন্দার ঘাড়ে। দুঃখজনক হলেও সত্য,
নন্দা তার পদে স্থায়ী হতে পারেননি। এবারও তিনি ১৩ দিনের জন্য
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বটি পালন করেন। ওই সময় প্রশ্ন ওঠে- ভারতের ঐক্যের
স্বার্থে নেহরু পরিবারের কাউকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করতে হবে।
কংগ্রেসের ভেতরে একটি কোঠারি স্বার্থ সব সময় চেয়েছে- ক্ষমতা নেহরু পরিবারের
হাতে থাকুক। তাই কংগ্রেসের একমাত্র পছন্দ ছিল ইন্দিরা গান্ধি। জীবদ্দশায়
নেহরুও এমনটি চেয়েছিলেন। তিনি বেঁচে থাকতেই ইন্দিরা গান্ধিকে কংগ্রেসের
চেয়ারম্যানের দায়িত্বটি দিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধি মন্ত্রিসভায়
তথ্যমন্ত্রীও ছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন ১৯৬৬ সালের ২৪
জানুয়ারি। প্রথম পর্যায়ে তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১১ বছর ৫৯ দিন। তৃতীয় ও চতুর্থ
লোকসভা নির্বাচনে তিনি কংগ্রেসকে বিজয়ী করেন। চতুর্থ লোকসভা (১৯৭১)
নির্বাচনে কংগ্রেস ৩৫২ আসনে বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৭ সালে পঞ্চম লোকসভা
নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি (১৫৪ আসন) ঘটে। নির্বাচনে জনতা পার্টি
কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়। মোরারজি দেশাই (২ বছর ১২৬ দিন) ও চরম
সিং (১৭০ দিন) ক্ষমতা ভাগাভাগি করেন। কিন্তু ৬ষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে (১৯৮০)
ইন্দিরা গান্ধি আবার বিপুল ভোটে ফিরে আসেন। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধি তার
নিজ দেহরক্ষীর হাতে নিহত হলে আবারও সেই একই প্রশ্ন ওঠে, গান্ধি পরিবারের
কাউকে ক্ষমতা না দিলে ভারতীয় ঐক্য টিকে থাকবে না। তাই রাজনীতিবিমুখ রাজিব
গান্ধিকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বটি নিতে হয়েছিল। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৮৯
সাল পর্যন্ত। যদিও রাজিব গান্ধি ১৯৮৩ সালে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক
নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের ২১ মে মাদ্রাজ থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে
শ্রীপেরুমপুদুরে বোমা বিস্ফোরণে রাজিব গান্ধি নিহত হলে নরসিমা রাওয়ের জন্য
ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। নির্বাচনে তিনি প্রথমে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
করেননি। পরে উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি সংসদে আসেন ও প্রধানমন্ত্রীর পদটি
নিশ্চিত করেন। রাজিব গান্ধি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮৯
সালের ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত, ৫ বছর ৩২ দিন। এরপর ভারতীয় রাজনীতিতে আবারও
পরিবর্তন আসে। জনতা দল সরকার গঠন করে। ভিপি সিং প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু
অচিরেই অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে জনতা দল। চন্দ্রশেখর সমাজবাদী জনতা দল
গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হন। ভিপি সিং ক্ষমতায় ছিলেন ৩৪৩ দিন, আর চন্দ্রশেখর
২২৩ দিন (নবম লোকসভায়)। ১০ম লোকসভা নির্বাচনে আবার কংগ্রেস ক্ষমতা ফিরে
পায়। নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী হন, ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৯১ সালের ২১ জুন থেকে
