দেশের
দ্বিতীয় পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র দক্ষিণাঞ্চলের কোনও এক চরে করার ঘোষণা
দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ৩০ এপ্রিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
মন্ত্রণালয়ে পরিদর্শনে এসে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এ কথা
বলেন। বাংলাদেশে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হতে যাচ্ছে
রূপপুরে। রাশিয়ার পারমাণবিক শক্তি কমিশন রোসাটম-এর সহযোগিতায় এক হাজার
মেগাওয়াট ক্ষমতার দুই চুল্লিবিশিষ্ট এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হবে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে। এখন পর্যন্ত রূপপুরে
কাজ শুরু হয়নি। তারপরও প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় আরেকটি পারমাণবিক
বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ঘোষণা দিলেন। এমনিতেই বিশ্বব্যাপী পরমাণু
বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে এক ধরনের বিরোধিতা রয়েছে। রূপপুরে পারমাণবিক
বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারেও পরিবেশবাদীরা বিরোধিতা করেছেন।
ফুলবাড়ীর ঘটনা আমাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ফুলবাড়ীর ঘটনা আমরা স্মরণ করতে
পারি। ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করেছিলেন স্থানীয় জনগণ। তারা বড়
ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করেছিলেন। তাদের সেই আশঙ্কার পেছনে সত্যতাও
ছিল। ফুলবাড়ীর জনগণ সেদিন কয়লা তুলতে দেননি। আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
গুলি চালিয়েছিল ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট। গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন ৬ ব্যক্তি।
সেদিনের সেই আন্দোলন বাংলাদেশে একটি ইতিহাস রচনা করেছিল। আজ যখন রূপপুরে
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হতে যাচ্ছে, তাতে আশঙ্কা একটা থেকেই গেল;
আর তা হচ্ছে- ফুলবাড়ীর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে রূপপুরে। যদিও রূপপুরে
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়া ও সেখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য
আমাদের ন্যূনতম আরও ৬ থেকে ৮ বছর অপেক্ষা করতে হবে। এখানে পরিবেশ বিপর্যয়ের
সম্ভাবনা ফুলবাড়ীর চেয়ে অনেকগুণ বেশি। এখানে নিরাপত্তা ঝুঁকিটা অনেক বেশি।
রূপপুরে যেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হয়েছে, তার পাশ দিয়ে
একটি নদী বয়ে গেছে। ঝুঁকিটা এ কারণেই। ফুকুসিমার পারমাণবিক বিপর্যয়ের পর
রূপপুরের ব্যাপারে আমাদের একটা শঙ্কা থাকবেই। বাংলাদেশের পরিবেশবাদীরা
বিষয়টি যে হালকাভাবে নেবেন, তা মনে করারও কোনও কারণ নেই। বাংলাদেশ অনেক
ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। ফুকুসিমায় কিংবা চেরনোবিলের চেয়ে অনেক বেশি ঘনবসতি
রূপপুরে। রাশিয়ার সঙ্গে যে ৫০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর
করেছে, তা নিয়ে গবেষণা করা হবে। ধারণা করছি এই গবেষণার নিরাপত্তার বিষয়টি
প্রাধান্য পাবে বেশি। বলা হচ্ছে, ৫ স্তরবিশিষ্ট একটি নিরাপত্তা বলয় থাকবে
এবং তৃতীয় জেনারেশনের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানো হবে। কিন্তু
নিরাপত্তার ব্যাপারে কতটুকু নিশ্চিত হওয়া যাবে- সে প্রশ্ন থেকেই গেল।জাপানের
ফুকুসিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়াবহ বিস্ফোরণের (২০১১) রেশ ফুরিয়ে
যাওয়ার আগেই বাংলাদেশ যখন রাশিয়ার সঙ্গে রূপপুরে পারমাণবিক চুল্লি তৈরির
একটি সমঝোতায় যায়, তখন সঙ্গতকারণেই এ নিয়ে বিতর্ক বাড়বেই। জাপান
