রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

টিকফা চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল

গত ২৮ এপ্রিল ঢাকায় টিকফা চুক্তির প্রথম বৈঠক শেষ হওয়ার পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে- এই চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ আদৌ রক্ষিত হবে কি-না? বাংলাদেশের প্রত্যাশা ছিল বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধার ব্যাপারে বাংলাদেশের দাবি মেনে নেবে। কিন্তু তা হয়নি। এমনকী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাণিজ্যে বাংলাদেশ যে সুবিধাটুকু চেয়েছিল, সে ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের মনোভাব ছিল নেতিবাচক। যখন টিকফা চুক্তির ভবিষ্যৎ একটা প্রশ্নের মাঝে থেকে গেল, ধারণা করা হচ্ছে- এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র ফায়দা ওঠাবে বেশি। বাংলাদেশের প্রাপ্তি খুব বেশি নয়। বলা ভালো গত ২৫ নভেম্বর (২০১৩) ওয়াশিংটনে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সাধারণত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনও নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না। তারা সাধারণত নির্বাচন-সংক্রান্ত কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এমনি এক পরিস্থিতিতে সরকার টিকফার মতো গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। যদিও এটা ঠিক গত ১৭ জুন (২০১৩) মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এই চুক্তিটি অনুমোদিত হয়েছিল। তারপরও সরকার ৫ মাস সময় পেয়েছিল এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করতে। প্রশ্নটা এই কারণেই উঠেছে যে, বিগত মহাজোট সরকার জুনে নীতিগতভাবে এই চুক্তির পক্ষে অবস্থান নিলেও তা ওই সময়ে স্বাক্ষর করল না কেন? কেনই বা একটি নির্বাচিত সরকারের জন্য সরকার অপেক্ষা করল না? আরও অবাক করার বিষয় টিকফার মতো একটি জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট চুক্তি নিয়ে জাতীয় সংসদে আদৌ আলোচনা কেন হল না? সংগত কারণেই তাই টিকফা নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকবে। গত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভূমিকাকে এখন একটি বড় প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিল। যদিও আমরা লক্ষ করেছি, বিএনপির শীর্ষস্থানীয় এক নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এই চুক্তিকে তখন স্বাগত জানিয়েছিলেন। এখানেও একটি প্রশ্ন আছে। বিএনপির এই নেতার ‘অভিমত’ কি ব্যক্তিগত নাকি দলীয় সিদ্ধান্ত, সে ব্যাপারেও আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। কেননা বিএনপির স্থায়ী কমিটির কোনও সভায় এই চুক্তিটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, এ তথ্য আমার জানা নেই। তবে ইতোমধ্যে বাম সংগঠনগুলো এই চুক্তির বিরোধিতা করেছে। সিপিবি-বাসদ ঢাকায় এই চুক্তির প্রতিবাদে একটি বিক্ষোভ মিছিলও বের করেছিল। তাদের অভিমত, এই চুক্তিতে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। মজার কথা, বর্তমান ও বিগত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে দুটি বাম দলের প্রতিনিধিত্ব (জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি) থাকলেও টিকফা চুক্তির ব্যাপারে তাদের কোনও মন্তব্য চোখে পড়েনি। চুক্তিটি সম্পর্কে আমরা যা জানতে পেরেছি তা হচ্ছে- চুক্তিটিতে ১৬টি অনুচ্ছেদ আর ৭টি আর্টিকেল রয়েছে। প্রায় ৪২টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এ রকম চুক্তি রয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব আমাদের জানিয়েছেন। অন্যদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মোজীনা আমাদের জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৫০টি দেশের এ রকম চুক্তি রয়েছে। তবে চুক্তির নামকরণের ব্যাপারে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। শুরুতে চুক্তির সঙ্গে ‘অ্যাগ্রিমেন্ট’ শব্দটি থাকলেও বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা ওঠায় ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ শব্দটি বদলে ফোরাম শব্দটি