১৯৯৬ সালের ১৬ মে পর্যন্ত। কিন্তু ১১তম লোকসভা তিনজন প্রধানমন্ত্রীকে জন্ম
দেয়।
বাজপেয়ি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাত্র ১৩ দিনের জন্য। কিন্তু আস্থা ভোটের মুখোমুখি হয়ে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর জনতা দল সরকার গঠন করে এবং কংগ্রেস তাদের সমর্থন করে। বাজপেয়ির ১৩ দিনের সরকারের স্থায়িত্ব ছিল ১৯৯৬ সালের ১৬ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত। এরপর জনতা দলের দেবগৌড়া সরকার গঠন করেন, ছিলেন ১৯৯৭ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ৩২৮ দিন। কংগ্রেস সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে গুজরাল সরকার গঠন করেন। ১৯৯৮ সালের ১৯ মার্চ পর্যন্ত কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে গুজরাল সরকার পরিচালনা করেন (৩৩২ দিন)। এরপর আবার পরিবর্তন। বিজেপি পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসে। বাজপেয়ি পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হন। এবার অবশ্য বাজপেয়িকে আর ক্ষমতা পরিচালনা করতে কোনও বেগ পেতে হয়নি। একটানা ৬ বছর ৬৪ দিন ক্ষমতা পরিচালনা করে গেছেন বাজপেয়ি (১৯৯৮ সালের মার্চ থেকে ২০০৪ সালের মে পর্যন্ত)। বাজপেয়ি ১২তম লোকসভা ও ১৩তম লোকসভায় কিছুদিন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু শেষের দিকে লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় সরকারের পতন ঘটে। এরপর ১৪ ও ১৫ মে লোকসভায় এককভাবে কংগ্রেস বিজয়ী হয় এবং ইউপিএ জোটের নেতৃত্বে একটি সরকার পরিচালিত হয়। দুই টার্ম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও টেকনোক্র্যাট ড. মনমোহন সিং। তিনি কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা কখনোই ছিলেন না। তবে কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন। যদিও তার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তি নিয়ে কংগ্রেসে কোনও বড় ধরনের বিতর্ক হয়নি। তবে তার ক্ষমতা ছাড়ার পরই জানা যায় তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকলেও পর্দার অন্তরালে ক্ষমতা পরিচালনা করেছেন অন্য কেউ। অনেকেই সোনিয়া গান্ধির দিকে আঙুল নির্দেশ করেছেন। সোনিয়া কংগ্রেস সভাপতির বাইরেও ইউপিএ জোটেরও চেয়ারম্যান। অতীতে তার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তির একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও বিজেপির প্রচ- আপত্তির মুখে তিনি দায়িত্বটি নিতে পারেননি। বিজেপি তাকে বরাবরই ইতালিয়ান নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে। জন্মসূত্রে তিনি ইতালিয়ান হলেও রাজিব গান্ধিকে বিয়ে করার পর তিনি অনেক আগেই ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কট্টরপন্থী হিন্দুদের কাছে তিনি আজও গ্রহণযোগ্য হননি এবং আগামীতে হবেন বলেও মনে হয় না। ধর্মীয়ভাবেও তিনি হিন্দু নন। রোমান ক্যাথলিক। তার সন্তানরা (রাহুল ও প্রিয়াংকা) কেউই হিন্দু নন। তারা সবাই ধর্মীয়ভাবে খ্রিস্টান নন। রাহুল গান্ধির দাদা ফিরোজ গান্ধির জন্ম পার্সি পরিবারে ও জারাসট্রিয়ানইজম ধর্মের অনুসারী। প্রিয়াংকা যাকে বিয়ে করেছেন তিনিও হিন্দু নন। ভারতের রাজনীতিতে এই যুগেও ধর্ম একটি ফ্যাক্টর। অতি হিন্দুত্ববাদ অথবা হিন্দু জাতীয়তাবাদের কথা বলে মোদি জনসমর্থন পেয়েছেন। তবে বাবার মৃত্যুর পর রাহুল গান্ধি রাজিব গান্ধির মুখে অগ্নিসংযোগ করেছিলেন। মোদি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন বটে। কিন্তু ক্ষমতা পরিচালনায় তার সঙ্গে বাজপেয়ির পার্থক্য থাকবেই। বাজপেয়ি হিন্দু জাতীয়তাবাদের রাজনীতিতে বিশ্বাস করলেও কট্টর ছিলেন না। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় রাজনীতির যে ধরন, তা তিনি বহন করেছিলেন। তার গ্রহণযোগ্যতা সর্বমহলে ছিল। কিন্তু মোদি এক ভিন্ন জগতের মানুষ। কট্টরপন্থী সংগঠন আরএসএসের আদর্শকে তিনি শুধু ধারণই করেননি, বরং তা পদে পদে বাস্তবায়ন করেছেন। সাম্প্রদায়িকভাবে তিনি গুজরাটে মুসলমান ও হিন্দুদের আলাদা করেছিলেন। সেখানে হিন্দুরা মুসলমানদের সম্পত্তি যেমনি কিনতে পারে না, ঠিক তেমনি মুসলমানরা হিন্দুদের সম্পত্তি কিনতে পারে না। এ-সংক্রান্ত একটি আইন তিনি করেছেন গুজরাটে। ফলে গুজরাটে একদিকে যেমনি মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় জমির দাম বেড়ে ছিল, অন্যদিকে তেমনি ব্যাপক হারে মুসলমানরা গুজরাট ত্যাগ করে অন্যত্র স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেছিল। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের সঙ্গে এটি মানায় না। ভারতে বছরের পর বছর হিন্দু ও মুসলমানরা পাশাপাশি বসবাস করে আসছে। এখানে অতীতে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার ঘটনা কিংবা গুজরাটে দাঙ্গা হয়েছে বটে, কিন্তু ভারতবর্ষে এরপর এক ধরনের স্থিতিশীলতাও আমরা দেখে এসেছি। এখন মোদি ক্ষমতাসীন হয়ে পুনরায় ওই সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেবেন কি না, এটাই দেখার বিষয়। এক সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় এভাবে বর্ণের ভিত্তিতে জনগোষ্ঠীকে বিভক্ত করা হয়েছিল। শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত অঞ্চলে কৃষ্ণাঙ্গদের কোনও প্রবেশাধিকার ছিল না। এই বর্ণবাদী রাজনীতির জন্য সারা বিশ্ব দক্ষিণ আফ্রিকাকে বয়কট করেছিল। নেলসন ম্যান্ডেলা ওই বর্ণবাদী রাজনীতি ভেঙে দিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে গুজরাট রাজ্যে মোদি ধর্মের নামে এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি টিকিয়ে রেখেছিলেন। এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কতটুকু উসকে দেবেন- এটাই দেখার বিষয়। তবে এটা সত্য, চাইলেও তিনি অনেক কিছু করতে পারবেন না। ভারতের রাজনীতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য দাঁড়িয়ে আছে ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর। সংবিধান এর গ্যারান্টার। মোদির জনপ্রিয়তা আছে। কিন্তু এই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে তিনি সাম্প্রদায়িক নীতির আলোকে ভারতকে পরিচালনা করবেন, এটা আমার মনে হয় না। গান্ধি-নেহরুর গড়া ভারতবর্ষ নিঃসন্দেহে নতুন এক যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। তেলেগু দেশম পার্টির সভাপতি চন্দ্রবাবু নাইডুর ভাষায় মোদির নেতৃত্বে ভারত হয়ে উঠবে ‘সুপার পাওয়ার’। ভারতের এই সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠার অভিলাষ দীর্ঘদিনের। মোদি যদি এখন তার অতি হিন্দু জাতীয়তাবাদকে সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠার জন্য ব্যবহার করেন, তাহলে সংঘাত অনিবার্য। মোদি সেটি করবেন না- এটাই প্রত্যাশা করেন সবাই। Daily Amader Somoy 21.05.14