প্রযুক্তিবিদ্যায় শীর্ষে অবস্থান করলেও পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা
নিশ্চিত করতে পারেনি দেশটি। বলা হচ্ছে-আশির দশকের মাঝামাঝি (১৯৮৬) রাশিয়ার
চেরনোবিলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল, এর চেয়েও ভয়াবহ
ছিল ফুকুসিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিস্ফোরণ। চেরনোবিলের বিস্ফোরণের
পর তেজস্ক্রিয়তা ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। গরুর দুধ, গুঁড়োদুধ,
শাকসবজি, ফলমূল- সবকিছুতেই তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ প্রায় ২৬ বছর
পরও চেরনোবিল ও আশপাশ এলাকা বিপন্মুক্ত নয়। ইউরোপের বেশ কিছু দেশ থেকে
কৃষিপণ্য রপ্তানি বেশ কয়েক বছর বন্ধ ছিল। এখন বাংলাদেশ পারমাণবিক
বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে গেল। কিন্তু এর নিরাপত্তা আমরা কীভাবে নিশ্চিত
করব, সে প্রশ্ন থেকেই গেল।
পরমাণু প্রকল্প খুব ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণও।
দক্ষিণ এশিয়ায় পরমাণু শক্তির ব্যবহার খুবই কম। ভারতে মোট জ্বালানির মাত্র ২
ভাগ ও পাকিস্তানের এক ভাগ আসে পরমাণু জ্বালানি থেকে। যদিও এ দুটো দেশ
পরমাণু শক্তি উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের
সঙ্গে ভারতের একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা খোদ ভারতেও বিতর্কের
সৃষ্টি করেছে। গেল বছর পাকিস্তান চীনের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল,
সেখানে চীন পাকিস্তানে বেশ কয়েকটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে
দেবে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ তৃতীয় দেশ, যারা পরমাণু শক্তির উৎপাদনে যাবে।
সাধারণত ৬০০ থেকে ১০০০ মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ৫০০
মেগাওয়াটের ওপরে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যায়। ৫০০ মেগাওয়াটের ওপরে
বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলে উৎপাদন খরচ কম হয়। কিন্তু এ ধরনের কেন্দ্র
স্থাপনে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ খরচ হয়। প্রচলিত
বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে প্রতি মেগাওয়াটের জন্য গড়ে খরচ হয় ১ মিলিয়ন মার্কিন
ডলার। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোয় পরমাণুকেন্দ্রে এই খরচ হয়েছে দেড়
থেকে ২ মিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন
করতে খরচ হবে দেড় মিলিয়ন বা ১৫০ কোটি টাকা। জাপানে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনে
খরচ হয় প্রতি ইউনিটে ৪ ডলার ৮০ সেন্ট। জাপানে কয়লায় খরচ হয় ৪ ডলার ৯৫ সেন্ট
ও গ্যাসে ৫ ডলার ২১ সেন্ট। দক্ষিণ কোরিয়ায় পরমাণুতে ২ ডলার ৩৪ সেন্ট,
কয়লায় ২ ডলার ১৬ সেন্ট, গ্যাসে ৪ ডলার ৬৫ সেন্ট। ফ্রান্সে পরমাণুতে ২ ডলার
৫৪ সেন্ট, কয়লায় ৩ ডলার ৩৩ সেন্ট ও গ্যাসে ৩ ডলার ৯২ সেন্ট।
বর্তমানে
বিশ্বে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তার ২৩.৫ ভাগই হয় পরমাণু শক্তি থেকে। এগুলো
সবই উন্নত দেশে অবস্থিত। বিশ্বে ২৮টি পরমাণুভিত্তিক ৪২০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র
রয়েছে। এর মাঝে ফ্রান্সে ৫৯টি। ফ্রান্সে মোট বিদ্যুতের ৭৯ শতাংশ উৎপাদিত হয়
পরমাণু শক্তি থেকে। বেলজিয়ামে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৫৮টি। দেশটির মোট
বিদ্যুতের ৫৮ ভাগই পারমাণবিক। সুইডেনে ৪৪ ভাগ, কোরিয়ায় ৪০ ভাগ, জাপানে ৫৫
ভাগ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ২০ ভাগ বিদ্যুৎ পরমাণু শক্তিনির্ভর। তবে ফুকুসিমার