যুক্ত করা হয়। বিভিন্ন মহল থেকে চুক্তিটির সঙ্গে জিএসপির একটা যোগসূত্র আছে বলা হলেও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের আমাদের জানিয়েছিলেন টিকফার সঙ্গে জিএসপি বা শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কোনও যোগসূত্র নেই। তবে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধার দাবি অব্যাহত রাখবে- এ রকমটিই জানিয়েছেন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের। বলতেই হবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ায় তা বিতর্কের মাত্রা বাড়িয়েছে। বলা হচ্ছে- এতে বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়বে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়বে। দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও উন্নত হবে। এটা সত্য, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদেরও টিকফা চুক্তির ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। সরকারের পক্ষ থেকে তখন এমন আশাও ব্যক্ত করা হয়েছিল যে, টিকফা চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পাবে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তা পায়নি। বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্র কিছুদিন আগে (জুন ২০১৩) কিছু পণ্যের যে শুল্কমুক্ত সুবিধা (জিএসপি) বাংলাদেশকে দিত, তা স্থগিত করেছে। স্থগিত হওয়ার পেছনে মূল কারণটি ছিল বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোয় শ্রমমান নিশ্চিত করার ব্যর্থতা। এমনকী আশুলিয়ায় শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে না পারা, তৈরি পোশাকশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা না করার ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্র অসন্তুষ্ট ছিল। ফলে একপর্যায়ে কংগ্রেস সদস্যদের চাপের মুখে জিএসপি সুবিধা স্থগিত হয়ে যায়। এরপর বাংলাদেশ সরকারের একটা প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়, টিকফা চুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্র হয়তো বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দেবে। প্রকৃতপক্ষে এর সঙ্গে টিকফা চুক্তির কোনও যোগসূত্র নেই। দ্বিতীয় আরেকটি যে বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে জিএসপি সুবিধা ফিরে পেলেও তাতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বাড়বে না। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তৈরি পোশাকে জিএসপি সুবিধা চেয়ে আসছে। কিন্তু তৈরি পোশাকে আমাদের কোনও জিএসপি সুবিধা নেই। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার হচ্ছে ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের। এর মাঝে মাত্র ০.৫ ভাগ পণ্য এই শুল্কমুক্ত সুবিধা পেত। এর পরিমাণ মাত্র ২৬ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন ডলার কর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এখনও তার পণ্য নিয়ে টিকে আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় যেসব বাংলাদেশি পণ্যে এর মাঝে রয়েছে তামাক, সিরামিক, ফার্নিচার, প্লাস্টিক, খেলনা ইত্যাদি। এর খুব কম পণ্যই বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে। গার্মেন্ট বা তৈরি পোশাকে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা শতকরা ১৫ ভাগ হারে শুল্ক পরিশোধ করে বাজার ধরে রেখেছে। অথচ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার দোহা চুক্তি অনুযায়ী একটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তার পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা দিচ্ছে না। এই সুবিধা উন্নত রাষ্ট্রগুলো পায়। তৈরি পোশাকে শুল্কমুক্ত সুবিধা না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দোহা চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। সুতরাং তৈরি পোশাকে আমরা যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা না পাই, তাহলে এই জিএসপি সুবিধা রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনও বড় অবদান রাখতে পারবে না। আজ যদি জিএসপি সুবিধার আশ্বাসে আমরা টিকফা চুক্তি করে থাকি, তাতে আমাদের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। টিকফা চুক্তির সঙ্গে তাই জিএসপি সুবিধাকে মেলানো যাবে না। জিএসপি সুবিধা একটি ভিন্ন বিষয়। ঢাকার প্রথম বৈঠকে এটি আবারও প্রমাণিত হল। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে টিকফা চুক্তি করে আমরা কতটুকু উপকৃত হব। টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দেশে মার্কিনি বিনিয়োগ বাড়বে- এটা সত্য কথা। এতে আমাদের বাজার, সেবা খাত উন্মুক্ত হয়ে যাবে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য। ব্যাপক প্রাইভেটাইজেশন ঘটবে, তাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যক্তিগত খাত। টিকফা চুক্তির আওতায় ৫ ও ১৯ ধারা মতে উভয় দেশ (বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র) বাণিজ্যে বেশ নমনীয় নীতিগ্রহণ করবে এবং ব্যাপক বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করবে। ৮নং ধারায় ব্যাপক ব্যক্তিগত খাত প্রসারের কথা বলা হয়েছে। এই ধারায় একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন গঠন করার কথাও আছে। এদের কাজ হবে ব্যক্তিগত খাত কীভাবে আরও বিকশিত করা যায়, সে ব্যাপারে উভয় সরকারকে উপদেশ দেওয়া। ৯নং ধারায় বলা আছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে কিন্তু উৎপাদন খাতে জড়াবে না। অর্থাৎ কোনও পণ্য উৎপাদন করবে না। এখানে সমস্যা হবে অনেক। এক. যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করবে (বিশেষ করে সেবা খাতে)। এবং ওইসব কোম্পানিকে ট্যাক্স সুবিধা দিতে হবে। আইনে যদি কোনও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, তাহলে বাংলাদেশকে সেই আইন সংশোধন করতে হবে। ফলে স্থানীয় উদ্যোক্তারা মার খাবে। তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। দুই. চুক্তির ফলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে নিরাপত্তা দিতে বাধ্য থাকবে। জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর ব্যবহার, টেলিকমিউনিকেশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় এসব খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে গেলে শিক্ষা খাত পণ্যে পরিণত হবে। বিনামূল্যে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। উচ্চশিক্ষা ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। এতে শিক্ষাক্ষেত্রে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যারা ধনী, তারা শিক্ষাগ্রহণ করবে আর যারা গরিব তারা শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। একই কথা প্রযোজ্য স্বাস্থ্য খাতের ক্ষেত্রেও। স্বাস্থ্য খাতে খরচ বেড়ে যাবে। এসব সেবামূলক খাত থেকে সাধারণ মানুষ যে ‘সেবা’ পেত তা ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসবে। সেবার জন্য সাধারণ মানুষকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানির দাম বেড়ে যাবে। সাধারণ গ্রাহককে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাস কিনতে হবে। সরকারি ভর্তুকির কোনও সুযোগ থাকবে না। তবে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকবে কৃষি ও আইটি সেক্টর। কৃষিতে যে সরকার ভর্তুকি দেয়, তা আর দিতে পারবে না। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার দোহা চুক্তিতে বলা হয়েছিল- স্বল্পোন্নত দেশগুলো কৃষিতে ৫ ভাগের বেশি ভর্তুকি দিতে পারবে না। টিকফা চুক্তির ১৮নং ধারায় বলা হয়েছে- কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে হবে। মজার ব্যাপার, যুক্তরাষ্ট্র নিজে কৃষিতে ভর্তুকি দেয় ৯ ভাগ। এখন বাংলাদেশে কৃষি সেক্টরে ভর্তুকি কমানো হলে কৃষিতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। কৃষক উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। ফলে কৃষি উৎপাদন, বিশেষ করে চাল উৎপাদন হ্রাস পাবে। বাংলাদেশকে এখন চাল আমদানি করতে হয় না। কিন্তু উৎপাদন হ্রাস পেলে মার্কিন কৃষিপণ্যের এক বিশাল বাজার তৈরি হবে বাংলাদেশে। মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো, যারা গম ও চাল উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত, তাদের এক বিশাল বাজার তৈরি হবে বাংলাদেশে। তিন. বলা হচ্ছে টিকফা চুক্তি হলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ার আদৌ কোনও সম্ভাবনা নেই। কেননা অত্যন্ত উচ্চ কর দিয়ে (১৫ দশমিক ৬২ ভাগ) বাংলাদেশ তার রপ্তানি বাজার সম্প্রসারিত করেছে। অথচ চীনের মতো বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের চেয়ে কম কর দেয়, মাত্র শতকরা ৩ ভাগ। অথচ চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনও টিকফা চুক্তিও নেই। চার. বাংলাদেশ বড় সমস্যায় পড়বে মেধাস্বত্ব আইন নিয়ে। টিকফা চুক্তি কার্যকর হলে এই মেধাস্বত্ব আইনের শক্ত প্রয়োগ হবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের কৃষি সেক্টর, ওষুধশিল্প ও কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা। কৃষক আর বীজ সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে না। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বীজ কিনতে বাধ্য করা হবে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো একসময় জিম্মি করে ফেলবে আমাদের কৃষি সেক্টরকে। বাংলাদেশের ওষুধশিল্প উন্নয়নশীল দেশে নাম করলেও টিকফা চুক্তির পর এই শিল্প এক ধরনের ঝুঁকির মুখে থাকবে। কেননা ওষুধ কোম্পানিগুলো প্যাটেন্ট কিনে কাঁচামাল আমদানি করে সস্তায় ওষুধ তৈরি করে। বিশ্বের ৬০টি দেশে এই ওষুধ রপ্তানি হয়। এখন এই টিকফা চুক্তির ফলে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্যাটেন্ট ক্রয় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যদিও ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য এই সুযোগটি রয়েছে। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে মার্কিন কোম্পানির লাইসেন্স কিনতে হবে। ওই লাইসেন্স দিয়ে ওষুধ তৈরি করতে হবে। ফলে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বেড়ে যাবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই ওষুধ ক্রয় করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের কম্পিউটার সফটওয়্যার-শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। কেননা এখন স্বল্পমূল্যে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি করে কম্পিউটার এ দেশেই সংযোজিত হয়। ফলে কম্পিউটারের দাম একটা ক্রয়সীমার মধ্যে আছে। কিন্তু টিকফা চুক্তির বাধ্যবাধকতার কারণে এই ‘কোন কম্পিউটার’ আমদানি বা সংযোজন বন্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশকে তখন ব্র্যান্ড কম্পিউটার আমদানি করতে হবে, যার মূল্য গিয়ে দাঁড়াবে অনেক। সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে তা চলে যাবে। বাংলাদেশ যে ‘ডিজিটাল যুগের’ কথা বলছে, তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে তখন। ইতোমধ্যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেক দুর্বল হয়েছে। টিকফার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিরাপত্তা, বিনিয়োগের গ্যারান্টি, মেধাস্বত্ব আইনের প্রয়োগ ও শ্রমমান উন্নত করার প্রশ্নটি। এই চুক্তিতে জিএসপি সুবিধার প্রশ্নটি কোথাও উল্লেখ না থাকায় আগামীতেও এই চুক্তির আওতায় জিএসপি সুবিধা চাওয়া যাবে না। জিএসপি সুবিধা চাওয়ার বিষয়টি আলোচনা করতে হবে ভিন্ন ফোরামে। ঢাকায় প্রথম বৈঠকে এটা স্পষ্ট করে দিলেন মার্কিন প্রতিনিধিরা। বিদ্যমান চুক্তিতে পরিবর্তন আনার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তবে চুক্তির পর্যালোচনা করার সুযোগ আছে। টিকফায় বাংলাদেশ কীভাবে উপকৃত হতে পারে, সে ব্যাপারে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। আলোচনায় বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার কর্মকা-ে এবং চুক্তির ব্যাপারে যারা অভিজ্ঞ, সেসব বিশেষজ্ঞকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। আমলানির্ভর অদক্ষ প্রতিনিধিদল গঠন করে দরকষাকষিতে আমরা টিকফা থেকে সুবিধা নিতে পারব না। আগামী বছর ওয়াশিংটনে পরবর্তী রাউন্ড আলোচনা শুরু হবে। এখন থেকেই প্রস্তুতিটা নিতে হবে। টিকফার প্রথম বৈঠকে আমরা মার্কিনি মনোভাব বুঝে গেছি। সুতরাং এখন থেকেই সেই আঙ্গিকে প্রস্তুতি নিতে হবে। Daily Amader Somoy 05.05.14

0 comments:

Post a Comment