বাজপেয়ি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাত্র ১৩ দিনের জন্য। কিন্তু আস্থা ভোটের মুখোমুখি হয়ে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর জনতা দল সরকার গঠন করে এবং কংগ্রেস তাদের সমর্থন করে। বাজপেয়ির ১৩ দিনের সরকারের স্থায়িত্ব ছিল ১৯৯৬ সালের ১৬ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত। এরপর জনতা দলের দেবগৌড়া সরকার গঠন করেন, ছিলেন ১৯৯৭ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ৩২৮ দিন। কংগ্রেস সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে গুজরাল সরকার গঠন করেন। ১৯৯৮ সালের ১৯ মার্চ পর্যন্ত কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে গুজরাল সরকার পরিচালনা করেন (৩৩২ দিন)। এরপর আবার পরিবর্তন। বিজেপি পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসে। বাজপেয়ি পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হন। এবার অবশ্য বাজপেয়িকে আর ক্ষমতা পরিচালনা করতে কোনও বেগ পেতে হয়নি। একটানা ৬ বছর ৬৪ দিন ক্ষমতা পরিচালনা করে গেছেন বাজপেয়ি (১৯৯৮ সালের মার্চ থেকে ২০০৪ সালের মে পর্যন্ত)। বাজপেয়ি ১২তম লোকসভা ও ১৩তম লোকসভায় কিছুদিন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু শেষের দিকে লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় সরকারের পতন ঘটে। এরপর ১৪ ও ১৫ মে লোকসভায় এককভাবে কংগ্রেস বিজয়ী হয় এবং ইউপিএ জোটের নেতৃত্বে একটি সরকার পরিচালিত হয়। দুই টার্ম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও টেকনোক্র্যাট ড. মনমোহন সিং। তিনি কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা কখনোই ছিলেন না। তবে কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন। যদিও তার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তি নিয়ে কংগ্রেসে কোনও বড় ধরনের বিতর্ক হয়নি। তবে তার ক্ষমতা ছাড়ার পরই জানা যায় তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকলেও পর্দার অন্তরালে ক্ষমতা পরিচালনা করেছেন অন্য কেউ। অনেকেই সোনিয়া গান্ধির দিকে আঙুল নির্দেশ করেছেন। সোনিয়া কংগ্রেস সভাপতির বাইরেও ইউপিএ জোটেরও চেয়ারম্যান। অতীতে তার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তির একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও বিজেপির প্রচ- আপত্তির মুখে তিনি দায়িত্বটি নিতে পারেননি। বিজেপি তাকে বরাবরই ইতালিয়ান নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে। জন্মসূত্রে তিনি ইতালিয়ান হলেও রাজিব গান্ধিকে বিয়ে করার পর তিনি অনেক আগেই ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কট্টরপন্থী হিন্দুদের কাছে তিনি আজও গ্রহণযোগ্য হননি এবং আগামীতে হবেন বলেও মনে হয় না। ধর্মীয়ভাবেও তিনি হিন্দু নন। রোমান ক্যাথলিক। তার সন্তানরা (রাহুল ও প্রিয়াংকা) কেউই হিন্দু নন। তারা সবাই ধর্মীয়ভাবে খ্রিস্টান নন। রাহুল গান্ধির দাদা ফিরোজ গান্ধির জন্ম পার্সি পরিবারে ও জারাসট্রিয়ানইজম ধর্মের অনুসারী। প্রিয়াংকা যাকে বিয়ে করেছেন তিনিও হিন্দু নন। ভারতের রাজনীতিতে এই যুগেও ধর্ম একটি ফ্যাক্টর। অতি হিন্দুত্ববাদ অথবা হিন্দু জাতীয়তাবাদের কথা বলে মোদি জনসমর্থন পেয়েছেন। তবে বাবার মৃত্যুর পর রাহুল গান্ধি রাজিব গান্ধির মুখে অগ্নিসংযোগ করেছিলেন। মোদি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন বটে। কিন্তু ক্ষমতা পরিচালনায় তার সঙ্গে বাজপেয়ির পার্থক্য থাকবেই। বাজপেয়ি হিন্দু জাতীয়তাবাদের রাজনীতিতে বিশ্বাস করলেও কট্টর ছিলেন না। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় রাজনীতির যে ধরন, তা তিনি বহন করেছিলেন। তার গ্রহণযোগ্যতা সর্বমহলে ছিল। কিন্তু মোদি এক ভিন্ন জগতের মানুষ। কট্টরপন্থী সংগঠন আরএসএসের আদর্শকে তিনি শুধু ধারণই করেননি, বরং তা পদে পদে বাস্তবায়ন করেছেন। সাম্প্রদায়িকভাবে তিনি গুজরাটে মুসলমান ও হিন্দুদের আলাদা করেছিলেন। সেখানে হিন্দুরা মুসলমানদের সম্পত্তি যেমনি কিনতে পারে না, ঠিক তেমনি মুসলমানরা হিন্দুদের সম্পত্তি কিনতে পারে না। এ-সংক্রান্ত একটি আইন তিনি করেছেন গুজরাটে। ফলে গুজরাটে একদিকে যেমনি মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় জমির দাম বেড়ে ছিল, অন্যদিকে তেমনি ব্যাপক হারে মুসলমানরা গুজরাট ত্যাগ করে অন্যত্র স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেছিল। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের সঙ্গে এটি মানায় না। ভারতে বছরের পর বছর হিন্দু ও মুসলমানরা পাশাপাশি বসবাস করে আসছে। এখানে অতীতে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার ঘটনা কিংবা গুজরাটে দাঙ্গা হয়েছে বটে, কিন্তু ভারতবর্ষে এরপর এক ধরনের স্থিতিশীলতাও আমরা দেখে এসেছি। এখন মোদি ক্ষমতাসীন হয়ে পুনরায় ওই সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেবেন কি না, এটাই দেখার বিষয়। এক সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় এভাবে বর্ণের ভিত্তিতে জনগোষ্ঠীকে বিভক্ত করা হয়েছিল। শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত অঞ্চলে কৃষ্ণাঙ্গদের কোনও প্রবেশাধিকার ছিল না। এই বর্ণবাদী রাজনীতির জন্য সারা বিশ্ব দক্ষিণ আফ্রিকাকে বয়কট করেছিল। নেলসন ম্যান্ডেলা ওই বর্ণবাদী রাজনীতি ভেঙে দিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে গুজরাট রাজ্যে মোদি ধর্মের নামে এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি টিকিয়ে রেখেছিলেন। এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কতটুকু উসকে দেবেন- এটাই দেখার বিষয়। তবে এটা সত্য, চাইলেও তিনি অনেক কিছু করতে পারবেন না। ভারতের রাজনীতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য দাঁড়িয়ে আছে ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর। সংবিধান এর গ্যারান্টার। মোদির জনপ্রিয়তা আছে। কিন্তু এই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে তিনি সাম্প্রদায়িক নীতির আলোকে ভারতকে পরিচালনা করবেন, এটা আমার মনে হয় না। গান্ধি-নেহরুর গড়া ভারতবর্ষ নিঃসন্দেহে নতুন এক যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। তেলেগু দেশম পার্টির সভাপতি চন্দ্রবাবু নাইডুর ভাষায় মোদির নেতৃত্বে ভারত হয়ে উঠবে ‘সুপার পাওয়ার’। ভারতের এই সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠার অভিলাষ দীর্ঘদিনের। মোদি যদি এখন তার অতি হিন্দু জাতীয়তাবাদকে সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠার জন্য ব্যবহার করেন, তাহলে সংঘাত অনিবার্য। মোদি সেটি করবেন না- এটাই প্রত্যাশা করেন সবাই। Daily Amader Somoy 21.05.14
0 comments:
Post a Comment