পর জাপান নতুন করে চিন্তাভাবনা করছে এবং বিকল্প শক্তির কথা চিন্তা করছে।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে চীনে ৯ হাজার, ভারতে ৪ হাজার ১২০ ও
পাকিস্তানে ৪২৫ মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। ২০২০ সালের মধ্যে চীন
৪০ হাজার, ভারত ২০ হাজার ও পাকিস্তান ৭ হাজার মেগাওয়াটের পরমাণু
বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে। অনেকেই জানেন, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে
জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমতি নিতে হয়। বাংলাদেশ এই অনুমতি পেয়েছিল
২০০৭ সালের জুন মাসে। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়টা হচ্ছে- এর
রক্ষণাবেক্ষণ। দক্ষ জনশক্তি আমাদের নেই। এর অর্থ দীর্ঘদিন রাশিয়ার ওপর
নির্ভরশীলতা আমাদের থেকে যাবে। দ্বিতীয় আরেকটি সমস্যা হচ্ছে- জনবসতির
ঘনত্ব। রূপপুরে যেখানে জমি অধিকরণ করা হয়েছিল, সেখানে আশপাশে জনবসতি রয়েছে।
এই জনবসতি অপসারণ করা হবে একটি বড় সমস্যা। এছাড়া বাংলাদেশে এমন কোনও বিরান
এলাকা নেই, যেখানে কেন্দ্রটি স্থাপন করা যায়। আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা
বাড়ছে। আগামী ২০২০ সালে বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ১৬ হাজার ৮০৮
মেগাওয়াটে। তখন এ চাহিদা আমরা মেটাব কীভাবে? সম্ভবত পারমাণবিক বিদ্যুৎ ছাড়া
আমাদের কোনও বিকল্প নেই। আমাদের কয়লার একটা সম্ভাবনা থাকলেও সেখানে একটা
রাজনীতি ঢুকে গেছে। কয়লা উত্তোলনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে স্থানীয় জনগণের
স্বার্থ। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুললে কয়লাখনির সর্বোচ্চ ব্যবহার আমরা
নিশ্চিত করতে পারব বটে, কিন্তু বিশাল এক জনগোষ্ঠীকে স্থানান্তরিত করতে হবে।
উপরন্তু ভূগর্ভস্থ বিপুল পানি অপসারণ করতে হবে। তাতে করে পরিবেশে মারাত্মক
বিপর্যয় ঘটবে। কোনও জনপ্রিয় সরকারই এই অপ্রিয় কাজটি করতে চাইবে না। দলটি
স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়তা হারানোর ঝুঁকিতে থাকবে।
বাংলাদেশের মতো অধিক
ঘনবসতিপূর্ণ ও কৃষিনির্ভর দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের একটা
ঝুঁকি থাকবেই। ঝুঁকির বিষয়টি থাকা সত্ত্বেও সরকার এই সিদ্ধান্তটি নিল।
কেননা আমাদের কাছে এই মুহূর্তে বিকল্প জ্বালানির কোনও উৎস নেই। গ্যাসসম্পদ
সীমিত হয়ে আসার কারণে পারমাণবিক বিদ্যুৎই আমাদের ভরসা। তবে সরকারের যে
কাজটি করা উচিত, তা হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তার কথাটা স্থানীয়
জনগণকে বোঝানো, যেন এখানে কোনও ধরনের আন্দোলনের জন্ম না হয়। উপরন্তু যারা
ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তাদের চাকরির ব্যবস্থা করা এবং অন্যত্র জমি বরাদ্দের
বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। বাংলাদেশে জ্বালানিসম্পদের উৎস সীমিত হয়ে আসায়,
বাংলাদেশ আগামী দশকে বড় ধরনের একটি জ্বালানি ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে
পারমাণবিক বিদ্যুৎ একটি ‘সমাধান’ হলেও সমস্যা রয়ে গেছে অনেক। তাই
প্রধানমন্ত্রী যখন আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা বলেন, তখন আমাদের
মাঝে নানা শঙ্কা কাজ করে। নিরাপত্তার বিষয়টি এখানে বড় গুরুত্বপূর্ণ।
বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে- এটা সত্য। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এ
ক্ষেত্রে কোনও সমাধান নয়। আমাদের কয়লা রয়েছে। আমরা কয়লাসম্পদ দিয়ে বিদ্যুৎ
উৎপাদনে যেতে পারি। এই বিষয়টির যত দ্রুত সমাধান করা যায়, ততই আমাদের জন্য
মঙ্গল।
Dainik Amader Somoy
15.05.14
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment