রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক প্রসঙ্গে

ভারতে ষোড়শ লোকসভা নির্বাচন ও সম্ভাব্য একটি বিজেপি সরকারকে সামনে রেখে গত ৩ মে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গুরুত্বপূর্ণ একটি সেমিনার। 'ভারতের নির্বাচন ২০১৪ : বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক' শীর্ষক ওই সেমিনারটির আয়োজন করেছিল ঢাকার 'ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ' নামের একটি সংগঠন, যার নির্বাহী পরিচালক হচ্ছেন একজন ডেভেলপার ও রিহাবের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। সেমিনারটির গুরুত্ব অনুধাবন করে একাত্তর টিভি এটি 'লাইভ সম্প্রচার' করে। উদ্যোক্তারা আমাকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে আমি ওই সেমিনারে উপস্থিত থাকতে পারিনি। ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের সরাসরি উপস্থিতি, স্কাইপিতে আনন্দবাজার সম্পাদক জয়ন্ত ঘোষাল কিংবা ভারতীয় সাবেক কূটনীতিক বীণা সিক্রির (যিনি এখন মোদির অন্যতম উপদেষ্টা) অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে এই সেমিনারটির গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়া যেভাবে এই অনুষ্ঠানটি 'কভার' করেছে, তাতে সন্দেহাতীতভাবে সেমিনারের গুরুত্বটি বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে আমার কাছে একাধিক কারণে এই সেমিনারের অসম্পূর্ণতা চোখে পড়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেন বেশ কয়েকজন অধ্যাপক, গবেষক, বিশ্লেষক। তাঁদের কাউকেই আমি অনুষ্ঠানে দেখলাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ইতিহাস বিভাগে বেশ কয়েকজন গবেষক রয়েছেন, যাঁরা ভারতের ভূমিকা নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁদের কাউকেই আমার চোখে পড়েনি। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা একটা অন্যতম ইস্যু (সেমিনার চলাকালীন সময়েই খবর এসেছে ভারতের আসামে ৩২ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে)। অথচ বাংলাদেশে নিরাপত্তা নিয়ে যাঁরা কাজ করেন এবং দু-একটি থিংক ট্যাঙ্ক পরিচালনা করেন, তাঁরা সবাই ছিলেন অনুপস্থিত। ভারতে বিজেপি নেতা যখন তথাকথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর হুমকি দেন, তখন একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক বিষয়টি ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারতেন। এমনকি তাঁরা সঠিকভাবেই ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট-করিডর বিতর্কে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের নিরাপত্তা কতটুকু ঝুঁকির মুখে এর একটা পরিষ্কার ধারণা দিতে পারতেন। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্থনীতি একটি ইস্যু। বিশেষ করে বাংলাদেশ যখন ভারতের পঞ্চম বাজারে পরিণত হয়েছে, তখন এই অর্থনৈতিক আধিপত্য থেকে আমরা কিভাবে বেরিয়ে আসতে পারি, আমাদের করণীয় কী, তার ব্যাখ্যা দিতে পারতেন অর্থনীতিবিদরা, যাঁরা বিভিন্ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। কিন্তু একমাত্র ড. খলীকুজ্জমান ছাড়া কাউকে দেখলাম না। এবং তাঁর মুখ থেকেও শুনলাম না এ বিষয়টি। চতুর্থত, 'সব জান্তা' কিছু ব্যক্তিকে দেখলাম, যাঁরা নিয়মিত টিভি টক শোতে যান এবং সব বিষয়েই তাঁরা 'অভিজ্ঞ'। নারীনীতি থেকে শুরু করে জঙ্গিবাদ- সব বিষয়েই তাঁরা টিভিতে 'বিশেষজ্ঞ' জ্ঞান দেন। তাঁরা অনুষ্ঠানে ছিলেন এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে 'বিশেষজ্ঞ' জ্ঞান দিলেন। পঞ্চমত, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে মূল বিষয় একটিই- ভারতের 'মাইন্ড সেটআপ'। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কোনো একজন বক্তাও এ প্রসঙ্গটির অবতারণা করলেন না। ভারতে বিজেপি কেন, একটি 'তৃতীয় শক্তি'ও যদি ক্ষমতা নেয় (আঞ্চলিক দলগুলোর নেতৃত্বে), তাহলেও বাংলাদেশকে 'সমমর্যাদা না দেওয়ার' যে মানসিকতা, তাতে পরিবর্তন আসবে না। এমনকি একটি বড় দেশের পাশে একটি ছোট দেশ থাকলে, মেদভেদেভের (রাশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী), 'জোন অব প্রিভিলেজ ইন্টারেস্ট'-এর যে তত্ত্ব, সে ব্যাপারেও 'অধ্যাপক'রা কোনো কথা বললেন না। ষষ্ঠত, বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন সিনিয়র কূটনীতিক রয়েছেন, যাঁরা এখন ঢাকায় অবসর জীবন যাপন করছেন। কেউ কেউ নিয়মিত কলাম লিখছেন। তাঁদের অনেকে ভারতে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন মাত্র অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিকের নাম দেখলাম। বাকিদের আমন্ত্রণ জানানো হলো না কেন? সপ্তমত, বিষয়টি যেহেতু দ্বিপক্ষীয়, উদ্যোক্তারা বর্তমান কিংবা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানাতে পারতেন। বিএনপি সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেও আমন্ত্রণ জানানো যেত। অষ্টমত, ভারতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, আমাদের স্ট্র্যাটেজি কী হওয়া উচিত, দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমরা কোন কোন বিষয়কে প্রাধান্য দেব, সে ব্যাপারেও সুস্পষ্ট কোনো কথা আমি শুনলাম না। নবমত, বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারে রামমন্দির (বাবরি মসজিদের জায়গায়) নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। এটা বাংলাদেশি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের একটা 'ভুল মেসেজ' পৌঁছে দিতে পারে। কিন্তু কোনো আলোচকই এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন না জোরালোভাবে। কুলদীপ নায়ার যদিও বলেছেন, 'মোদি প্রধানমন্ত্রী হলেও, তা বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকির কারণ হবে না'। কিন্তু তাঁর এই বক্তব্য বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। দশমত, আলোচকরা সবাই মোদির বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু বলা উচিত ছিল, ভারতে বাংলা ভাষায় কথা বললেই তারা বাংলাদেশি নয়। তারা পশ্চিম বাংলার বাঙালি। বাংলা ভাষাভাষীদের বাংলাদেশে 'পুশব্যাক' করা যাবে না। একাদশত, তুলদীপ নায়ার দক্ষিণ এশিয়ায় 'অভিন্ন বাজার' চালুর কথা বলেছেন। কিন্তু 'সাফটা' কার্যকর হয়নি। সার্কের অনুন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার কথা, তা বাংলাদেশ ভারতে পায় না। ট্যারিফ আর প্যারাট্যারিফের কারণে বাংলাদেশি পণ্য ভারতে বাজার পাচ্ছে না। অথচ চাহিদা আছে প্রচুর। এখন 'অভিন্ন বাজার' বা দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন হলে বাংলাদেশসহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় পণ্যের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রতিযোগিতায় আমরা আমাদের পণ্য নিয়ে দাঁড়াতে পারব না। দ্বাদশত, একজন আলোচক দুই দেশের সম্পর্ককে 'শর্ট টার্ম, লং টার্ম ও মিডিয়াম টার্ম'-এ ভাগ করার কথা বললেন। অথচ তিনি ভুলে গেছেন সম্পর্কের ক্ষেত্রে 'সীমিত বা দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্ত' বলে কিছু নেই। আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আমাদের অবস্থান স্থায়ী। এখানে মধ্যবর্তী কোনো সমাধান নেই। ত্রয়োদশত, আলোচনায় ভারতে বাংলাদেশি অভিবাসীদের প্রসঙ্গ এসেছে। অথচ একজন আলোচকও বললেন না, বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ (জনান্তিকে ১০ লাখ) ভারতীয় অবৈধভাবে কাজ করে (গার্মেন্ট, টেক্সটাইল, আইটি সেক্টরে)। তারা বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা ভারতে পাঠায়, তাও অবৈধভাবে। চতুর্দশত, বাংলাদেশ-ভারত মধ্যকার ১৬২টি ছিটমহলের বাসিন্দারা (১১১টি ভারতীয় যা বাংলাদেশে, ৫১টি বাংলাদেশি যা ভারতে) যে মানবেতর জীবনযাপন করছে ও ভারতীয় ক্যাবিনেটে হস্তান্তর প্রক্রিয়া অনুমোদিত হলেও, শুধু বিজেপির বিরোধিতার কারণে তা ভারতীয় সংবিধানের অংশ হতে পারেনি। এই 'মানবাধিকার লঙ্ঘনের' বিষয়টি সেমিনারে উচ্চারিত হলো না। পঞ্চদশত, ভারত বর্তমানে জাপানকে হটিয়ে দিয়ে বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক শক্তি (২০১১)। আগামী ৩০ বছরের মধ্যে ভারত দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। তখন মাথাপিছু আয় গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলার (বর্তমানে ৯৪০ ডলার)। বিশ্ব অর্থনীতিতে তখন ভারত অবদান রাখবে ১৭ শতাংশ। এ থেকে আমরাও উপকৃত হতে পারি। এ কথাটাও কোনো আলোচক বললেন না। ষষ্ঠদশত, ভারতে দরিদ্রতা একটা প্রধান সমস্যা। ২০১০ সালে দরিদ্রতার হার ছিল ৩৭.০৫ শতাংশ, অথচ ২০০৪ সালে ছিল ২৭.৫০ শতাংশ। অর্থাৎ দারিদ্র্য বেড়েছে। সুতরাং বাংলাদেশিদের ওই দেশে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না কাজের জন্য। আলোচকরা বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন কি না, সেটা প্রশ্ন হয়েই রইল। সপ্তদশত, তিস্তা ও ফারাক্কার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ভারতের আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প (যা মোদি সমর্থন করেন এবং বাস্তবায়ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন) কিংবা ৫৪টি নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টিও আলোচনায় স্থান পেল না। নিঃসন্দেহে নির্বাচন-পরবর্তী ভারতীয় সরকারের দিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। মোদি সরকার গঠন করতে পারবেন না (কুলদীপ নায়ার)- এ কথাটার পেছনে যেমন সত্যতা রয়েছে, ঠিক তেমনি ভোল পাল্টে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিশেষ প্যাকেজের প্রস্তাব দিয়েছেন বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিং) কিংবা জয়ললিতা যে মোদিকে সমর্থন করবেন না- এটাও স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তাই আলোচকরা যখন বলেন, 'পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা ও আলোচনার মধ্য দিয়ে সম্পর্ক জোরদার করা যেতে পারে', 'তিস্তা সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত', 'রাজনৈতিক অবিশ্বাস রয়েছে', 'নিজের' স্বার্থেই বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে ভারতকে', তখন এটা দিব্যি দিয়েই বলা যায়, এসব বক্তব্য কাগজ-কলমেই থেকে যাবে। ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা আমাদের সব সময় আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি কিছুই। মনমোহন সিংয়ের মতো একজন প্রধানমন্ত্রী যখন কথা দিয়ে যান 'কোনো সীমান্ত হত্যা হবে না', সে কথার প্রতিও সম্মান দেখায়নি ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স। ভারতীয় রাজনীতিবিদরা চাইলেও(?) ভারতীয় আমলারা বাংলাদেশকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখেন না। তাঁরা বাংলাদেশ থেকে কিভাবে সুবিধা আদায় করে নেওয়া যায়, সেদিকেই দৃষ্টি দেন বেশি। অথচ ভারতীয় উন্নয়ন থেকে আমরাও উপকৃত হতে পারি। আমরাও হতে পারি ভারতের উন্নয়নের অংশীদার। কিন্তু ভারতের নীতিতে, মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে মোদি কেন, তৃতীয় শক্তি হিসেবে মমতা, জয়ললিতা, মুলায়ম সিং, যিনিই প্রধানমন্ত্রী হোন বা কেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতীয় নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। এটাই হচ্ছে আসল কথা। আইসিএলডিএসের সেমিনারের অসম্পূর্ণতা এখানেই যে এ বিষয়টি জোরালোভাবে উচ্চারিত হলো না। Daily Kalerkontho 06.05.14

0 comments:

Post a Comment