গতকাল
নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি ভারতের পঞ্চদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন।
এর মধ্য দিয়ে মোদি নিজেকে নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী কিংবা
নরসিমা রাও ও বাজপেয়ির নামের সঙ্গে নিজের নামটাও যুক্ত করলেন। ভারতের দীর্ঘ
৬৭ বছরের রাজনীতিতে কংগ্রেস এককভাবে ক্ষমতায় ছিল প্রায় ৫৪ বছর। এই ধারা
ভেঙে নেহরু পরিবারকে চ্যালেঞ্জ করে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া চাট্টিখানি কথা
নয়। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি দেখিয়ে দিয়েছেন, তিনি পারেন। সংগত কারণেই যে
প্রশ্নটি উঠেছে, তা হচ্ছে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে কী পরিবর্তন আসবে?
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের যে সখ্য, সেই বৃত্ত থেকে মোদি কী ভারতকে বের
করে আনবেন? বলা ভালো, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মোদির বিজয়ে তাঁকে
শুভেচ্ছা জানালেও মোদি তাঁর টুইটার বার্তায় যাঁদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন, সেই
তালিকায় ওবামার নাম একদম শেষের দিকে ছিল। মোদিকে ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র
ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এ ঘটনা মোটামুটি সবাই জানেন। এ ক্ষেত্রে
মোদি কি যুক্তরাষ্ট্রকে এখন অস্বীকৃতি জানাবেন? নাকি দুই দেশের মধ্যে গড়ে
ওঠা সম্পর্ককে অস্বীকার করতে পারবেন?
মনে রাখতে হবে, মোদি এমন একটা সময় দায়িত্ব নিয়েছেন, যখন দক্ষিণ এশিয়া তথা বিশ্ব রাজনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়। ২০১৪ সালের শেষের দিকে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হবে এবং সেখানে একজন নয়া রাষ্ট্রপ্রধান দায়িত্ব নেবেন। এটা অনেকেই জানেন, ওবামা প্রশাসন চাচ্ছে ভারত ২০১৪ পরবর্তী আফগানিস্তানে একটা বড় ভূমিকা পালন করুক। এখন দেখতে হবে মোদি সরকার ইউপিএ সরকারের গৃহীত নীতি অনুসরণ করে কি না। আফগানিস্তানে প্রচুর ভারতীয় বিনিয়োগ রয়েছে (প্রায় ২০০ কোটি ডলার) বিশেষ করে অবকাঠামোগত উন্নয়নে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ভারতের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। এমনকি ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি দূরবর্তী ঘাঁটিও রয়েছে আফগানিস্তানে। দ্বিতীয় যেটি উদ্বেগের কারণ, তা হচ্ছে ভারত মহাসাগরে মার্কিন নৌসেনার উপস্থিতি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের ছয়টি জাহাজ আগামী ২০১৮-১৯ সালের মধ্যে ভারত মহাসাগরে মোতায়েন করা হবে। অভিযোগ আছে, এই মোতায়েনের পেছনে কাজ করছে মার্কিন দুরভিসন্ধি চীনকে ঘিরে ফেলা। এ ধরনের 'কর্মসূচিতে' মার্কিন নীতিনির্ধারকদের মোদি সরকারের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। তৃতীয়ত, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় ধরনের ব্যবসায়িক ও বিনিয়োগ সম্পর্ক রয়েছে। ওবামার ভারত সফরের পর এই বিনিয়োগ বেড়েছে। ভারতে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, তার আধুনিকায়নে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতে পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ করে। অত্যাধুনিক বিমান ও সমরাস্ত্র ভারত কিনছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। ফলে এ সম্পর্কে 'ইউ টার্ন' নেওয়া মোদির পক্ষে সম্ভব হবে না। অগ্রাধিকার তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র কত নাম্বারে থাকবে- সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
শপথ অনুষ্ঠানে সার্কভুক্ত দেশগুলোর নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে একটা বার্তা অন্তত তিনি দিতে চাচ্ছেন, আর তা হচ্ছে তাঁর বৈদেশিক নীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো গুরুত্ব পাবে বেশি। তবে সব সার্ক নেতা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী গেলেন জাপানে। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন সংসদের স্পিকার। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শরিফের আসাটাও একটা 'সিগন্যাল'। পাক-ভারত সম্পর্কের বরফ এখন কিভাবে গলবে, সেটা একটা প্রশ্ন হয়েই থাকল। ১৯৯৮ সালে বাজপেয়ি পাকিস্তান সফরে লাহোর গিয়েছিলেন, এটা স্মরণ করতে পারেন অনেকে। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিতি খোদ নরেন্দ্র মোদির জন্য একটি 'রাজনৈতিক ঝুঁকি' থাকলেও মূলত শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের আগ্রহটা এখানে বেশি। শ্রীলঙ্কায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে জাতিসংঘে উত্থাপিত প্রস্তাবে শ্রীলঙ্কা ভারত সরকারের সমর্থন পায়নি। উপরন্তু তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে 'যুদ্ধ' ও 'গণহত্যার' জন্য তামিলনাড়ুতে রাজাপাকসেবিরোধী একটা জনমত রয়েছে। সেখানে ক্ষমতাসীন জয়ললিতার রাজ্য সরকার কিংবা বিরোধী ডিএমকে দল এই 'গণহত্যার' জন্য রাজাপাকসে সরকারকে অভিযুক্ত করে আসছে। এখন মোদির রাজাপাকসেকে আমন্ত্রণ খুব সংগত কারণেই দক্ষিণের রাজ্যগুলোর সঙ্গে, বিশেষ করে তামিলনাড়ুর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে পারে। জয়ললিতা ও মমতা শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যাননি। তবে গেছেন সোনিয়া ও রাহুল। বিদায়ী আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বোরিং লিওনচেন, নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কৈরালা, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের উপস্থিতি প্রমাণ করে এ দেশগুলো ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। ভারত এখন বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক শক্তি। ২০৩০ সাল নাগাদ দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে পারে দেশটি। ফলে এ অঞ্চলের উন্নয়নে ভারত যে একটা বড় ভূমিকা নিতে চায়, মোদি সেটা আবারও নিশ্চিত করলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মোদি কি সার্ককে গুরুত্ব দেবেন, নাকি নয়া অর্থনৈতিক জোট বা করিডর বিসিআইএমকে (বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার) বেশি গুরুত্ব দেবেন, এটা একটা বড় প্রশ্ন। সার্ক কার্যত একটি কাগুজে সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এর কারণও মূলত ভারত। ভারতের দ্বিপক্ষীয় রাজনীতি ও সার্ক ফোরামে দ্বিপক্ষীয় বিরোধ আলোচনার সুযোগ না থাকা কিংবা ভারতের এক ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য সার্কের বিকাশের পথে প্রধান অন্তরায়। অন্যদিকে মোদির বিসিআইএমের ব্যাপারে আগ্রহ থাকবে নানা কারণে। প্রথমত, এর মাধ্যমে চীন, বিশেষ করে চীনের ইউনান প্রদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে। চীনা বিশ্লেষকরা কেউ কেউ মোদিকে 'ভারতের নিঙ্ন' হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করছেন। নিঙ্ন ১৯৭২ সালে প্রথমবারের মতো চীন সফর করে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছিলেন। এখন মোদিকে তারা 'চীনের বন্ধু' এবং চীনা বিনিয়োগের জন্য সহায়ক বলে মনে করছেন। চীন ভারতে টেলিযোগাযোগ ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করেছে। চীন ভারতে 'বুলেট ট্রেন' চালুরও প্রস্তাব করেছে। দ্বিতীয়ত, চীন কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চায়। এতে চীনেরও স্বার্থ রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে চীন কুনমিংকে (ইউনান প্রদেশের রাজধানী) সমুদ্রপথে 'কানেক্ট' করতে পারবে। অর্থাৎ ইউনান প্রদেশ এই সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে (সাংহাই বন্দর ব্যবহার না করে) তাদের আমদানি-রপ্তানি বাড়াতে পারবে। এতে সময় ও অর্থ বাঁচবে অনেক। এই গভীর সমুদ্রবন্দর একবার হয়ে গেলে ভারতও এ থেকে সুবিধা নিতে পারবে। সাত বোন রাজ্যের পণ্য এ পথে আসা-যাওয়া করবে। এ-সংক্রান্ত একটি প্রাথমিক চুক্তি ইতিমধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে। তৃতীয়ত, এই মুহূর্তে ভারতের টার্গেট হচ্ছে আসিয়ানের পূর্ণ সদস্য হওয়া। সেই সঙ্গে ইস্ট-এশিয়া সামিটে নিজেকে জড়িত করা। ভারত ইতিমধ্যে আসিয়ানের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ভবিষ্যতে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে যে বিশাল শুল্কমুক্ত বাজার সৃষ্টি হচ্ছে, ভারতের টার্গেট হচ্ছে এই বিশাল বাজারে তার পণ্য নিয়ে প্রবেশ করা। বিসিআইএমএ ভারতের সংযুক্তি আসিয়ানে যাওয়ার পথকে আরো প্রশস্ত করবে।
মোদির শপথ অনুষ্ঠানে ওবামা তাঁর কোনো প্রতিনিধি পাঠাননি; যদিও প্রটোকল অনুযায়ী ওবামা মোদিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত একটি কৌশলগত চুক্তিতে আবদ্ধ থাকলেও ক্রিমিয়া ইস্যুতে ভারত রাশিয়ার পক্ষাবলম্বন করেছে। চীনের অবস্থানও ছিল এই শিবিরে। ভারতের কুদাকুলামে ১৯৮৯ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির অধীনে রাশিয়া দুটি পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ করেছে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাশিয়া আরো দুটি পারমাণবিক চুল্লি তৈরি করছে। ফলে ভারত-রাশিয়া মৈত্রী চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন থাকবে অনেক। মোদি এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন বলেও মনে হয় না। তবে মোদি ভারতের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেবেন। ফলে সংগত কারণেই অর্থনৈতিক কূটনীতি গুরুত্ব পাবে বেশি। 'ব্রিকস'-এর পাশাপাশি চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে তিনি অগ্রাধিকার দেবেন বেশি। দিল্লি-মুম্বাই অর্থনৈতিক করিডর সৃষ্টিতে জাপানের বিনিয়োগ প্রায় চার বিলিয়ন ডলার। চীনের বিনিয়োগও প্রচুর। চীন-ভারত বাণিজ্য আগের চেয়ে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ধারণা করছি, মোদি জমানায় ভারতে চীনের বিনিয়োগ আরো বাড়বে। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান হবে না। যাঁরা মোদিকে ভোট দিয়েছেন, সেই ভোটারদের ৫০ শতাংশের বয়স ২৫ বছরের নিচে। এঁদের চাকরি দরকার। তাই মোদিকে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে তার বৈদেশিক নীতির 'অ্যাপ্রোচ'-এ চীন, জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়া অগ্রাধিকার পাবে বেশি। বাংলাদেশ তার আগ্রহের তালিকায় থাকবে না।
মোদির একটি 'অ্যাপ্রোচ' হচ্ছে 'কম সরকার, অনেক বেশি প্রশাসন'। কাজপাগল মানুষ তিনি। গুজরাটকে তিনি একটি শিল্পোন্নত ও উন্নত রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। যদিও এটা সত্য, শিল্পায়ন করতে গিয়ে তিনি সামাজিক খাতগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেননি। তিনি মাথাভারী প্রশাসনে কখনো বিশ্বাস করতেন না। এখন মন্ত্রিসভা গঠনের মধ্য দিয়ে তাঁর 'কম সরকারের' ধারণার প্রতিফলন ঘটল। মন্ত্রিসভার ধরন দেখে এটা বোঝা যায়, তিনি মন্ত্রিসভার ওপর পুরো নিয়ন্ত্রণ রাখতে চান। ইচ্ছে করলে তিনি শুধু বিজেপি সরকার করতে পারতেন। কিন্তু শরিকদেরও তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পিকারের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে বাংলাদেশ মোদিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারতে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, বাংলাদেশের জন্য তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে ভারতের যেমন স্বার্থ রয়েছে, ঠিক তেমনি ভারতেও বাংলাদেশের স্বার্থ রয়েছে। গত ২৩ মে বাংলাদেশের প্রায় সব পত্রিকায়ই একটা খবর বেরিয়েছে, ওই খবরে বলা হয়েছে, মোদি তাঁর প্রথম বিদেশ সফরে বাংলাদেশে আসতে পারেন এবং মোদির বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে তিস্তা পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে! দিল্লির একটি দৈনিক পত্রিকা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এ ধরনের একটি সংবাদ পরিবেশন করেছে, যা ঢাকায় একটি অনলাইন পত্রিকার মাধ্যমে সর্বত্র পরিবেশিত হয়েছে। এই সংবাদটির পেছনে সত্যতা যে এতটুকু নেই, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় এখন। তবে বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে মোদি সরকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপ উপেক্ষা করে যদি ভবিষ্যতে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করার কোনো উদ্যোগ নেয়, তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি বাংলাদেশের মানুষের সমর্থন ও ভালোবাসা পাবেন। কিন্তু তথাকথিত 'বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের' ঠেকাতে পৃথক একটি দপ্তর গঠন করার নির্দেশ দিয়ে তিনি দুই দেশের মধ্যে একটা আস্থার সংকট সৃষ্টি করলেন। তবে এ বিষয়টি যতটা না বাস্তবসম্মত, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। অর্থাৎ তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটা চাপে রাখতে চান। তাঁর টার্গেট বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মোদি নয়াদিল্লিতে দায়িত্ব নিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে ভারতের রাজনীতিতে শুরু হলো নতুন একটি অধ্যায়।
Daily Kalerkontho
মনে রাখতে হবে, মোদি এমন একটা সময় দায়িত্ব নিয়েছেন, যখন দক্ষিণ এশিয়া তথা বিশ্ব রাজনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়। ২০১৪ সালের শেষের দিকে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হবে এবং সেখানে একজন নয়া রাষ্ট্রপ্রধান দায়িত্ব নেবেন। এটা অনেকেই জানেন, ওবামা প্রশাসন চাচ্ছে ভারত ২০১৪ পরবর্তী আফগানিস্তানে একটা বড় ভূমিকা পালন করুক। এখন দেখতে হবে মোদি সরকার ইউপিএ সরকারের গৃহীত নীতি অনুসরণ করে কি না। আফগানিস্তানে প্রচুর ভারতীয় বিনিয়োগ রয়েছে (প্রায় ২০০ কোটি ডলার) বিশেষ করে অবকাঠামোগত উন্নয়নে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ভারতের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। এমনকি ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি দূরবর্তী ঘাঁটিও রয়েছে আফগানিস্তানে। দ্বিতীয় যেটি উদ্বেগের কারণ, তা হচ্ছে ভারত মহাসাগরে মার্কিন নৌসেনার উপস্থিতি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের ছয়টি জাহাজ আগামী ২০১৮-১৯ সালের মধ্যে ভারত মহাসাগরে মোতায়েন করা হবে। অভিযোগ আছে, এই মোতায়েনের পেছনে কাজ করছে মার্কিন দুরভিসন্ধি চীনকে ঘিরে ফেলা। এ ধরনের 'কর্মসূচিতে' মার্কিন নীতিনির্ধারকদের মোদি সরকারের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। তৃতীয়ত, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় ধরনের ব্যবসায়িক ও বিনিয়োগ সম্পর্ক রয়েছে। ওবামার ভারত সফরের পর এই বিনিয়োগ বেড়েছে। ভারতে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, তার আধুনিকায়নে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতে পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ করে। অত্যাধুনিক বিমান ও সমরাস্ত্র ভারত কিনছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। ফলে এ সম্পর্কে 'ইউ টার্ন' নেওয়া মোদির পক্ষে সম্ভব হবে না। অগ্রাধিকার তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র কত নাম্বারে থাকবে- সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
শপথ অনুষ্ঠানে সার্কভুক্ত দেশগুলোর নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে একটা বার্তা অন্তত তিনি দিতে চাচ্ছেন, আর তা হচ্ছে তাঁর বৈদেশিক নীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো গুরুত্ব পাবে বেশি। তবে সব সার্ক নেতা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী গেলেন জাপানে। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন সংসদের স্পিকার। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শরিফের আসাটাও একটা 'সিগন্যাল'। পাক-ভারত সম্পর্কের বরফ এখন কিভাবে গলবে, সেটা একটা প্রশ্ন হয়েই থাকল। ১৯৯৮ সালে বাজপেয়ি পাকিস্তান সফরে লাহোর গিয়েছিলেন, এটা স্মরণ করতে পারেন অনেকে। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিতি খোদ নরেন্দ্র মোদির জন্য একটি 'রাজনৈতিক ঝুঁকি' থাকলেও মূলত শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের আগ্রহটা এখানে বেশি। শ্রীলঙ্কায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে জাতিসংঘে উত্থাপিত প্রস্তাবে শ্রীলঙ্কা ভারত সরকারের সমর্থন পায়নি। উপরন্তু তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে 'যুদ্ধ' ও 'গণহত্যার' জন্য তামিলনাড়ুতে রাজাপাকসেবিরোধী একটা জনমত রয়েছে। সেখানে ক্ষমতাসীন জয়ললিতার রাজ্য সরকার কিংবা বিরোধী ডিএমকে দল এই 'গণহত্যার' জন্য রাজাপাকসে সরকারকে অভিযুক্ত করে আসছে। এখন মোদির রাজাপাকসেকে আমন্ত্রণ খুব সংগত কারণেই দক্ষিণের রাজ্যগুলোর সঙ্গে, বিশেষ করে তামিলনাড়ুর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে পারে। জয়ললিতা ও মমতা শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যাননি। তবে গেছেন সোনিয়া ও রাহুল। বিদায়ী আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বোরিং লিওনচেন, নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কৈরালা, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের উপস্থিতি প্রমাণ করে এ দেশগুলো ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। ভারত এখন বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক শক্তি। ২০৩০ সাল নাগাদ দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে পারে দেশটি। ফলে এ অঞ্চলের উন্নয়নে ভারত যে একটা বড় ভূমিকা নিতে চায়, মোদি সেটা আবারও নিশ্চিত করলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মোদি কি সার্ককে গুরুত্ব দেবেন, নাকি নয়া অর্থনৈতিক জোট বা করিডর বিসিআইএমকে (বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার) বেশি গুরুত্ব দেবেন, এটা একটা বড় প্রশ্ন। সার্ক কার্যত একটি কাগুজে সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এর কারণও মূলত ভারত। ভারতের দ্বিপক্ষীয় রাজনীতি ও সার্ক ফোরামে দ্বিপক্ষীয় বিরোধ আলোচনার সুযোগ না থাকা কিংবা ভারতের এক ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য সার্কের বিকাশের পথে প্রধান অন্তরায়। অন্যদিকে মোদির বিসিআইএমের ব্যাপারে আগ্রহ থাকবে নানা কারণে। প্রথমত, এর মাধ্যমে চীন, বিশেষ করে চীনের ইউনান প্রদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে। চীনা বিশ্লেষকরা কেউ কেউ মোদিকে 'ভারতের নিঙ্ন' হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করছেন। নিঙ্ন ১৯৭২ সালে প্রথমবারের মতো চীন সফর করে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছিলেন। এখন মোদিকে তারা 'চীনের বন্ধু' এবং চীনা বিনিয়োগের জন্য সহায়ক বলে মনে করছেন। চীন ভারতে টেলিযোগাযোগ ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করেছে। চীন ভারতে 'বুলেট ট্রেন' চালুরও প্রস্তাব করেছে। দ্বিতীয়ত, চীন কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চায়। এতে চীনেরও স্বার্থ রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে চীন কুনমিংকে (ইউনান প্রদেশের রাজধানী) সমুদ্রপথে 'কানেক্ট' করতে পারবে। অর্থাৎ ইউনান প্রদেশ এই সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে (সাংহাই বন্দর ব্যবহার না করে) তাদের আমদানি-রপ্তানি বাড়াতে পারবে। এতে সময় ও অর্থ বাঁচবে অনেক। এই গভীর সমুদ্রবন্দর একবার হয়ে গেলে ভারতও এ থেকে সুবিধা নিতে পারবে। সাত বোন রাজ্যের পণ্য এ পথে আসা-যাওয়া করবে। এ-সংক্রান্ত একটি প্রাথমিক চুক্তি ইতিমধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে। তৃতীয়ত, এই মুহূর্তে ভারতের টার্গেট হচ্ছে আসিয়ানের পূর্ণ সদস্য হওয়া। সেই সঙ্গে ইস্ট-এশিয়া সামিটে নিজেকে জড়িত করা। ভারত ইতিমধ্যে আসিয়ানের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ভবিষ্যতে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে যে বিশাল শুল্কমুক্ত বাজার সৃষ্টি হচ্ছে, ভারতের টার্গেট হচ্ছে এই বিশাল বাজারে তার পণ্য নিয়ে প্রবেশ করা। বিসিআইএমএ ভারতের সংযুক্তি আসিয়ানে যাওয়ার পথকে আরো প্রশস্ত করবে।
মোদির শপথ অনুষ্ঠানে ওবামা তাঁর কোনো প্রতিনিধি পাঠাননি; যদিও প্রটোকল অনুযায়ী ওবামা মোদিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত একটি কৌশলগত চুক্তিতে আবদ্ধ থাকলেও ক্রিমিয়া ইস্যুতে ভারত রাশিয়ার পক্ষাবলম্বন করেছে। চীনের অবস্থানও ছিল এই শিবিরে। ভারতের কুদাকুলামে ১৯৮৯ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির অধীনে রাশিয়া দুটি পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ করেছে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাশিয়া আরো দুটি পারমাণবিক চুল্লি তৈরি করছে। ফলে ভারত-রাশিয়া মৈত্রী চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন থাকবে অনেক। মোদি এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন বলেও মনে হয় না। তবে মোদি ভারতের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেবেন। ফলে সংগত কারণেই অর্থনৈতিক কূটনীতি গুরুত্ব পাবে বেশি। 'ব্রিকস'-এর পাশাপাশি চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে তিনি অগ্রাধিকার দেবেন বেশি। দিল্লি-মুম্বাই অর্থনৈতিক করিডর সৃষ্টিতে জাপানের বিনিয়োগ প্রায় চার বিলিয়ন ডলার। চীনের বিনিয়োগও প্রচুর। চীন-ভারত বাণিজ্য আগের চেয়ে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ধারণা করছি, মোদি জমানায় ভারতে চীনের বিনিয়োগ আরো বাড়বে। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান হবে না। যাঁরা মোদিকে ভোট দিয়েছেন, সেই ভোটারদের ৫০ শতাংশের বয়স ২৫ বছরের নিচে। এঁদের চাকরি দরকার। তাই মোদিকে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে তার বৈদেশিক নীতির 'অ্যাপ্রোচ'-এ চীন, জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়া অগ্রাধিকার পাবে বেশি। বাংলাদেশ তার আগ্রহের তালিকায় থাকবে না।
মোদির একটি 'অ্যাপ্রোচ' হচ্ছে 'কম সরকার, অনেক বেশি প্রশাসন'। কাজপাগল মানুষ তিনি। গুজরাটকে তিনি একটি শিল্পোন্নত ও উন্নত রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। যদিও এটা সত্য, শিল্পায়ন করতে গিয়ে তিনি সামাজিক খাতগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেননি। তিনি মাথাভারী প্রশাসনে কখনো বিশ্বাস করতেন না। এখন মন্ত্রিসভা গঠনের মধ্য দিয়ে তাঁর 'কম সরকারের' ধারণার প্রতিফলন ঘটল। মন্ত্রিসভার ধরন দেখে এটা বোঝা যায়, তিনি মন্ত্রিসভার ওপর পুরো নিয়ন্ত্রণ রাখতে চান। ইচ্ছে করলে তিনি শুধু বিজেপি সরকার করতে পারতেন। কিন্তু শরিকদেরও তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পিকারের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে বাংলাদেশ মোদিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারতে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, বাংলাদেশের জন্য তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে ভারতের যেমন স্বার্থ রয়েছে, ঠিক তেমনি ভারতেও বাংলাদেশের স্বার্থ রয়েছে। গত ২৩ মে বাংলাদেশের প্রায় সব পত্রিকায়ই একটা খবর বেরিয়েছে, ওই খবরে বলা হয়েছে, মোদি তাঁর প্রথম বিদেশ সফরে বাংলাদেশে আসতে পারেন এবং মোদির বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে তিস্তা পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে! দিল্লির একটি দৈনিক পত্রিকা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এ ধরনের একটি সংবাদ পরিবেশন করেছে, যা ঢাকায় একটি অনলাইন পত্রিকার মাধ্যমে সর্বত্র পরিবেশিত হয়েছে। এই সংবাদটির পেছনে সত্যতা যে এতটুকু নেই, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় এখন। তবে বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে মোদি সরকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপ উপেক্ষা করে যদি ভবিষ্যতে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করার কোনো উদ্যোগ নেয়, তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি বাংলাদেশের মানুষের সমর্থন ও ভালোবাসা পাবেন। কিন্তু তথাকথিত 'বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের' ঠেকাতে পৃথক একটি দপ্তর গঠন করার নির্দেশ দিয়ে তিনি দুই দেশের মধ্যে একটা আস্থার সংকট সৃষ্টি করলেন। তবে এ বিষয়টি যতটা না বাস্তবসম্মত, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। অর্থাৎ তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটা চাপে রাখতে চান। তাঁর টার্গেট বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মোদি নয়াদিল্লিতে দায়িত্ব নিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে ভারতের রাজনীতিতে শুরু হলো নতুন একটি অধ্যায়।
Daily Kalerkontho
২৮ মে ২০১৪
28 May, 2014
0 comments:
Post a Comment